বিদ্যায় অস্থির মানসিকতা থাকবে। কর্মপ্রার্থীদের কোনও শুভ যোগাযোগ হতে পারে। রাগ বা জেদের বশে কারও ... বিশদ
কত স্বাধীন খোলামেলা মিশুকে মেয়েটি। সারা দিনরাত টাচ স্ক্রিনে আলতো আঙুল ছুঁয়ে মনের কথা জানায় সে। মাঝে মধ্যে হয়তো ব্যথায় টনটন করে আঙুল। তবু কী এক অজানা দুর্নিবার আকর্ষণে মাতে মেয়েটি। নিজের বিজ্ঞাপন নিজেই বানায়। ফ্রি-তে পাত্রীর বিজ্ঞাপন। নিজের পছন্দ নিজেই করবে। ব্যক্তি স্বাধীনতার উজ্জ্বল প্রতীক যেন ফেসবুকের মেয়েটি। বাবা-মা’র ঘাড় থেকে পাত্র জোটানোর জগদ্দল পাথর যেন নামল আজ। মেয়েটি অবশেষে প্রোফাইল বানায়। নাম, ঠিকানা, বয়স, শিক্ষাগত যোগ্যতা, পছন্দ-অপছন্দ ইত্যাদি ইত্যাদি। খুব সন্তর্পণে দেবারিগণ, সঙ্গীতজ্ঞা, শ্যামবর্ণা, গৃহকর্মনিপুণা প্রভৃতি উনিশ শতকীয় ব্যাকডেটেড শব্দগুলি বাদ দেয়। আর ছবির ক্ষেত্রে? কেয়া শেঠের বা শেহনাজের বিউটি পার্লার থেকে মেক-আপ নিয়ে ছবিটা পোস্ট করার সঙ্গে সঙ্গে ফ্রেন্ডস লিস্টে দেড় হাজার লাইক আর দু’হাজার ফলোয়ার। ফেসবুকের মেয়ের হু হু করে দাম বাড়ছে পাত্র-পাত্রীর বাজারে।
বন্ধুত্বের দুনিয়ায় মেয়েটি যেন এক সুন্দরী অপ্সরা। এসবই ফেসবুকের অবদান। কারও সরাসরি হাতের ছোঁয়ায় সে অপবিত্র হয়নি এখনও। ডিজিটাল স্পর্শে সত্যি সত্যি হয় কি? মেয়েটি নিজেকে বাঁচাতে জানে বন্ধুত্বের কুশলী অভিনয়ে, ফাঁদ পাতে ভালোবাসার। মোবাইলে ফোন করলে হয় কোনও পাতানো দাদা বা আঙ্কেল ধরে। প্রথমবার আলাপে তার সাফ কথা— আগে আমার রিচার্জ কর, তারপর যা কিছু কথা। ডেটিং চাইলে, মিটিং করে অন্য কেউ। এভাবেই চলছে মেয়েটির অন্য ভূমিকায় অভিনয়। পুরুষেরা অন্ধের মতো সুদর্শন পোকার মতো পাক খায় তার তিলোত্তমা আগুনের চারপাশে। বিবাহিত পুরুষেরাও বাদ যায় না তার অগ্নিগর্ভ আঁচ থেকে। জ্বলন্ত আগুনের খিদে নিয়ে যেন জন্মেছে ফেসবুকের মেয়েটি। জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খাক করে দিতে চায় লোভী কামুক ধর্ষক পুরুষজাতিকে।
প্রতিবাদেও সে কখনও ‘স্ত্রীর পত্র’-র মৃণালিনী কখনও বা ‘চোখের বালি’-র বিনোদিনী। আজ দেশজুড়ে যে অসহিষ্ণুতা, সাম্প্রদায়িক হিংসা তাতেও শামিল সে। ‘কমেন্ট’ পাঠানোর মাধ্যমে মতামত প্রকাশ করতে পারছে স্বাধীনভাবে। প্রতিবাদের ভাষা প্রকাশ করতে পারছে স্বাধীনভাবে। প্রতিবাদের ভাষা নতুনভাবে ফুটে উঠছে মোবাইলের ডিজিটাল পর্দায়। নয়নতারা সেহগাল, অরুন্ধতী রায়, মন্দাক্রান্তা সেন-এর মতো সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট ব্যবহার করে আজ ছড়িয়ে দিতে পারছে নিজের মতামত, প্রতিবাদের নেটওয়ার্ক তৈরি হচ্ছে। ‘মি টু’, ‘কাস্টিং কাউচ’ নিয়ে সরব হচ্ছে। এক দশক আগেও ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটস অ্যাপের মতো সোশ্যাল সাইটগুলোর এত রমরমা, জনপ্রিয়তা ছিল না। বিশেষত মেয়েদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সম্পর্ক তৈরি করার ক্ষেত্র তেমন প্রসারিত ছিল না। আজ ফেসবুকের মাধ্যমে ফ্রেন্ডলিস্টের সংখ্যা বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা চলছে, স্বাধীনভাবে মনের মানুষ খুঁজে পাওয়ার এবং পুরনো সম্পর্ক ভেঙে নতুন সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা চলছে। একলা নারী, অসুখী বিবাহ বিচ্ছিন্নারাও সামিল।
গোঁড়াপন্থী কিছু মানুষ হয়তো ফেসবুকের মেয়ের স্বেচ্ছাচারিতা মনে করে নাক কোঁচকাবেন। নানারকম সামাজিক বাধা-নিষেধ, সংস্কারের ফাঁদে ফেলে তার বদনাম করার চেষ্টা করবেন। উনিশ-বিশ সব যুগেই এঁরা কিছু না কিছু ছিলেন বা থাকবেনও, তা বলে কি রবীন্দ্রনাথের বিদ্রোহিনী মানসকন্যাদের যেমন— মৃণালিনী, কাদম্বিনী, বিনোদিনী, কুমুদিনীদের সম্মানহানি হয়েছে কখনও সেভাবে, দুশ্চরিত্রা বলে তাদের সমাজচ্যুত করা হয়েছে? আজও তাদের নিয়ে চর্চা হয়, নারী চরিত্রের দুঃসাহসিকতা নিয়ে আলোচনা হয়। আসলে ফেসবুকের মেয়ে যেন সম্পর্কের এক নতুন সমীকরণ তৈরি করছে। তার মতো করে, তার দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার চোখ খুলে দিয়েছে। আর আমরাও তার সঙ্গে মিলে নিজেদের কৌতূহল মেটাচ্ছি সারাক্ষণ।
সুমিত তালুকদার