পুরনো সঞ্চয় ও শেয়ার প্রভৃতি ক্ষেত্র থেকে অর্থ লাভের যোগ প্রবল। মানসিক অস্থিরতা থাকবে। সন্তানের ... বিশদ
সলতে পাকানো হয়েছে ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের পর। তেভাগা আন্দোলন ছিল তার প্রমাণ। ১৯৫৬ সালে ক্ষোভ প্রবল হয়ে ওঠে রেশন বণ্টন ব্যবস্থার অপ্রতুলতা এবং দুর্নীতি নিয়ে। ১৯৫০ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত সবথেকে বড় সঙ্কট ছিল জনসংখ্যার চাপ। উদ্বাস্তু আগমন যার অন্যতম কারণ।
চরম সঙ্কট এল ১৯৫৯ সালে। ৩০ টাকা প্রতি মন চালের দাম। কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (তখনও অখণ্ড) একটি কমিটি গঠন করেছিল। প্রাইস রাইজ অ্যান্ড ফেমিন রেজিস্ট্যান্স কমিটি। বিধানসভায় দলীয় বিক্ষোভের পাশাপাশি এই কমিটি রাস্তায় নেমে আন্দোলনের ডাক দেয়। ১৯৫৯ সালের ৩১ আগস্ট থেকে ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই ৫ দিন চরম নৈরাজ্যের এক চিত্রের সাক্ষী ছিল বাংলা। একদিকে হিংসাত্মক আন্দোলন। আইনশৃঙ্খলা ভেঙে দেওয়া। আর অন্যদিকে সরকারের কড়া হাতে দমন। গুলি চালানো। লাঠিচার্জ। গ্রেপ্তার। অন্তত ৮০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। তিন হাজারের বেশি আহত। গুলিচালনায় যেমন সমালোচনায় ঝড় উঠেছিল, ঠিক তেমনই সাধারণ মানুষের কঠোর নিন্দা আছড়ে পড়েছিল সিপিআইয়ের ওই চরম নৈরাজ্য সৃষ্টি করে জনজীবনকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়ার কারণে। সুতরাং ভোটের রাজনীতিতে ফল পাওয়া যায়নি।
১৯৬৬ সালে চালের দাম কেজি প্রতি ৬ টাকাতে পৌঁছে যায়। কেরোসিনও পাওয়া যাচ্ছিল না। প্রফুল্ল সেন ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছিলেন খাদ্যাভ্যাস বদলে ফেলতে। ভাতের বদলে রুটি। আলুর বদলে কাঁচকলা। বসিরহাটের স্বরূপনগরে নিত্যপণ্যের দামবৃদ্ধি এবং কেরোসিনের অভাবের প্রতিবাদে যে বিক্ষোভ হয়, সেখানে পুলিস গুলি চালায়। ১৫ বছরের স্কুল ছাত্র নুরুল ইসলামের মৃত্যু হল। তার সহপাঠী মনীন্দ্র বিশ্বাস আহত হল। গোটা বাংলায় দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে সেই খবর। এবং সর্বত্র শুরু হয় আন্দোলন। ১৯৬৭ সালে কংগ্রেস সরকার গরিষ্ঠতা পেল না ভোটে। সরকারের পতন ঘটে। এসেছিল যুক্তফ্রন্ট সরকার।
এরপর ৩৯ বছর কেটে গিয়েছে। খাদ্যাভাবের প্রকট চিত্র প্রথম সংবাদ শিরোনামে নিয়ে এল আমলাশোল। পশ্চিম মেদিনীপুরের সেই গ্রামে লোধা ও শবর প্রজাতির অন্তত ১০জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে অনাহারে। খাদ্য না পেয়ে। ২০০৫ সালে। তুমুল শোরগোল হয়। ২০০৭ সালে সেপ্টেম্বর মাসে বাঁকুড়ার ইন্দাস থেকে সোনামুখীতে মানুষের বিক্ষোভ টের পাওয়া গেল। রেশনে চাল-ডাল দেওয়া হচ্ছে না। কেন? বলা হচ্ছে সাপ্লাই নেই। ঘেরাও করল ৩ হাজার গ্রামবাসী রেশন ডিলারকে। পুঞ্জীভূত ক্ষোভ বিস্ফোরণের মতো উদ্গীরণ করল একের পর এক বিক্ষোভ। জেলার পর জেলা, ব্লকের পর ব্লক। রেশন ডিলারদের ঘেরাও, মারধর, আগুন, রেশন দোকান পুড়িয়ে দেওয়া চলল। বর্ধমানের কেতুগ্রামে পুলিসের গুলিতে আন্দোলনরত খেতমজুর শ্রমিক ধানু দাসের (৩২) মৃত্যু হল। গুলি চলল বাঁকুড়াতেও। জানা গিয়েছিল এক বিপুল রেশন দুর্নীতির কথা রাজ্যজুড়ে। এপিএল, বিপিএলের চাল চলে যাচ্ছে রাইস মিলে। যাচ্ছে বাজারে। গরিবকে চাল না দিয়ে সেই চাল বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছিল খোলাবাজারে ব্যবসায়ীদের কাছে। সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত কমিশনের মাধ্যমে জানা গেল ৩৫ শতাংশ রেশনের চাল বাজারে চলে যায়। গ্রামীণ বাংলার সেই প্রথম বামেদের প্রতি ক্ষোভের সূত্রপাত।
এই সঙ্গেই বামফ্রন্ট সরকার কখনও সিঙ্গুরে টাটা গোষ্ঠীকে, কখনও নন্দীগ্রামে সালেম গোষ্ঠীকে অগাধ কৃষি জমি দেওয়ার জোরদার উদ্যোগ নিচ্ছিল। নিজেদের ধর্মচ্যুত হয়ে সিপিএম কৃষকবিরোধী অবস্থানে চলে গেল। কৃষিজমি কেড়ে নেওয়ার পক্ষে সিপিএম। ভাবা যায়? এই সুযোগ তিনি ছাড়বেন কেন? অতএব শুরু হল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক আন্দোলন। সরকারের সেই একই ভুল। গুলি, লাঠিচার্জ, মূত্যু। ২০০৭ সালের এই দুই আন্দোলনের পর থেকেই বামফ্রন্ট সরকারের জনপ্রিয়তা কমতে থাকে ঝড়ের মতো। একের পর এক ভোটে তারা পরাস্ত হয়। ২০১১ সালে ক্ষমতাই চলে যায়।
এরপর কেটে গিয়েছে ১২ বছর। লক্ষ করা
যাচ্ছে, এই ১২ বছরে সাফল্যের মাপকাঠিতে সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে এমন ফারাক তৈরি হয়েছে যা
৭৭ বছরে বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে আসেনি। এরকম দিশাহারা এবং অপরিকল্পিত বিরোধী শিবির বাংলায় কখনও আসেনি। পক্ষান্তরে বিভিন্ন সঙ্কটে সরকারপক্ষ সুপরিকল্পিত প্ল্যান, অসীম ধৈর্য এবং নিখুঁত স্ট্র্যাটেজি নিয়ে সঙ্কটমুক্ত হয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, বিপুলভাবে নিজের ভোটব্যাঙ্ক এবং প্রভাবকে আরও শক্তিশালী করছে।
এমন নয় যে, সরকার কোনও ভুল করছে না। অথবা দুর্নীতি কিংবা অনিয়ম নেই। বরং একঝাঁক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু সরকারের বিরুদ্ধে হাজির হলেও এই রাজ্যের বিরোধীরা প্রতিটি ইস্যুকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে, যেভাবে অপরিণতমনস্কতা দেখিয়েছে সেটা অবিশ্বাস্য! এখনও পর্যন্ত একটিও ইস্যুকে সামনে রেখে বিরোধীরা পাখির চোখ করে এগয়নি। ফোকাস নিবদ্ধ রাখেনি। এবং নিজেদের আন্দোলনকে নিজেরাই নষ্ট করেছে।
বিরোধীদের মধ্যে বিজেপি যেহেতু সংসদীয় মাপকাঠিতে ও ভোটব্যাঙ্কের ক্ষেত্রে বেশি শক্তিশালী, তাদের দায় সবথেকে বেশি। কিন্তু তাদের সবথেকে বড় দুর্বলতা হল, দিল্লি নির্ভরতা। দিল্লি থেকে টাকা আসে। দিল্লি থেকে নির্দেশ আসে। দিল্লি থেকে স্ট্র্যাটেজি আসে। দিল্লি থেকে কেন্দ্রীয় এজেন্সি আসে। অথচ যারা দিল্লি থেকে নির্দেশ দেয় অথবা এজেন্সি পাঠায় তারা বাংলাকে চেনেই না। বারংবার প্রমাণ হয়। তাই একটি ভোটের পর অন্য ভোট পর্যন্ত এই একই ধারা চলে। ব্যর্থতাও বেড়ে চলে। ।
বামফ্রন্টের ভোটাররা বিগত ১২ বছর ধরে ক্রমেই বিজেপির দিকে চলে এসেছে। ১৯৯৮ সালে কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নতুন দল গঠন করার পর কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্ক এবং প্রভাব নগণ্য। কংগ্রেস তাই কখনও তৃণমূলের সঙ্গে জোট করে। কখনও বামফ্রন্টের সঙ্গে জোট করে। কখনও একলা চলে। কিন্তু তাদের উত্থান কিংবা ঘুরে দাঁড়ানো আর হয়নি।
বামেদের দুর্ভাগ্য অথবা ব্যর্থতা হল, তাদের সমর্থকদের বড় অংশই সারা বছর সিপিএম, একমাত্র ভোটের দিন ছাড়া। তাদের নিয়ম হল, বামেদের ডাকা ব্রিগেডে গিয়ে ভোটের দিন বিজেপিকে ভোট দেওয়া। সিপিএম যে আর কোনওদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারাতে পারবে, এটা এখন আর বাম সমর্থকরাও বিশ্বাস করে না।
সিপিএম স্বধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়েছে। সিপিএমের একঝাঁক নতুন নেতা-নেত্রী উঠে এসেছেন। তাঁদের নিয়ে সিপিএম অত্যন্ত উৎসাহিত। তাঁরা যখন পরাস্ত হন তখন সিপিএম দুঃখিত হয়। এই শহুরে মিডল ক্লাস অথবা শিক্ষিত এলিট নেতা-নেত্রীদের যতটা সিপিএম প্রমোট করে মিডিয়া কিংবা সভা সমাবেশে, সেই তুলনায় তাদের নিজেদের যা ছিল একসময় সবথেকে বড় শক্তি, সেই গ্রামীণ নেতা-নেত্রীর নাম শোনা যায় না। সাধারণ মানুষ এখন আর জানে না যে, সিপিএমের নামজাদা শ্রমিক নেতা কে? কৃষক নেতা কে? দলিত নেতাই বা কে? নেই।
যাঁরা নতুন উঠে এসেছেন এবং ক্রমেই সিপিএমের মুখ হয়ে উঠছেন তাঁরা আরবান আপার ক্লাস ও আপার কাস্ট নেতা-নেত্রী। তাঁদের সঙ্গে গ্রাম ও সাবঅলর্টানের সম্পর্ক নেই। তাঁরা গ্রামে যান সভা সমাবেশ করতে সেলেব্রিটি নেতা-নেত্রী হিসেবে। গ্রাম থেকে উঠে আসছেন না কেউ। এর কারণ হল, সিপিএম এখন আরবান মিডল ক্লাসকেই নিজের চালিকাশক্তি ও সমর্থক হিসেবে পছন্দ করে ও সন্তুষ্ট। মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়াকেই তারা সত্যি পৃথিবী ভেবে নিয়েছে।
দু পয়সা ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন কিংবা অতি সাম্প্রতিক আর জি কর কাণ্ডের আন্দোলন ছিল শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সরাসরি বাংলার সব স্তরকে স্পর্শ করেনি আর্থ সামাজিক সাংস্কৃতিক নানাবিধ কারণে। সেই কারণে সেগুলি জনমন থেকে দ্রুত বিস্মৃত হয়ে গিয়েছে ও যাচ্ছে। ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধি ছিল সরাসরি রাজনৈতিক আন্দোলন। কিন্তু আর জি কর কাণ্ডের আন্দোলন আরবান এলিট ও মিডল ক্লাসের আন্দোলন। এসব কারণেই সন্দেহ তৈরি হয় আদৌ কি এই বিরোধীদের ইস্যু তৈরি করা, সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন তৈরি করে সেটাকে জনগণের আন্দোলনে পরিণত করার কোনও যোগ্যতা বা পারদর্শিতা আছে? সম্ভবত নেই। কেন? কারণ সরকার ও বিরোধীদের ভূমিকা পাল্টে গিয়েছে।
অতীতে দেখা গিয়েছে যতটা বিরোধীরা আগ্রাসীভাবে আন্দোলনে নেমেছে, ততটাই সরকার কঠোর হস্তে সেই বিক্ষোভ দমন করেছে। অনড় অবস্থান নিয়েছে। গুলি চালিয়েছে। ফলে আরও বেশি হাতের বাইরে চলে গিয়েছে নিয়ন্ত্রণ। বর্তমান রাজ্য সরকারের পুলিস আজ পর্যন্ত ১২ বছরে গুলি চালায়নি বিরোধীদের আন্দোলনে। বিক্ষোভ হলেই আলোচনায় বসে। একবার নয়। বারংবার। বিরোধিতা যতটা গরম। সরকার যেন ততই নরম। বিরোধীরা ফ্রন্টফুটে। সরকার যেন ব্যাকফুটে। এসবই কিন্তু স্ট্র্যাটেজির অঙ্গ। অর্থাৎ জনতাকে বার্তা দেওয়া যে এই দেখুন সরকার কোনও বিরোধ চায় না। সরকার আলোচনা চায়। সরকার সমাধান চায়, সরকারের ইগো নেই। অপমান অসম্মান করলেও সরকার মেনে নেবে সব শান্তির স্বার্থে, ইত্যাদি ইত্যাদি। বিরোধীরা সেটাকে নিজেদের জয় ভাবে। স্লোগান দেয় ‘ভয় পেয়েছে হাওয়াই চটি’। তারপর ভোটে হেরে যায়।
এত সরকার বিরোধী ইস্যু আসছে এবং চলে যাচ্ছে। অথচ শুধু ভোটে নয়, বিরোধীরা স্ট্র্যাটেজিতেও হেরে যাচ্ছে কেন?