শ্লেষ্মা ও বাতজ রোগ বৃদ্ধিতে কাজকর্মে ব্যাঘাত। গৃহাদি নির্মাণ বা সংস্কারে শত্রুর বাধা। ধর্মে মতি। ... বিশদ
স্কন্দ পুরাণে উল্লেখ আছে, মন্দির প্রতিষ্ঠার পর দারুব্রহ্ম প্রভু জগন্নাথদেব মহারাজ শ্রীইন্দ্রদুম্নকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘আষাঢ মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে সুভদ্রার সহিত আমাকে ও শ্রীবলরামকে রথে আরোহণ করাইয়া নবযাত্রা—উৎসব সম্পন্ন করিবে। যে স্থানে আমি আবির্ভূত হইয়াছিলাম এবং যে স্থানে তোমার সহস্র অশ্বমেধ—যজ্ঞের মহাবেদি বর্তমান, সেই শ্রীগুণ্ডিচা মন্দিরে আমাকে লইয়া যাইবে।’
প্রতিবছর মাঘ মাসের বসন্ত পঞ্চমী তিথিতে তিনটি রথ তৈরির জন্য কাঠ সংগ্রহ শুরু হয়। আর রথ নির্মাণের কাজ আরম্ভ হয় সত্যযুগাদ্যা অক্ষয়তৃতীয়া হতে। শ্রীমন্দির থেকে জগবন্ধু জগন্নাথদেবকে এনে যে সুদৃশ্য রথে আরোহণ করানো হয়, সেই রথের নাম ‘নন্দীঘোষ’। রথের চূড়ায় গরুড়দেব অধিষ্ঠান করেন বলে এটি ‘গরুড়ধ্বজ’ নামে কথিত। শ্রীবলরামের রথের শীর্ষদেশে তালচিহ্ন আছে বলে তার নাম ‘তালধ্বজ’। আর সুভদ্রাদেবীর রথকে বলা হয় ‘দেবদলন’ বা ‘পদ্মধ্বজ’। বামনরূপী জগন্নাথের রথ রংবাহারি পীতবর্ণের, সুভদ্রাদেবীর রথ শ্যামাঙ্গ আর বলরামের রথ নীলিমাময়। শ্রীজগন্নাথদেবের রথের রক্ষক শ্রীনৃসিংহদেব। সারথির নাম মাতলি। শ্রীবলদেবের রথের রক্ষক শেষাবতার। সারথি সুদুমন। সুভদ্রাদেবীর রথের রক্ষক বনদুর্গা আর সারথি অর্জুন।
রথে আরোহণ করার জন্য তিনজন দেবতার যাত্রা ‘পহণ্ডি’ বা ‘পাণ্ডুবিজয়’ নামে খ্যাত। বিগ্রহগণের পৃথক পৃথক তিনটি রথের ওপরে ওঠার পর প্রাচীন প্রথা অনুসারে গজপতি মহারাজা সোনার ঝাড়ু দিয়ে রথ পরিষ্কার করেন। এই সেবাকে ‘ছেরাপহরা’ বলে। এরপর বিগ্রহগুলিকে নানা বস্ত্র ও অলঙ্কারে সুসজ্জিত করে বিবিধ উপচারে পুজো ও ভোগ নিবেদনান্তে শুরু হয় উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদী রথের পথচলা। আগত লক্ষ কোটি মানুষের রথকে ঘিরে বিপুল উন্মাদনা ও আনন্দধ্বনির মধ্যে সুসজ্জিত রথ তিনটি সন্ধ্যার সময় গুণ্ডিচা মন্দির বা মাসির বাড়ির সামনে পৌঁছে যায়। আটদিন পর আবার রথে চড়ে জগন্নাথদেব মন্দিরের উদ্দেশে রওনা দেন। তাকে বাহুড়া বা উল্টোরথ বলে। একাদশীর দিন শ্রীজগন্নাথদেব সহ তিন বিগ্রহ রাজবেশে প্রভূত অলঙ্কারে ভূষিত হয়ে ভক্তদের দর্শন দেন। তাছাড়া বারো বছর বা উনিশ বছর পর নিয়মানুযায়ী হয় দারুময় নীলাচল নাথের ‘নবকলেবর’। সমগ্র ভারত ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত রথযাত্রা উৎসব পুরীর মহিমান্বিত ধারারই অনুবর্তন।
২) আমরা দেখতে পাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেবের মহাজীবনের ছয় বছর ব্যাপী প্রব্রজ্যা বাদ দিলে শেষ আঠারোটি বছর কেটেছে এই নীলাচলে শ্রীজগন্নাথদেবের সান্নিধ্যে। উল্লেখ্য, মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব স্বয়ং শ্রীক্ষেত্রের মহিমা বিশেষভাবে উপলব্ধি করে নিত্য জগন্নাথ দর্শন, গুণ্ডিচা মার্জন, ওড়িয়া—গৌড়ীয় ভক্তগণ সহ রথাগ্রে নৃত্য ও কীর্তনাদি এবং অলৌকিক লীলার মাধ্যমে শ্রীজগন্নাথদেবের মাহাত্ম্যকে অনাদিকালের জন্য উজ্জ্বলতম রূপে প্রতিষ্ঠিত করে গিয়েছেন। রথের সামনে শ্রীচৈতন্যের নৃত্যগীত সেই সময় ছিল রথোৎসবের সবচেয়ে বড় আকর্ষক। রথাগ্রে গৌরবাসী ভক্তগণকে মহাকীর্তনের সুবিধার জন্য মহাপ্রভু সাত ভাগে ভাগ করে দিলেন। সাত সম্প্রদায়ের কীর্তনের ঝংকারে আকাশ বাতাস উত্তাল হয়ে উঠল। শ্রীচৈতন্যদেব এই সময় ঐশী শক্তির বিকাশ ঘটালেন। সাতটি সম্প্রদায়ের ভক্তগণ দেখছেন ভাবোন্মত্ত মহাপ্রভু তাদের সঙ্গেই চলেছেন পথে কীর্তন নৃত্যে। ‘আর এক শক্তি প্রভু করিলা প্রকাশ। এককালে সাত যাই করেন বিলাস।’ চৈ. চ.। রথের সম্মুখে কীর্তনানন্দে বিভোর হয়ে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য করজোড়ে জগন্নাথের দিকে নত হয়ে স্তুতিগান করে আত্মনিবেদন করলেন তাঁর স্বরচিত শ্লোক পাঠ করে। একবছর রথ কখনও দ্রুত, কখনও ধীরে চলে, আবার কখনও স্থির হয়ে থাকে। রথের দড়িতে জোরে টান দেওয়া হল। বলরাম ও সুভদ্রাদেবীর রথও চলে গেল। সকলের শত চেষ্টাতে ও জগন্নাথের রথ অচল অটল হয়ে থাকল। বড় বড় হাতি এনে রথে জুড়ে দেওয়া হল। অবাক কাণ্ড, তবুও রথ টানবার চেষ্টা একেবারে ব্যর্থ হল। চারদিকে হাহাকার ধ্বনি উঠল। সকলেই কাঁদতে লাগলেন। তা শুনে মহাপ্রভু সদলবলে সেখানে ছুটে এলেন। সমস্ত হাতিকে সরিয়ে দিয়ে রথের রজ্জু ভক্তগণের হাতে দিয়ে স্বয়ং রথের পিছনে গিয়ে নিজের মাথা দিয়ে ঠেলতে লাগলেন। এবার রথ ঘর্ঘর শব্দে এগতে লাগল। তখন বিশাল জনতা জয় জগন্নাথ, জয় গৌরচন্দ্র রবে জয় ঘোষণা করে আনন্দে উৎফুল্ল হলেন।
মহাপ্রভুর পর পরমপুরুষ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব। জগন্নাথের রথের সম্মুখে তিনি সগণে নৃত্য ও কীর্তনে রত। তবে পুরী নয় কলকাতা। ঠাকুরের লীলাসঙ্গী বলরাম বসুর বাড়িতে শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের নিত্য সেবা হতো। রথযাত্রার আগের দিন পরমহংসদেব আসতেন দক্ষিণেশ্বর থেকে বাগবাজারে ভক্ত বলরাম বসুর বাড়িতে। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতকার রথযাত্রার বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন: ‘অপরাহ্ণ হইয়াছে। ইতিমধ্যে বারান্দায় শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের সেই ছোট রথখানি ধ্বজা পতাকা দিয়া সুসজ্জিত করিয়া আনা হইয়াছে। শ্রীশ্রীজগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলরাম চন্দনচর্চিত বসনভূষণ ও পুষ্পমালা দ্বারা সুশোভিত হইয়াছেন। ঠাকুর বেনোয়ারীর কীর্তন ফেলিয়া বারান্দার রথাগ্রে গমন করিলেন, ভক্তেরাও সঙ্গে সঙ্গে চলিলেন। ঠাকুর রথের রজ্জু ধরিয়া একটু টানিলেন—তৎপরে রথাগ্রে ভক্তসঙ্গে নৃত্য ও কীর্তন করিলেন।’ ভক্তবৎসল জগন্নাথের কাছে প্রার্থনা জানিয়ে অবতার শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, ‘জগন্নাথ! জগবন্ধু! দীনবন্ধু! আমি তো জগৎ ছাড়া নই নাথ, আমায় দয়া কর।’ ঠাকুরের সেই লীলাকে স্মরণ করে আজ ও শত শত ভক্ত বলরাম মন্দিরে এসে রথের রশি স্পর্শ করে ধন্য হন। শ্রীরামকৃষ্ণদেব কিন্তু কখনও পুরীধামে এসে জগন্নাথ দর্শন করেননি। তিনি অনেকবার বলেছেন, ‘আমিই পুরীর জগন্নাথ। পুরীতে আমার যাবার যো নেই। সেখানে গেলে আমার শরীর ত্যাগ হবে।’
‘রথে চ বামনং দৃষ্টা পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে।’—রথে বামনরূপী ভগবানকে দর্শন করলে মানুষের আর পুনর্জন্ম হয় না। এখানে বামনের অর্থ বেঁটে নয়। আষাঢ মাসে ভগবান বিষ্ণুর নাম ‘বামন’। আমাদের প্রত্যেক শরীর রূপ রথে পরমাত্মা রথীরূপে বিরাজ করছেন। তাঁকে যাঁরা সাধনার দ্বারা দর্শন করবেন তাঁরাই মায়ার বন্ধন হতে নিষ্কৃতি লাভ করবেন। কঠশ্রুতিতে পাই এর সুন্দর বর্ণনা। ‘আত্মানং রথিনং বিদ্ধি শরীরং রথমেব তু’ ইত্যাদি। অর্থাৎ শরীরকে রথ, বুদ্ধিকে সারথি ও মনকে রথের লাগাম বলে জানবে। ইন্দ্রিয়গণ শরীর রূপ রথের অশ্ব। আর মন অশ্ব পরিচালক বলগা। এই চিরন্তন সূক্ষ্ম আদর্শকে যাতে সর্বজনের দুয়ারে পৌঁছে দেওয়া যায় তার জন্য আচার্যগণ এই বৈদিক তত্ত্বকে জগন্নাথের রথযাত্রায় রূপায়িত করে সকলের বোধগম্য করে দিয়েছেন। এই শাস্ত্রবাক্যের বারবার অনুশীলন করে শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবকে আকর্ষণ করাই রথযাত্রার এই বিপুল আয়োজনের উদ্দেশ্য।