সিপিএম শাহির পতন যে সময়ের অপেক্ষামাত্র, তা আঁচ করতে পেরেছিল সকলেই। লাগাতার লালসন্ত্রাসে মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। ওইসঙ্গে রাজ্যকে গ্রাস করেছিল দুর্নীতি আর অনুন্নয়নের রকমারি। একদিকে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছিলাম শিক্ষায়, অন্যদিকে বাংলাজুড়ে তীব্র হচ্ছিল বেকারত্বের জ্বালা। কারণ ‘ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’ আর ধর্মঘট বন্ধ হরতালের সংস্কৃতির সামনে অসহায় বোধ করছিল শিল্প, কৃষি দুইই। ভূমি-সংস্কারের আড়ালে গ্রামবাংলায় কায়েম হয়েছিল বিরোধীদের দুরমুশ করার হার্মাদি কারবার। তাতেই হাঁপিয়ে উঠেছিল একদা সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা বাংলা। বারাকপুর, দুর্গাপুর, রানিগঞ্জ, আসানসোল, ডানলপ, রিষড়া, উত্তরপাড়া, বজবজ, বিড়লাপুর, খড়্গপুর, হলদিয়া প্রভৃতি জায়গা কয়েক দশক জেগে ছিল শ্রমিকের ব্যস্ততা আর উৎপাদনের উন্মাদনা নিয়ে। কিন্তু সেসব জায়গার উপর ভয়াবহ দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল শিল্প কারখানার কঙ্কাল আগলে রাখার। সৌজন্যে জ্যোতি বসুর রাজনীতির ছোঁয়া! একদিকে শিল্প-শ্মশান আর অন্যদিকে ঊষর কৃষিক্ষেত্র। সব মিলিয়ে তীব্র দারিদ্র্যই হয়ে উঠেছিল বাংলার নিয়তি। কিন্তু আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের কর্মকর্তারা বালিতে মুখ গুঁজে রেখেই মানুষের যাবতীয় উপলব্ধি উপেক্ষা করার নীতি নিয়েছিলেন।
তবে সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার তৈরির পর আগমার্কা মার্কসবাদীরাও বুঝে গিয়েছিলেন শমন শিয়রেই। তখন বামফ্রন্টের নামে সিপিএম আওয়াজ তুলল—‘কৃষি আমাদের ভিত্তি শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’। অর্থাৎ বোঝাতে চাইল কৃষির উন্নয়নের মাধ্যমে জ্যোতি বসুর সরকার বাংলার ভিত গড়ে দিয়েছে, এবার তারা বাংলার মজবুত ভবিষ্যৎও নির্মাণ করবে সময়োপযোগী শিল্প গড়ে। বাংলার মানুষ ভোলেনি, মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে জ্যোতিবাবু প্রতিবছর নিয়ম করে বিদেশ সফরে বেরতেন। যাওয়ার আগে জানিয়ে যেতেন যে, বড় বড় শিল্পপতি ধরে আনবেন কিন্তু তাঁর ডাকে কোনও শিল্পপতিই আসেননি। স্বভাবতই ব্যাপারটা জ্যোতি বসুর বিদেশ সফরের বাহানা হিসেবেই নিন্দিত হয়েছিল। সবাই জানত, মেকি মার্কসবাদীদের ভাঙচুর, বন্ধ, তোলাবাজির বাংলায় আর যাই হোক শিল্প-ব্যবসা সম্ভব নয়। হাজার হাজার কোটি টাকা জলাঞ্জলি দিতে কেউ এখানে আসবেন না। তবু গদি বাঁচাতে শিল্পায়নের ভেক ধরেছিলেন আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের কর্তারা—সামনে রেখেছিলেন তাঁরা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সাদা ইমেজকে। কিন্তু বুদ্ধদেববাবুও শেষপর্যন্ত শিল্প গড়ায় বামফ্রন্ট সরকারের আন্তরিকতা তুলে ধরতে ব্যর্থ হন। হাজার হাজার কৃষকের সঙ্গে তিনি অনাবশ্যক কারণে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। হলদিয়ার উপকণ্ঠে নন্দীগ্রামে এসইজেড এবং সিঙ্গুরে মোটর গাড়ি কারখানা নির্মাণের নামে বিপুল উর্বর কৃষিজমি অধিগ্রহণে গোঁ ধরেন তিনি। স্বভাবতই বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন অসংখ্য কৃষক, এবং সরকার ওই দুই প্রকল্প স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়। তাঁদের আন্দোলন সমর্থন করার কারণে বামপন্থীদের একাংশ এজন্য তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দায়ী করেন।
পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল ভোটে জিতে রাইটার্স দখল করেন মমতা। রাজ্যের ক্ষমতা হাতে পাওয়ামাত্রই তিনি দুটি জিনিসে অগ্রাধিকার দেন—উন্নয়ন এবং কর্মসংস্কৃতি। তিনি ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্টের নতুন ধারণা দিয়েছেন দেশকে। তার ফলে গরিব এবং মহিলারা সুযোগ পেয়েছেন সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে, মমতার নেতৃত্বে বাংলা সোৎসাহে বর্জন করেছে ধর্মঘট, বন্ধ, হরতাল প্রভৃতি। ফলে কর্মদিবসের সংখ্যা বেড়ে চলেছে প্রতিবছর। গত ১৩ বছরে ম্যাজিকের মতোই কমেছে নিরক্ষরতা, স্কুলছুট, বাল্যবিবাহ, শিশুমৃত্যুর হার, অপুষ্টি এবং অবশ্যই দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও বৈষম্য। বেড়েছে কৃষি ও শিল্প উৎপাদন, জিডিপি এবং রাজস্ব। প্রশাসন আর রাইটার্স বা নবান্ন থেকে পরিচালিত হয় না, তা আক্ষরিক অর্থেই পৌঁছে গিয়েছে মানুষের দুয়ারে। শিল্প-বাণিজ্য সংক্রান্ত প্রয়োজন ও সমস্যা মেটাতে তৈরি হয়েছে এক জানালা ব্যবস্থা। শিল্পপতিদের উপর তোলাবাজদের অত্যাচার এখন একটি অতীত অধ্যায় মাত্র। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের জন্য এর চেয়ে আদর্শ পরিবেশ আর কী হতে পারে? এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতেই মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে রাজ্যে অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে বিজনেস সামিট। এবছরের অষ্টম বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনের মঞ্চ দিয়েছে তারই স্বীকৃতি—কোনও কুণ্ঠা ছাড়াই। বস্তুত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হয়েই ব্যাট ধরতে দেখা গিয়েছে স্বয়ং রিলায়েন্স কর্ণধার মুকেশ আম্বানিকে। শিল্পোদ্যোগীদের উদ্দেশে তাঁর গ্যারান্টি, ‘বন্ধুরা, বাংলায় বিনিয়োগের এটাই সঠিক সময়। কারণ, দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে আশার উৎস হয়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গ। বিনিয়োগকারী হিসেবে বলছি, বাংলায় আসুন। মমতাদিদি রেড কার্পেট পেতে অপেক্ষা করছেন। আপনারা হতাশ হবেন না।’ বুধবার মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, বিনিয়োগ করবেন টাটারাও। এই ব্যাপারে সংস্থার শীর্ষকর্তার সঙ্গেই কথা হয়েছে তাঁর। সব মিলিয়ে সাড়ে ৪ লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব পেয়েছে বাংলা। নিঃসন্দেহে এ এক অভূতপূর্ব সন্দেশ! যাবতীয় প্রস্তাবের বাস্তবায়নের আশায় থাকব আমরা সকলে।