অত্যধিক পরিশ্রমে শারীরিক দুর্বলতা। বাহন বিষয়ে সতর্কতা প্রয়োজন। সন্তানের বিদ্যা-শিক্ষায় অগ্রগতি বিষয়ে সংশয় বৃদ্ধি। আধ্যাত্মিক ... বিশদ
ইংরেজি ক্যালেন্ডার মেনেই চলে আমাদের দৈনন্দিন জীবন। অনুষ্ঠান থেকে জন্মদিন সবই ওই ইংরেজি তারিখ অনুযায়ী। তবু বাংলা বছরের প্রথম দিনটি আজও বঙ্গজীবনে উল্লেখযোগ্য। পয়লা বৈশাখ মানেই বাঙালির হালখাতা আর একরাশ নস্টালজিয়া। সেই নস্টালজিয়ার সূত্র ধরেই ফিরে দেখা বাঙালি কন্যাদের দিনযাপন। বাংলা নতুন বছরের প্রাক্কালে আজ তাঁরাই আলোচ্য যাঁরা উল্লেখযোগ্য। জীবনের কয়েকটি ক্ষেত্রে প্রথম বাঙালি মহিলাদের উপস্থিতির কথা উঠে এসেছে আলোচনায়।
প্রথম বাঙালি মহিলা আইনজীবী লতিকা সরকার
বঙ্গজীবনে নারীর স্থান চিরকালই ছিল পুরুষের অধীনে। তাদের রোজগার ছিল না। ছিল না স্বনির্ভরতা। তাই পুরুষের দ্বারা চালিত হতেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল মেয়েরা। কিন্তু তাদেরও তো কিছু অধিকার রয়েছে। সেসব অধিকারের কথা যিনি প্রথম সর্বসমক্ষে তুলে ধরেন তিনি লতিকা সরকার। নারীর অধিকার এবং সামাজিক অবস্থান বিষয়ে পড়াশোনা করে লতিকা হয়ে উঠলেন প্রথম বাঙালি মহিলা আইনজীবী। আইনজীবী হলেও তিনি কিন্তু আদালতে সওয়াল করতেন না। বরং আইনের, বিশেষত মহিলা সংক্রান্ত আইনের বিভিন্ন দিক বিষয়ে মেয়েদের ওয়াকিবহাল করতেন। নিজেদের অধিকার বিষয়ে তাদের সচেতন করতেন। এবং সেই অধিকার পাওয়ার লড়াইয়ে শামিল হওয়ার জন্য মেয়েদের উদ্বুদ্ধ করতেন। এছাড়া ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপকও ছিলেন লতিকা। এরপর তিনি ইন্ডিয়ান ল ইনস্টিটিউটের প্রধান হিসেবে কাজ করেন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বাঙালি মহিলা গ্র্যাজুয়েট তিনি। এরপর ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই উইমেন’স রাইটস বিষয়ে গবেষণাও করেন।
আইনের প্রতি লতিকার টান কিন্তু হঠাৎ নয়। তাঁর বাবা, ধীরেন মিত্র ছিলেন নামকরা আইনজীবী। ১৯৫৩ সালে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন পাশ করে দেশে ফিরে লতিকা যখন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে শুরু করলেন তখন তিনিই ছিলেন আইন বিভাগের একমাত্র মহিলা অধ্যাপক। এবং আইনের ছাত্রীর সংখ্যা ছিল দশ। আইন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়েই লতিকা বুঝতে পারেন এদেশের মেয়েরা নিজেদের অধিকার বিষয়ে সচেতন নয়। সেই সচেতনতা আনার জন্যই শুরু হয় তাঁর লড়াই। মহিলাদের অধিকারকে বিষয় করে পড়াশোনা এগিয়ে নিয়ে যান লতিকা এবং পরবর্তীকালে সেন্টার অব উইমেন’স স্টাডিজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হয়ে ওঠেন। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ৯০ বছর বয়সে শেষ শ্বাস ত্যাগ করেন লতিকা সরকার।
প্রথম বাঙালি মহিলা অধ্যাপক চন্দ্রমুখী বসু
১৮৬০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দেরাদুন শহরে জন্ম চন্দ্রমুখী বসুর। ১৮৮২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে তিনিও হাতে গোনা কয়েকজন মহিলা গ্র্যাজুয়েটের অন্যতম হয়ে ওঠেন। স্নাতক হওয়ার পর মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার ঘটানোই জীবনের লক্ষ্য হয়ে ওঠে চন্দ্রমুখী দেবীর। সেই উদ্দেশ্যেই তিনি প্রথম বেথুন কলেজে পড়ানোর চাকরির আবেদন করেন। কিন্তু সেই সময় বেথুন কলেজে অ-হিন্দু মেয়েদের চাকরি দেওয়া হতো না। এদিকে চন্দ্রমুখী ছিলেন ব্রাহ্ম। অগত্যা তিনি আবারও চাকরির জন্য আবেদন করেন স্কটিশ চার্চ কলেজে। সেখানেও তাঁর আবেদনপত্র খারিজ হয়ে যায়। বলা হয়, কলেজে শিক্ষকতা করার মতো অভিজ্ঞতা এবং ডিগ্রি কোনওটাই চন্দ্রমুখীর নেই। অতএব তাঁকে আরও উচ্চস্তরে পড়াশোনা করতে হবে। এরপর স্নাতকোত্তর স্তরে ভর্তি হলেন চন্দ্রমুখী। কলা বিভাগে সে যুগে তিনিই ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র ছাত্রী। ১৮৮৪ সালে এম এ পাশ করেন চন্দ্রমুখী। এবং ১৮৮৬ সালে সেই বেথুন কলেজেই অধ্যাপিকা হিসেবে চাকরি পান। নারী শিক্ষার প্রসারের কাজে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তিনি। মেয়েদের স্নাতক স্তরে ভর্তি হওয়ার জন্য তাদের অভিভাবকদের অনুরোধ করেছেন। শিক্ষা ও স্বনির্ভরতা জীবনে চলার ক্ষেত্রে কতটা প্রয়োজন, সে বিষয়ে বিভিন্ন সেমিনার ও কর্মশালার আয়োজন করেছেন। অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে না দিয়ে বরং তাদের পড়াশোনা শেখালে তারাও যে একদিন বয়স্ক বাবা মা’র দায়িত্ব নিতে পারে, সে বিষয়ে অভিভাবকদের বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। চাকরি জীবনের শেষের দিকে তিনি বেথুন কলেজের অধ্যক্ষা হন। তবে সম্পূর্ণ সময় চাকরি করতে পারেননি শারীরিক অসুস্থতার কারণে। জীবনের শেষ দিকে চাকরি থেকে অবসর নিয়ে জন্মস্থান দেরাদুনে ফিরে যান চন্দ্রমুখী বসু।
প্রথম বাঙালি লেখিকা চন্দ্রাবতী
প্রথম বাঙালি লেখিকা হিসেবে স্বর্ণকুমারী দেবীর নামই সর্বমহলে পরিচিত। কিন্তু তার অনেক দিন আগে, মধ্যযুগে এক মহিলা নারীবাদী উপন্যাস লিখে নাম করেছিলেন। তিনি চন্দ্রাবতী দেবী। তবে তাঁর নাম খুব একটা সুদূরপ্রসারী হয়ে ওঠেনি। কিন্তু সেই মধ্যযুগেও তিনি তাঁর লেখার মাধ্যমে নারীবাদের প্রচার করেন। রামায়ণ মহাকাব্যটি তিনি সীতার বয়ানে লিখে বেশ উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠেন। বাংলাদেশের ঢাকায় ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন চন্দ্রাবতী দেবী। ছোট থেকেই বংশীদাস ভট্টাচার্যের এই কন্যাটি বাবার রচনা দ্বারা অনুপ্রাণিত। বাবার কাছেই মনসা ভাসানের গান প্রথম শোনেন। এবং সেই গানে মনসাকে কন্যা রূপে কল্পনা করেন। রামায়ণে সীতার দুঃখ এবং হতাশা তুলে ধরে রামকে বিদ্রুপ করেছেন তিনি। মধ্যযুগীয় ধারণার তুলনায় তাঁর চিন্তার বিস্তার ছিল অনেক উঁচু তারে বাঁধা। এবং সেই কারণেই তিনি তাঁর সময়ে যথেষ্ট সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছেন। তাঁর লেখার প্রশংসা তো হয়ইনি, উল্টে তা দমন করার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে রামায়ণ ছাড়া আর কোনও মৌলিক রচনার সুযোগ চন্দ্রাবতী দেবী পাননি। ফলে প্রথম মহিলা লেখিকা হিসেবে যাঁর নাম উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠেছে তিনি স্বর্ণকুমারী দেবী। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক এবং সুরস্রষ্টা ছিলেন স্বর্ণকুমারী। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই চতুর্থ কন্যাটির ছোট থেকেই অসম্ভব আকর্ষণ ছিল গান-বাজনা ও সুরের প্রতি। ঠাকুরবাড়িতে সুরচর্চার কোনও অভাবও ছিল না। ফলে নিজস্বতার বিকাশ ঘটানোর প্রচুর সুযোগ পেয়েছিলেন স্বর্ণকুমারী। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দীপনির্বাণ’ প্রকাশিত হয় ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে। তবে অনেকে বলেন, তারও আগে হানা ক্যাথারিন মালেন নামে এক বিদেশিনি বাংলায় একটি উপন্যাস লিখেছিলেন। সেই কারণে স্বর্ণকুমারীর নাম প্রথম মহিলা ঔপন্যাসিকের তালিকায় না রেখে প্রথম বাঙালি মহিলা ঔপন্যাসিকের তালিকায় স্থান পেয়েছে। ঠাকুর পরিবার থেকে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকা ভারতীর সম্পাদকীয় দায়িত্বও বহু বছর সামলেছিলেন স্বর্ণকুমারী। ১৮৯৬ সালে ‘সখী সমিতি’ নামে একটি ক্লাব গঠন করেন তিনি। এই ক্লাবে ঠাকুরবাড়ির অন্য মহিলারাও যুক্ত ছিলেন। ক্লাবটির উদ্দেশ্য ছিল অল্পবয়সি বিধবাদের সাহায্য করা। সমাজে তাদের একটা স্থান তৈরি করা। এই প্রয়াসের জন্য নানা ধরনের চিন্তাভাবনা মিশিয়েছিলেন স্বর্ণকুমারী। অল্পবয়সি বিধবাদের বিভিন্ন রকম প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের স্বনির্ভর করে তুলতে চেয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীতে স্বর্ণকুমারী দেবী কংগ্রেস পার্টির সঙ্গে যুক্ত হয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।