কবিগুরু প্রভা ও প্রেমের আলোকে অতীন্দ্রিয় অনুভূতি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন কতই না নারী চরিত্র। কঠোরতা ও কোমলতার সংমিশ্রণে তারা আজও উজ্জ্বল। ২২ শ্রাবণ, কবির মৃত্যুবার্ষিকীর প্রাক্কালে তাঁকে তাঁরই সৃষ্টির মাধ্যমে স্মরণ করার সামান্য চেষ্টা করব।
‘গরবিনী’ বীথিকা কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতা। গরবিনী চরিত্র, নাম থেকেই স্পষ্ট, গর্বিত তার আচরণ, চালচলন, বেশভূষায় সবার থেকে পৃথক। ফুলের মতো সুন্দর, কিন্তু তা তার কৃত্রিমতার জন্য সৌন্দর্য হারায়। প্রকৃতিমাতার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই, নেই সত্তার কোমলতম রূপ, অহংয়ের আবরণ দিয়ে ঘেরা কারাগারে তার বন্দিরূপ। কবিগুরু রূপক হিসেবে আর একটি নারী চরিত্র অঙ্কন করেছেন। যার যোগ মাটির সঙ্গে। বলা যেতে পারে ‘আমি তোমারই মাটির কন্যা, জননী বসুন্ধরা’। গরবিনী কাব্যের পংক্তি উল্লেখ করি— ‘কে গো তুমি গরবিনী, সাবধানে থাকো দূরে দূরে/ মর্তধূলি —’ পরে কবি আরও বলেছেন, ‘ঘৃণা বাজে তব নূপুরে নূপুরে।/ বহুমূল্য যবনিকা অন্তরালে, ওগো অভাগিনী নারী, এই ছিল তোমার কপালে/— আপন প্রহরী তুমি, নিজে তুমি আপন বন্ধন।’
কেতকী ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসের একটি মুখ্য চরিত্র। প্রভাবশালী বদমেজাজি আধুনিক নারী চরিত্র হিসেবে কবি অঙ্কন করেছেন। অমিতের সঙ্গে প্রেম বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া ছিল তার সহজাত। আশার অরুণালোকের ছবি উদ্ভাসিত হয় তাদের প্রেমালোকের অন্তরালে। কিন্তু বিদেশ থেকে ফিরে তার বেশভূষা, চলনে নতুন মাত্রা দেখা দেয়। অমিতের পূর্ব প্রেমের বন্ধনে ঘন কালো মেঘ ঘনিয়ে আসে। কেটি (কেতকী) বললে, ‘তুমি জান এই হীরের আংটি যদি হারি, জগতে আমার, সান্ত্বনা থাকবে না। এই আংটি একদিন তুমিই দিয়েছিলে।’
কেতকী আবিষ্কার করেন অমিত নতুন প্রেমে আবদ্ধ হয়েছেন। বলা বাহুল্য তিনি রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়েন। অবচেতন মনের থেকে উৎসারিত আবেগ পারিপার্শ্বিক প্রেক্ষাপটে ঘনীভূত হয়। কথোপকথনে তা স্পষ্ট হয়। ‘আজ সাত বৎসর হয়ে গেল, ... জুন মাসের জ্যোৎস্নায় সমস্ত আকাশ যেন কথা বলে উঠেছিল, মাঠে মাঠে ফুলের প্রচুর বৈচিত্র্যে ধরণী তার ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছে।’
কেতকীর চরিত্রের সঙ্গেই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত আছে লাবণ্য, শেষের কবিতার উপন্যাসেরই প্রতিচ্ছবি। লাবণ্য স্নিগ্ধ, কোমল, নম্র এক চরিত্র, কঠোরতার থেকে উন্নীত হয়েছেন কবি কোমলতায়। কেতকী অমিতের প্রেমবন্ধনকে অভিনন্দিত করে দূরে সরে যান। কী অপরূপ আত্মত্যাগ।
কবির সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে বলতে ইচ্ছে করে যে ভালোবাসা অতীন্দ্রিয়, আকাশে উড়তে থাকে অন্তরে সে দেয় সঙ্গ/ লাবণ্য এমনই এক চরিত্র যেখানে প্রেম প্ল্যাটনিক দুঃখের আঘাতেই তার শিখা প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠে। অমিতের কণ্ঠে তাই ধ্বনিত হয়— ‘বিচ্ছেদের হোমবহ্নি হতে পূজামূর্তি ধরি প্রেম দেখা দিল দুঃখের আলোতে।’
ঊর্বশী নারী চরিত্রের প্রতি কবির পরম শ্রদ্ধার্ঘ্য। নারী অনুপম সৌন্দর্যকে কবি তুলে ধরেছেন। মাতা নয়, বধূ নয়, নয় কন্যা, শুধুই নারী— যার কটাক্ষঘাতে ত্রিভুবন যৌবনচঞ্চল, মধুমত্ত ভৃঙ্গসম মুগ্ধ করে লুব্ধচিতে, তিনি ঊর্বশী। কবির একান্ত প্রশ্ন ‘আদিযুগ পুরাতন এ জগতে ফিরিবে কি আর,/ অতল অকূল হতে সিক্তকেশে উঠিবে আবার?’ কবি চিরবিরহের দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন। তাই আজি ধরাতলে বসন্তের আনন্দ উচ্ছ্বাসে মিশে আছে চির বিরহের সঞ্চিত অশ্রু।
কবিগুরু সৃষ্ট নারী চরিত্রগুলি সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, কঠোর-কোমল, বিরহ-মিলনের সত্তা দিয়ে গাঁথা মালা। বৈপরীত্য ও বৈচিত্র্যের মধ্য দিয়ে তিনি যাত্রা করেছেন সমুখ পানে যা আদিকাল থেকে অনন্ত ভবিষ্যৎ পর্যন্ত বিস্তৃত। তাই তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলি আজও প্রদীপ্ত এবং সমপ্রাসঙ্গিক।
তিন্নি দত্ত