অত্যধিক পরিশ্রমে শারীরিক দুর্বলতা। বাহন বিষয়ে সতর্কতা প্রয়োজন। সন্তানের বিদ্যা-শিক্ষায় অগ্রগতি বিষয়ে সংশয় বৃদ্ধি। আধ্যাত্মিক ... বিশদ
এয়ারক্রাফ্ট বোয়িং ৭৭৭-২০০এলআর উড়িয়ে সম্প্রতি নজর কেড়েছেন জোয়া আগরওয়াল। সানফ্রান্সিসকো থেকে বেঙ্গালুরু— ক্যাপ্টেন জোয়ার নেতৃত্বে এই দীর্ঘ উড়ানটি ছিল সম্পূর্ণ মহিলা চালিত। ফ্লাইটটি উল্লেখযোগ্য নানা কারণে। এটি সবচেয়ে বেশি সময়ের ফ্লাইট তো বটেই, তার ওপর আবার নর্থ পোলের ওপর দিয়ে এর যাত্রাপথ। এহেন অভিজ্ঞতার কথা পাঠকদের সঙ্গে ভাগ করে নিলেন ফ্লাইট ক্যাপ্টেন জোয়া।
আকাশে ওড়ার স্বপ্নটা কি বরাবরের?
হ্যাঁ, একদম ছোটবেলা থেকেই আকাশে ওড়ার স্বপ্ন দেখতাম। আমার যখন মাত্র পাঁচ বছর তখনই আকাশে তারা দেখে মনে হতো, ইশ, যদি ওই তারাদের মাঝে ঘুরে বেড়াতে পারতাম। আমার ছোটবেলার সেই ইচ্ছেডানায় ভর দিয়েই আজ আমি পাইলট হয়ে উঠেছি। কিন্তু তার জন্য প্রচুর বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে আমাকে।
কী ধরনের বাধার কথা বলছেন?
ছোটবেলায় আমি যে পরিবেশে বড় হয়েছি সেখানে একটি মেয়ের আকাশে ওড়ার স্বপ্ন তো দূর অস্ত, এমনকী স্বনির্ভর হওয়ার স্বপ্ন দেখাও অসম্ভব ছিল। চারপাশে শুধু শুনতাম, ‘অসম্ভব। মেয়ে হয়ে পাইলট হওয়া, প্লেন চালানো অসম্ভব!’ আর সেই অসম্ভবের উল্টো দিকে ছিলাম আমি একা। তবু আমার অপরিণত মন আমাকে বোঝাত, পৃথিবীতে অসম্ভব বলে কোনও কথা নেই। ইচ্ছে থাকলে উপায় অবশ্যই হবে। সম্ভব আর অসম্ভবের লড়াইয়ের মাঝেই আমি কবে যেন আমার স্বপ্নটা বুকে নিয়ে বড় হয়ে উঠলাম।
কেমন ছিল সেই পারিপার্শ্বিক?
একটি মারওয়াড়ি পরিবারে আমার জন্ম। বাবা চাকরি করতেন, মা গৃহবধূ। বেশ অসচ্ছলতার মধ্যেই শৈশব থেকে যৌবন কেটেছে। আমাদের পরিবারে কিছু বাঁধাধরা চিন্তাভাবনা ছিল। তার একটা হল, মেয়েদের অবস্থান পুরুষের অধীনে। মেয়েরা বিয়ে করে বাচ্চা মানুষ করে জীবন কাটাবে, ঘরের চার দেওয়ালের ঘেরাটোপই তাদের সেরা আশ্রয়। স্বনির্ভরতার স্বপ্ন মেয়েদের জন্য নয়। ফলে এমন পরিবেশে থেকে স্বনির্ভর হওয়ার ইচ্ছাকে মনে মনে লালন করা এবং পরে সেই ইচ্ছেডানা মেলে আকাশপথে পাড়ি জমানো যে নেহাত সহজ ছিল না তা তো বলাই বাহুল্য।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে থেকেও কীভাবে শেষ পর্যন্ত আপনার স্বপ্নকে সফল করেছিলেন?
স্রেফ মনের জোরের ওপর ভরসা করে। ওই যে ছোটবেলা থেকেই কোনও কিছুকে অসম্ভব মনে করিনি, সেটাই শেষ পর্যন্ত আমার স্বনির্ভরতা অর্জনের একমাত্র পথ হয়ে দাঁড়ায়। খুব ছোটবেলায় মাকে দেখে বুঝেছিলাম জীবন সহজ নয়, তাই বলে পরিস্থিতির শিকার হয়ে নিজের ইচ্ছে জলাঞ্জলিও দেওয়া উচিত নয়। তাতে জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। তাই অনেক প্রতিবন্ধকতার মাঝেও নিজের স্বপ্নকে সফল করার পথে এগিয়ে গিয়েছি। বাড়িতে সবাইকে বুঝিয়েছি আমায় ঠিকমতো পড়াশোনা করতে দিতেই হবে। তার জন্য লড়াই করেছি, ঝগড়া করেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্বনির্ভর হওয়ার স্বপ্ন সফল করেছি।
উত্তর মেরুর ওপর দিয়ে আপনি ও আরও তিনজন মহিলা সবচেয়ে বেশিক্ষণের ফ্লাইটটি উড়িয়ে নিয়ে এসেছেন সম্প্রতি। সেই অভিজ্ঞতার কথা একটু পাঠকদের বলুন।
এককথায় অনবদ্য, অপার্থিব একটা অভিজ্ঞতা। উত্তর মেরুর ওপর দিয়ে যাত্রা করাই একটা বিশেষ অভিজ্ঞতা, তার ওপর আবার লংগেস্ট ফ্লাইট। তাও চালাচ্ছে কারা? না, একদল মহিলা। উফ! সব মিলিয়ে সে যেন এক অসম্ভব গর্বের মুহূর্ত। শীতকালে উত্তর মেরু এমনিতেই অন্ধকারে ঢাকা থাকে। আর সেই অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে যেন আলোর সন্ধান করছি আমরা। আক্ষরিক অর্থেই এটা বুঝি মেয়েদের অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রা! অদ্ভুত একটা রোমাঞ্চ হচ্ছিল। আর প্রকৃতির বর্ণনা তো ভাষায় প্রকাশ করাই দায়। সেই কী দৃশ্য, উফ! আকাশে নিকষ কালো আঁধার আর তার মাঝে জ্বলজ্বল করছে নক্ষত্ররাজি। তারার আলোয় ঝলছে যাচ্ছে চারপাশ। আকাশ ভরা সূর্য তারার মাঝে নিজের স্থান করে নিতে পারার অনুভূতি যে কতটা মনোমুগ্ধকর..., কী বলব! তার ওপর আবার আমার কো পাইলট এবং ক্রু সবাই মহিলা। ভারতের মেয়েদের কাছে এ এক অভূতপূর্ব সাফল্য। আমরা যে ‘মেয়েমানুষ’-এর খোলস ছেড়ে ‘মানুষ’ হয়ে উঠেছি। পুরুষের অধীনে না থেকে তাদের পরিপূরক হয়েছি, এর চেয়ে বড় ভালোলাগা আর কী-ই বা হতে পারে?
উত্তর মেরুর ওপর দিয়ে প্লেন ওড়ানোর চ্যালেঞ্জটা কেমন ছিল?
প্রচণ্ড চ্যালেঞ্জিং একটা ফ্লাইট ছিল। আমরা এই ধরনের ফ্লাইটে অনেক জিনিস খেয়াল রেখে চলেছি। যেমন ফুয়েল একটা বড় সমস্যা হয়ে উঠেছিল। আমাদের সবসময় যতটা সম্ভব তেল বাঁচিয়ে চলতে হয়েছে। কীভাবে, কোন স্পিডে চালালে সবচেয়ে বেশি তেল সংরক্ষণ করা যায় সে নিয়ে রীতিমতো ট্রেনিং নিতে হয়েছে। তাছাড়া এই ফ্লাইটে আবহাওয়ার তারতম্য একটা বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কেমন আবহাওয়া থাকবে তার ওপর নির্ভর করবে ফ্লাইট ওড়ানোর খুঁটিনাটি। আর এটা তো পরীক্ষামূলক ফ্লাইট নয়। একেবারে ষোলো আনা কমার্শিয়াল ফ্লাইট। ৪০০০ যাত্রীর জীবন আমার এবং আমাদের ক্রুয়ের ওপর নির্ভরশীল। ফলে শুধু নিজেদের দায়িত্বই নয়, যাত্রীদের সম্পূর্ণ ভার নিয়ে আমরা আকাশপথে রওনা হয়েছিলাম। আর এই যে যাত্রা, তার প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল ফ্লাইটের এক মাস আগে থেকে। কিন্তু শুধু আমার অভিজ্ঞতা, বা যাত্রীদের দায়িত্বই শেষ কথা ছিল না। এই ফ্লাইটটা চালানোর পরে আমার একটা অভূতপূর্ব অনুভূতি হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় সাড়া জাগানো মেসেজ পেয়েছি। আর সেইসব মেসেজে অসংখ্য মেয়ে লিখেছে যে তারা আমার মতো নির্ভীকভাবে জীবন কাটাতে চায়। আমি তাদের অনুপ্রেরণা। এই যে সাধারণ একজন জোয়া আগরওয়ালের থেকে এতজন মহিলার অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠা, এটা একটা অন্য ধরনের অনুভূতি।
কেমন সেই অভিজ্ঞতা?
একটা সময় আমার মনে হয়েছে, আমার পাইলট হয়ে ওঠার নেপথ্যে ঈশ্বরের হাত রয়েছে। এখন এটাই আমার জীবনের ‘মিশন’ হয়ে উঠেছে। আমায় দেখে মেয়েরা যদি স্বনির্ভর হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারে তাহলে সেটাই আমার জীবনের সার্থকতা। ভারতে মেয়েরা এখনও অনেকাংশেই অবদমিত। তারা তাদের ভাবনাচিন্তার কথা সর্বসমক্ষে বলতে দ্বিধাবোধ করে। সমাজে সংসারে তাদের গুরুত্ব দেওয়া হয় না অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। ফলে আমার এই কৃতিত্ব যখন সেই ধরনের মহিলাদের মনোবল বাড়িয়ে তুলতে সক্ষম হয়, যখন অবদমিত মেয়েরা জীবনের একটা অর্থ খুঁজে পায় আমায় দেখে, তখন সত্যিই মনে হয় যাক জীবনে কিছু করলাম। আর আমি এটা আরও বেশি অনুভব করতে পারি কারণ আমি নিজেই প্রচুর বাধার মধ্যে দিয়ে এই জায়গায় পৌঁছেছি। ফলে অন্যের অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠার আনন্দ আমার কাছে অনেক বেশি। আমি চাই আমাদের দেশের মেয়েরা নিজের লড়াইটা নিজে লড়ুক। সমাজে প্রথম শ্রেণির নাগরিক হয়ে উঠুক। আমাদের সেই ক্ষমতা আছে। শুধু একটু সাহসের দরকার। আত্মবিশ্বাসের প্রয়োজন। নিজেদের ইচ্ছেগুলো নিজেদের কাছে স্পষ্ট করে নেওয়া দরকার। দেখবেন সমাজ আর প্রতিবন্ধকতার দেওয়ালটা তুলতে পারবে না।
আগামী দিনে মেয়েদের উদ্দেশ্যে আপনার বার্তা কী?
শুধু একটাই কথা বলব, এই পৃথিবীতে কোনও কিছুই অসম্ভব নয়। তাই সমাজ ও পুরুষতন্ত্রের তৈরি করা সব স্টিরিওটাইপ ভেঙে দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। আত্মবিশ্বাসের ওপর ভর দিয়ে নিজেদের স্বপ্নগুলোকে সফল করতে হবে। ইচ্ছেডানা মেলে এগিয়ে পড়ুন, দেখবেন লক্ষ্যে পৌঁছনো তেমনও কঠিন নয়।