পড়ে গিয়ে বা পথ দুর্ঘটনায় আঘাতপ্রাপ্তির যোগ থাকায় সতর্ক হন। কর্মে উন্নতি ও সাফল্যের যোগ। ... বিশদ
কীভাবে তৈরি হয়েছিল এই স্লোগান? কে ঠিক করেছিল টার্গেট? কোন বৈঠকে আলোচনা হয়েছিল? কোন কোন সাধারণ সম্পাদক, কার্যকর্তা, বিজেপি রাজ্য ইউনিটের মাথারা ছিলেন সেই বৈঠকে? দিল্লির এক নেতার কথায়, ৪০০ পারের ব্যাপারে কোনও বৈঠকেই আলোচনা হয়নি। হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে উঠে তিনি এবং তাঁর মতো কেন্দ্রীয় নেতারা জানতে পেরেছেন, লোকসভা নির্বাচনে তাঁদের এই পাহাড়প্রমাণ টার্গেটের কথা। যেহেতু কোনও বৈঠকেই এ ব্যাপারে আলোচনা হয়নি, তাই খুব স্বাভাবিকভাবে এর কোনও ব্লু-প্রিন্টও নেই। অর্থাৎ, কোন রাজ্যে কত করে আসন বাড়াতে হবে এবং কীভাবে সেই লক্ষ্যপূরণ সম্ভব... সে নিয়ে এক নয়া পয়সার আলোচনা বিজেপির কেন্দ্রীয় কোনও বৈঠকে হয়নি। ভোটের আগে রাজ্যওয়াড়ি দলীয় রিপোর্ট যেমন পেশ হয়, তেমনটা হয়েছিল। ওখানেই শেষ। সেই রিপোর্টে কিন্তু শক্তিক্ষয়ের ইঙ্গিত ছিল বলেই গেরুয়া শিবিরের অন্দরের খবর। সংখ্যালঘু ভোটারদের ক্ষোভ, মেরুকরণে শিক্ষিত সমাজের বিরক্তি—এই সবেরই উল্লেখ ছিল তাতে। তারপরও নরেন্দ্র মোদি ৪০০ পারের ডাক দিয়েছেন এবং সেটা দলের নেতারাই জানতেন না! মোদির সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাঁরাও ‘অব কি বার ৪০০ পার’ শুরু করেছেন বটে, কিন্তু আড়ালে-আবডালে নিজেদেরই প্রশ্ন করেছেন—কীভাবে? নরেন্দ্র মোদি ঘনিষ্ঠ বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্করকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, এই যে আপনারা ৪০০ পার বলছেন, সেটা হবে কোন অঙ্কে? রাজ্যওয়াড়ি ব্রেক আপটা কী? তিনি জোরের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘দেশজুড়ে প্রো-ইনকামবেন্সি হাওয়া বইছে। তাতেই হবে।’ অর্থাৎ, প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ভোট পড়বে। নরেন্দ্র মোদি সরকারের পক্ষে। কীভাবে তিনি সেই হাওয়া বুঝলেন? বিহার, মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবঙ্গ, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলেতে যখন আসন কমে যাওয়ার নিশ্চিত লক্ষণ দেখা যাচ্ছে... প্রো-ইনকামবেন্সি হাওয়াটা ঢুকল কোথা দিয়ে? সেই উত্তর শুধু জয়শঙ্কর কেন, বিজেপির তাবড় তাবড় নেতারাও দিতে পারছেন না। নরেন্দ্র মোদিও না।
ভোটপর্ব শুরুর মুখে মোদিজি লাগাতার বলছিলেন, ৪০০ পার হবেই। বিজেপি নিশ্চিত। তিন দফা ভোটের পর ৩৭০ বা ৪০০ পারের অঙ্ক বেমালুম চেপে গেলেন তিনি। তারপর হঠাৎ আবার বলতে শুরু করলেন, ‘আমাদের ৪০০ পার করানোটা আমার চাহিদা নয়, জনগণের ইচ্ছে।’ মানে ভাবটা এমন, ১৪০ কোটি দেশবাসী তাঁর কানে কানে এসে বলে গিয়েছেন, আপনি ৪০০ পার করছেন। আচ্ছা, না হয় ধরে নেওয়া গেল ১৪০ কোটি দেশবাসী তাঁকে এই ইচ্ছের কথা জানাননি। তাহলে কতজন জানিয়েছেন? ১০ কোটি? এক কোটি? এক লক্ষ? ১০০ জনও কি জানিয়েছেন? তাহলেও জানতে ইচ্ছে করে, কোন কোন রাজ্যের মানুষ এমন আশাবাদী। দক্ষিণ ভারতের কোনও রাজ্য থেকে ৪০০ পারের কথা কেউ বলবে বলে মনে হয় না। এমনকী, কর্ণাটকেও বিজেপির ভোট ম্যানেজাররা ১৪-১৫টার বেশি আসন দেখছে না। অথচ গত লোকসভা ভোটে এই রাজ্য থেকে ২৫টা আসন পেয়েছিল মোদির দল। কৃষক ইস্যু যে সব রাজ্যে প্রভাব ফেলেছে, তাঁরা বলবেন না। মণিপুর বলবে না। প্রাপ্য টাকার জন্য বছরের পর বছর ধুঁকতে থাকা বাংলাও বলবে না। তাহলে ৪০০’র বৈতরণী পার কে করাবে? মোদিঝড় যে নেই, সে ব্যাপারে তো বিজেপির অন্দরেই কানাঘুষো চলে। তাহলে কি ইভিএম?
ভোটদানের হার প্রতি দফার পর প্রকাশে ঢিলেমি দেখানোর জন্য নির্বাচন কমিশন এমনিতেই বিতর্কে জর্জরিত। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত বুথমুখী ভোটারদের যে হার দেখা যাচ্ছে, পরের এক ঘণ্টার হিসেবে ৪-৫ শতাংশের ফারাক হচ্ছে কীভাবে? ওই বাকি অংশটুকুই কিন্তু দিনের দিনে দিতে ‘অপারগ’ ছিল কমিশন। তাই বিরোধীরা তো গলা ফাটাবেই। কমিশনকে বিজেপির বি টিম বলে কাঠগড়ায় দাঁড়ও করাবে। ৪ জুন ফলাফল বেরনোর পর যদি দেখা যায়, অধিকাংশ আসনেই বিরোধীরা বাজিমাত করেছে, তাহলে এই বিতর্ক ধামাচাপা পড়ে যাবে। কিন্তু বিজেপি যদি সত্যিই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিকে এগিয়ে যায়, তাহলে ডালের মধ্যে কালোপানা অংশ বিরোধীরা খুঁজে বের করবেই। তবে তেমন কিছু হয়তো হবে না। কারণ, বিজেপির অতি ভক্তও দূরবীন নিয়ে ৪০০ দেখতে পাচ্ছেন না। কর্মীরা এখনও জানেন না, কোন কোন কেন্দ্রে বাড়তি জোর দেওয়ার ছিল, বা শেষ দফায় দিতে হবে। কোন ধরনের ভোটারদের মগজ ধোলাই এই ৪০০ পারের টার্গেটের জন্য জরুরি ছিল? কোন রাজ্যে কত আসনে জয় ধরে নিয়ে নরেন্দ্র মোদি ৪০০ পার স্লোগান তুলেছেন এবং লাগাতার বিজ্ঞাপন দিয়েছেন?
কী বলা যায় একে? ফাটকা? নাকি স্রেফ ধাপ্পা? ফাটকা কেন? নরেন্দ্র মোদি হয়তো ভেবেছেন, একটা সংখ্যা ছুড়ে দেওয়া যাক। ঝড় না থাকুক, খানিক হাওয়া তো আছে! তাহলেই এই সংখ্যার স্রোতে পাবলিক ভেসে যাবে, আর ভোট দেবে। না মিললে? যতটুকু পাওয়া যাবে, সেটাই লাভ। আর ধাপ্পা কেন? মোদি জানেন, তাঁকে সামনে রেখেই ভোটে নেমেছে বিজেপি। থুড়ি, মোদি জনতা পার্টি। দলের কাঠামো, শীর্ষ স্তর, আদি নেতা, বাজপেয়ি ঘরানা... সবকিছু একা হাতে কফিনবন্দি করেছেন তিনি। গোটা দলটাই এখন তাঁর উপর দাঁড়িয়ে। এটাই তো চেয়েছিলেন মোদি! একাই নায়ক। এক ব্যক্তি, এক মিথ। কিন্তু একনায়কতন্ত্রের একটা মুশকিল আছে—সাফল্যের কৃতিত্ব যেমন তাঁর হয়, ব্যর্থতার সম্পূর্ণ দায়ও চাপে তাঁর কাঁধে। তাই হয়তো মরিয়া হয়ে আরও একটা জুমলা। এবার শুধু দেশবাসী নয়, দলকেও। কোনওমতে বেরিয়ে গেলে তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী। জওহরলাল নেহরুর মতো টানা তিনবার দিল্লির কুর্সি। হোক না মিথ্যা! সত্যি হয়ে উঠবে মিথ।
স্প্যানিশ অভিযাত্রী কমান্ডার হার্নান কর্টেজ সম্পর্কেও একটা মিথ আছে। লাতিন আমেরিকার সভ্যতা, সম্পদ, সংস্কৃতি পৃথিবী থেকে মুছে দেওয়ার জন্য দায়ী করা হয় তাঁকে। বলা হয় তাঁর নৃশংসতার কথা। তাঁর অভিযানের পরই চিরতরে বিলুপ্ত হয় অ্যাজটেকদের সাম্রাজ্য। কথিত রয়েছে, অ্যাজটেকদের রাজধানী টেনোচতিতিলানে গণহত্যা চালিয়েছিলেন তিনি। ২ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর কলঙ্ক লেগে রয়েছে
তাঁর কপালে। জনশ্রুতি বলে, কর্টেজ মূর্তিমান শয়তান। কিন্তু এর নেপথ্যে লুকিয়ে থাকা সত্যিটা কী? কর্টেজ বা স্প্যানিয়ার্ডরা লুটতরাজ চালিয়েছিল, এতে কোনও সংশয় নেই। কিন্তু কারা তাদের পথ
দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল? রেড ইন্ডিয়ানদেরই একটা অংশ। সহযোগী ছিল তারা কর্টেজের। হত্যালীলা চালিয়েছিল তারাই। কর্টেজ আটকানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পারেননি। স্প্যানিয়ার্ডরা ফিরে যাওয়ার পর শহর তথা সাম্রাজ্যটাকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার কাজটা সেরেছিল গুটিবসন্ত। দেখা দিয়েছিল মহামারী রূপে। ধ্বংস হয়েছিল সভ্যতা। আর একটা মিথ্যা শুধুমাত্র লোকমুখে মিথ হয়ে উঠেছিল। ভারতবর্ষ আজ তাকিয়ে আছে এমনই এক প্যাকেজের দিকে। চোখ ধাঁধানো প্রতিশ্রুতি, মোহ, স্বপ্ন। অন্ধকার বাস্তবের উপর গড়ে ওঠা ঝাঁ-চকচকে ইমারত। ৪০০ পারের স্লোগান। আজ বাদে কাল সামনে আসবে সত্যিটা। হয়তো। কেন এই সংশয়? সবটাই যেন নির্ভর করছে ভোটের ফলের উপর! নরেন্দ্র মোদি জিতে গেলে সবটাই চাপা পড়ে যাবে প্রতিশ্রুতির চাদরের নীচে। আর হারলে? বেরিয়ে আসবে হাড়-কঙ্কাল। মিথ্যা তখন আর মিথ হয়ে উঠবে না।
ও হ্যাঁ, দিল্লির ভোটে কংগ্রেস প্রার্থী কানহাইয়া কুমারকে বুথের বাইরে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ৪০০ পার নিয়ে কী বলবেন? কানহাইয়ার উত্তর ছিল, ‘বিজেপির আসন নয়, মোদিজি ওটা পেট্রলের দাম বলছেন... বিজেপি জিতে এলে।’