শ্লেষ্মা ও বাতজ রোগ বৃদ্ধিতে কাজকর্মে ব্যাঘাত। গৃহাদি নির্মাণ বা সংস্কারে শত্রুর বাধা। ধর্মে মতি। ... বিশদ
উনিশের তুলনায় চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনে অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহরা এরাজ্যে তৃণমূলকে কোনও নম্বরই দিতে চাননি। অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম, এমনকী ‘দিদিকে বলো’র স্রষ্টা প্রশান্ত কিশোর পর্যন্ত আসন সংখ্যার বিচারে তৃণমূলের চেয়েও বিজেপিকে এগিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু সবকিছুকে মিথ্যে প্রমাণ করে দিয়ে মমতা তাঁর দলের আসন গতবারের চেয়ে অনেকটাই বড়িয়ে নিয়েছেন।
নরেন্দ্র মোদি চারশো আসন পার করার হুঙ্কার ছেড়ে আটকে গিয়েছেন তিনশোর আগেই। ‘শরিকী ক্র্যাচে’ ভর দিয়ে সরকার চালাচ্ছেন। তাতেও হম্বিতম্বি কমেনি। তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চাইলেই তাঁর দলের এই জয়কে অনেক বড় করে মেলে ধরতে পারতেন। তিনি বলতেই পারতেন, টানা তিনবার ক্ষমতায় থাকার পরেও ‘অ্যান্টি ইনকামবেন্সি ফ্যাক্টর’ কাজ করেনি। উল্টে কেন্দ্রের বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দৃঢ় করতে তৃণমূলের হাত আরও শক্ত করেছে বাংলা। কিন্তু তা তিনি করেননি। তিনি আত্মতুষ্টিতে ভুগতে চাননি। উল্টে হেঁটেছেন আত্মসমালোচনার পথে। তাতে ঘর ছোট হলেও ভিতটা হবে মজবুত।
নির্বাচনী ফল বিশ্লেষণ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেখেছেন, দেশের সরকার গড়ার ভোটেও বাংলা যেভাবে সমর্থন জুগিয়েছে তাতে ছাব্বিশে ক্ষমতায় ফেরা নিয়ে তাঁর অন্তত কোনও সংশয় নেই। কিন্তু গ্রামের মানুষ দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করলেও শহরে তা হয়নি। রাজ্যের ১২১টি পুরসভার অর্ধেকেরও কিছু বেশি এলাকায় তৃণমূল পিছিয়ে। একমাত্র ‘কৃষকবন্ধু’ ছাড়া রাজ্য সরকারের সমস্ত প্রকল্পই গ্রামের ও শহরের মানুষ পেয়ে থাকে। অন্যদিকে, কেন্দ্রীয় সরকার শহুরে মানুষ উপকৃত হবে, এমন কিছু করেনি। তাহলে কীসের জন্য গ্রাম ও শহরের এই ফারাক?
পুরসভার মেয়র ও চেয়ারম্যানদের সভায় মুখ্যমন্ত্রী সেই সমস্ত কারণ তুলে ধরেছেন। সেদিন যে তিনি তথ্য নিয়ে তৈরি হয়েই বসেছিলেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাঁর সাফ কথা, রাজ্য সরকার নাগরিকদের যে পরিষেবা দিতে চাইছে, তা মানুষ পাচ্ছে না।
উল্টে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে দলের বহু নেতা ও কিছু সরকারি অফিসার ফুলেফেঁপে উঠেছেন। কার কোথায় ত্রুটি, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। যাকে বলে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছেন।
অনেকে বলছেন, সেদিনের সভায় অগ্নিকন্যা অগ্নিবর্ষণ করেছেন। ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে জনসেবার নাম করে যারা আখের গোছাচ্ছে, তারাই মুখ্যমন্ত্রীর টার্গেট। মোদ্দা কথায়, যারা দু’হাতে টাকা লুটছে। সেইজন্যই তিনি বলেছেন, ‘টাকা তোলার মাস্টার চাই না। জনসেবক চাই। কাজ না করলে ছুড়ে ফেলে দেব।’ তিনি আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন, ‘আমাদের মধ্যে থেকেও অনেকে বিজেপিকে টাকা দিচ্ছে।’
কেন তিনি একথা বললেন? নির্বাচন এলেই ‘হাওয়া মোরগ’রা দল বদল করে। আর কিছু ‘মোরগ’ আরও চালাক। তারা ঝুঁকি না নিয়ে পাঁচিলে উঠে বসে থাকে। তলায় তলায় বিরোধী শিবিরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। কেউ কেউ কেন্দ্রীয় এজেন্সির হুজ্জুতি এড়াতে যথাস্থানে ‘প্রণামী’ও দেয়। সেই তালিকায় আছে তাঁরই দলের কিছু নেতা। অফিসাররা প্রণামী দেন না, তাঁরা দেখান আনুগত্য। তাঁরা বোঝাতে চান, আমি তোমাদেরই লোক। কিন্তু ঠেকায় পড়ে সব মুখ বুজে সহ্য করছি। রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে সেই খবর মুখ্যমন্ত্রীর কাছে থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি এই সমস্ত কথা গোপনে না বলে প্রকাশ্যে আনলেন কেন?
ইতিহাস বলছে, তৃণমূলে থেকে করেকম্মে খাওয়া লোকজন বিজেপিতে গেলেও তার কৃতকর্মের বোঝা বইতে হয় পুরনো দলকেই। মানুষের ক্ষোভ সেই ব্যক্তির বদলে গিয়ে পড়ে দলের উপরেই। তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্ট করে দিতে চেয়েছেন, দুর্নীতির দায় একান্তই ব্যক্তিগতভাবে সেই নেতার। তারসঙ্গে দলের কোনও সম্পর্ক নেই। দুর্নীতি ইস্যুতে ডোজটা এবার একটু বেশি হলেও করেকম্মে খাওয়া নেতাদের আক্রমণ এই প্রথম নয়। এর আগেও তিনি দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের এই বলে সতর্ক করেছেন, ‘একটা মানুষের বেঁচে থাকার জন্য কত টাকা লাগে? সোনাদানা, টাকা পয়সা কি চিবিয়ে খাবি?’ তারপরেও তাদের সম্বিত ফেরেনি। কারণ টাকার নেশা হেরোইনের চেয়েও ভয়ঙ্কর। এই নেশায় আক্রান্ত হলে মানুষ হয়ে যায় দু’কান কাটা।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা মিটিংয়ে বলা কথায় সব বদলে যাবে, এমনটা ভাবার মতো মূর্খ পাওয়া কঠিন। কারণ এরপরেও পুকুর বুজিয়ে বহুতল উঠবে। বহুতলের প্ল্যান পাশ করাতে গেলে যথাস্থানে ‘প্রণামী’ দিতে হবে। রাস্তা তৈরির কাজ নির্বিঘ্নে করতে গেলে শাসক দলের মাতব্বরদের খুশি করতে হবে। এমনকী, ফুটপাতে কিংবা সরকারি জায়গায় ব্যবসা করতে গেলে ইউনিয়নের নেতাকে চাঁদা দিতে হবে। তবে, আপাতত কিছুদিন হলেও তাতে কিছুটা লাগাম পড়বে। নেতারা কিছুটা হলেও ভয় পাবেন। ঘাড়ধাক্কা খাওয়ার ভয়। আর তা যে অমূলক নয়, সেটা তৃণমূলের ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি ব্লকের সভাপতি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। বেআইনি জমি কারবারে যুক্ত থাকার অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাহলে কি কাক মেরে ঝুলিয়ে দেওয়া শুরু করে দিলেন?
তৃণমূলের দাবি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দুষ্টের
দমন, শিষ্টের পালন নীতি নিতে চাইছেন। আর বিরোধীদের চোখে এটা নিছকই ‘আইওয়াশ’। কিন্তু এসব বলে কি একজন দলনেত্রী ও প্রশাসনিক প্রধানের শুদ্ধিকরণের চেষ্টাকে খাটো করা যাবে?
এর আগে দেশের কোনও মুখ্যমন্ত্রী এভাবে নিজের দলের বা সরকারি অফিসারদের খোলাখুলি সমালোচনা করার সাহস দেখাননি। উল্টে সব সময় আড়াল করে গিয়েছেন।
তবে, এব্যাপারে সকলের উপর রয়েছে বিজেপি। তারা কোনও অভিযোগকেই আমল দেয় না। তাই সংশোধনের প্রশ্নই ওঠে না। উল্টে প্রতিবাদের সুর চড়লে নেতৃত্ব এমন আচরণ করে যাতে মনে হয়, বিজেপির বিরুদ্ধে অভিযোগ করাটাই অপরাধ। এই যেমন নিট কেলেঙ্কারি নিয়ে দেশজুড়ে হইচই হচ্ছে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী স্পিকটি নট! উল্টে বিরোধীরা যাতে এই ইস্যুতে বেশি হইচই না করে তারজন্য তাঁর সতর্কবার্তা, ‘সংসদ নাটক করার জায়গা নয়।’ একথা বলে তিনি কী বোঝাতে চাইলেন? নাটক করার অধিকার তাঁর একার!
আসলে বিরোধীদের পাত্তা না দেওয়াটাই বিজেপির ট্র্যাডিশন। মহিলা কুস্তিগীরদের প্রবল চাপের মুখেও যৌন হেনস্তায় অভিযুক্ত ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে বিজেপি ব্যবস্থা নেয়নি। একই স্ট্যান্ড নিয়েছিল অজয় মিশ্রের ক্ষেত্রেও। আন্দোলনকারী চাষিদের গাড়ি চাপা দিয়ে মারার ঘটনায় অভিযুক্ত হয়েছিলেন অমিত শাহের ডেপুটি অজয় মিশ্রের ছেলে। অজয় মিশ্রকে সরিয়ে দেওয়ার দাবিতে সোচ্চার হয়েছিল গোটা দেশ। কিন্তু কান দেয়নি বিজেপি নেতৃত্ব। তারপরেও অজয় মিশ্রকে এবার টিকিট দিয়েছিল। কিন্তু বিজেপির আশায় পড়েছে চোনা। খেরি লোকসভা আসনে সমাজবাদী প্রার্থীর কাছে হেরেছেন অজয় মিশ্র। লখিমপুরের মানুষ বুঝিয়ে দিয়েছে, দল আড়াল করলে শাস্তি দেওয়ার দায়িত্ব নেয় জনতা।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই অগ্নিবর্ষণ যে শহরে পিছিয়ে থাকার কারণেই, তাতে সন্দেহ নেই। তবে তিনি সিপিএমের স্টাইলে ‘মানুষ ভুল করেছে’ এমন মন্তব্য করেননি। উল্টে নিজের দলের ও সরকারের ত্রুটি চিহ্নিত করে তা এনেছেন প্রকাশ্যে। অনেকের কাছে তা ‘বেফাঁস’ মনে হতেই পারে। কিন্তু সরকার তো জনগণ দ্বারা নির্বাচিত। তাই জবাবদিহির দায় একমাত্র জনতার কাছে। আর সেটা তিনি বারবার করে এসেছেন। তাই তিনি ‘দলনেত্রী’ থেকে হয়ে উঠেছেন ‘জননেত্রী’।