অত্যধিক পরিশ্রমে শারীরিক দুর্বলতা। বাহন বিষয়ে সতর্কতা প্রয়োজন। সন্তানের বিদ্যা-শিক্ষায় অগ্রগতি বিষয়ে সংশয় বৃদ্ধি। আধ্যাত্মিক ... বিশদ
অঞ্জলি রায়। মাধ্যমিক দেবে আর কয়েক মাস পরেই। ছোটবেলা থেকে নাচ ছিল রক্তে। ক্লাস ফোরে পড়ার সময় এল সেই দুঃসময়। হঠাৎ স্কুলে একদিন পড়ে গিয়েছিল সে। তারপর সেই আঘাত থেকে টিউমার হয়ে পরে ক্যান্সার থাবা বসায় পায়ের হাড়ে। সেই পা, যার ওপর দাঁড়িয়ে নাচতে ভালোবাসে মেয়েটা। অসুস্থ হওয়ার পর প্রায় দু’বছরের জন্য তার জীবন থেকে স্বাভাবিক বেঁচে থাকাটা স্রেফ হারিয়ে যায়। ঠাকুরপুকুর ক্যান্সার রিসার্চ সেন্টারে তার চিকিৎসা শুরু হয় ২০১৩ সালে। ২০১৪-য় ছুটি পায় হাসপাতাল থেকে। পা বাদ গিয়েছে তত দিনে। বাড়িতে কিছু মাস বিশ্রামে থেকে ফের তার মোলাকাত হয় নিজের ভালোবাসা, নাচের সঙ্গে।
অতীত ফিরে দেখতে তাকে যখন প্রশ্ন করি, কষ্ট হয়নি? সে মৃদু গলায় শুধু বলে, ‘হ্যাঁ।’ তারপর চুপ। এত বড় একটা ক্ষতি, অঙ্গহানির মতো যন্ত্রণা সয়ে মেয়ে এখন এতটাই কঠিন! আবার বলি তখন মনে হয়নি, কবে আবার নাচতে পারব? কীভাবে পারব? অঞ্জলির জবাব, ‘না এসব কথা মাথাতেই ছিল না। সেরে ওঠার পরে বাড়িতে বসেই একদিন আবার ইচ্ছে হল, নাচ শুরু করার।’
ইচ্ছে তো হল। কিন্ত পারব কেমন করে, সেটা মনে হয়নি? মেয়ে বলে ওঠে, ‘টিভিতে একটা ডান্স শোয়ে একজনকে দেখেছিলাম এক পা নিয়েই নাচছে সাবলীলভাবে। সেটা দেখেই মনে হয়েছিল, আমি কি পারব না?’ বাবা-মাকে বলার পর রোটারি ক্লাবের সঙ্গে কথা হয়। সেখান থেকে শিক্ষক কুন্তল বর্ধন আসেন। নাচ শুরু হয় নতুনভাবে। প্রায় ছ’মাস প্রশিক্ষণের পরে আশুতোষ হলে প্রথম শো করেছিল অঞ্জলি।
এক পায়ে ভারসাম্য রাখাটাই বিরাট চ্যালেঞ্জ, সেখানে নাচ তো আরও জটিল ব্যাপার। কীভাবে প্রশিক্ষণ দিতেন অঞ্জলির নাচের শিক্ষক? ‘প্রথমে স্কিপিং করাতেন। এক পায়ে ঘোরা প্র্যাকটিস করাতেন। এক পায়ে শুধু দাঁড়িয়ে থাকাও অভ্যাস করেছি। এমন করতে করতে ব্যালান্স ক্রমশ চলে আসে। প্রথমে কৃত্রিম পা নিয়ে আমি কীরকম নাচি, সেটা স্যার দেখেছিলেন। তারপর উনি বলেছিলেন, দু’পায়ে নয়, তোমাকে এক পায়েই শেখাব। এভাবেই শুরু হয়েছিল লড়াই।’
পড়াশোনা আর নাচ দুটোই দরকারি, জানে অঞ্জলি। নাচের পাশাপাশি পড়াশোনায় তাই ফাঁকি দেয় না সে। শারীরিক অসুস্থতায় এমনিই দু’বছর নষ্ট হয়েছে তার। বদলাতে হয়েছে স্কুল। এখন মন দিয়ে টেস্ট পরীক্ষা দিচ্ছে সে।
মূলত ক্লাসিকাল ডান্সই করে অঞ্জলি। সঙ্গে যখন যেমন ভালো লাগে, সেই নাচও করে সে। লড়াইয়ের দিনগুলোয় কী মনে হতো? ‘পা বাদ যাওয়ার যন্ত্রণায় একসময় কান্নাকাটি করেছি অনেক। নাচ তো দূর, একটা সময় মনে হতো কিছুই করব না। বাবা-মা সব সময় সাপোর্ট করতেন। আমি ভাবতাম, নিজেকে কখনও হেরে যেতে দেব না। মনে রেখেছিলাম শুধু স্যারের এই কথাটা— চেষ্টা করলে সব হয়, অসম্ভব কিছুই নয়।’
সম্প্রতি অঞ্জলিকে দেখা গিয়েছে ‘বিদ্রোহী’ নামে পাঁচ মিনিটের একটি ভিডিয়োয়। গত ২১ মার্চ ছিল ‘বিশ্ব কবিতা দিবস’। ১৯৯৯ সালের ২১ মার্চকে বিশ্ব কবিতা দিবস ঘোষণা করেছিল ইউনেসকো। এর মাধ্যমে কবিতার প্রচার ও প্রসার, কবিতা যে একক শিল্প নয়, তার সঙ্গে নাচ-গানের পারফরম্যান্সও অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, মনে করেছিল ইউনেসকো। সেই থেকেই কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি নিয়ে কাজ করার ভাবনা মনে আসে বাচিক শিল্পী সাম্য কার্ফার। নজরুল ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি লেখেন ১০০ বছর আগে। ‘বাংলা সাহিত্যে একরকমের মাইলফলক হয়ে যাওয়া কবিতাটি নিয়ে কাজ করা কিছুটা ঝুঁকির ছিল’, বললেন সাম্য। তাঁর কথায়, ‘এই কবিতাটির সঙ্গে যাঁদের নাম জড়িত, সেটা একবার ভাবলেই রোমাঞ্চ হয়। কাজী সব্যসাচীকে তো কেউ ভুলতেই পারবেন না। তারপর আছেন প্রদীপ ঘোষ। নজরুল যখন কবিতাটি এক রাতে লিখে ফেলেছিলেন, উনি তখন ২০ কি ২১। আমিও তরুণ হিসেবেই কবিতাটা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করেছি।’
তার মধ্যে অঞ্জলিকে আনার কথা কীভাবে মনে হল? উত্তরে সাম্য বলেন, ‘একটা লাইন আছে, ‘আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা,/ করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা।’ এই লাইনগুলো যতবার পড়েছি, ততবার অঞ্জলির মুখটা অদ্ভুতভাবে ভেসে উঠেছে। অঞ্জলির সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে। ঠাকুরপুকুর ক্যান্সার রিসার্চ সেন্টারে একটি অনুষ্ঠানে ওর পারফরম্যান্স দেখে কেঁদে ফেলেছিলাম। ওখানে অঞ্জলির মতো অসংখ্য বাচ্চা ছিল। বোন-ক্যান্সারে অঞ্জলির পা বাদ যায়। কৃত্রিম পা নিয়ে ও এখন হাঁটে। কিন্তু নাচের সময় এক পায়েই দাঁড়ায়। নাচার জন্য যতটা উন্নত প্রস্থেটিক লেগ লাগে, তা জোগাড় করার মতো সামর্থ্য নেই ওর বাবা-মায়ের। সুভাষগ্রামে ওদের বাড়ি। বাবা মুদির দোকান চালান। ওর জীবনটা চ্যালেঞ্জের নামান্তর বলা চলে। তাই কবিতাটা পড়তে গিয়ে ওকে মনে পড়েছিল। কারণ সামনে যত চ্যালেঞ্জই আসুক, ও সেগুলোকে ছুড়ে ফেলে এগিয়ে যেতে চায়।’
এমন নানা চ্যালেঞ্জ আসে সকলের জীবনেই। তেমন একজন রূপান্তরকামীর মুখও প্রতিফলিত হয়েছে ওই ভিডিওতে। সমাজ যাঁর সামনে বিছিয়ে রেখেছে বিরাট বাধার পাহাড়। সাম্য বলছেন, কবিতায় তিনি কণ্ঠ দিয়েছেন। বাকিরা শরীরী বিভঙ্গে তাঁদের পারফরম্যান্স দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন কবিতার ভাষা। অঞ্জলি-সাম্যর পাশাপাশি সেখানে রয়েছেন প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অচিন্ত্য প্রান্তর। কোরিওগ্রাফি প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়েরই।
এ ধরনের প্রতিকূলতার মুখে যাঁদের পড়তে হয়, তাঁদের কী বলবে অঞ্জলি? ‘কিছুদিন আগে আর এক কিশোরী, প্রীতির আমার মতোই ক্যান্সারে পা বাদ চলে যায়। তারপর থেকে ও খুবই ভেঙে পড়েছিল। আমি মায়ের সঙ্গে ঠাকুরপুকুরের ওই হাসপাতালে গিয়ে ওকে বোঝাতাম। এখন ও আমার মতো নাচ করে। ডাক্তার-নার্সরা ওকে আমার কথা বলেছিলেন। তারপর ওঁরাই আমাকে বলেন ওকে গিয়ে বোঝাতে। ওকে ভরসা দিতাম, আমি যখন এক পায়ে নাচতে পেরেছি, তুইও পারবি।’
শুধু নিজের ভরসায় এভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে অঞ্জলিরা। ওদের বেঁচে থাকার এটাই যে রসদ!