নামেই যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা বজায় রয়েছে দেশে। প্রকৃত অর্থে মোদি সরকারের বঞ্চনা ও একতরফা শাসন জারি রয়েছে আটবছর ধরে। কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাজ্যগুলিকে যে দুয়োরানি করে রাখা হয়েছে তার উদাহরণ অজস্র। অথচ যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় রাজ্যগুলিকে সবরকম সাহায্য করে শক্তিশালী দেশ গড়াই কেন্দ্রের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল। স্বাধীনতার ৭৫ বছরেও তা তো হয়নি, উল্টে মোদি জমানায় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মূল সুরটাই নষ্ট হতে বসেছে! রাজ্যগুলির পক্ষ থেকে বার বার এই নিয়ে অভিযোগ তোলা হলেও ভ্রুক্ষেপ নেই কেন্দ্রীয় সরকারের। মুখে যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো বজায় রাখার কথা বলা হলেও কার্যত কেন্দ্রীয় নানা সিদ্ধান্ত জোর করে রাজ্যগুলির উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অথচ মুখে ‘টিম ইন্ডিয়া’ গঠনের কথা বলছেন প্রধানমন্ত্রী! একথা ঠিক, দেশকে আত্মনির্ভর করে গড়ে তুলতে হলে রাজ্যগুলিকেও সেইসঙ্গে আত্মনির্ভর ও শক্তিশালী করতে হবে। সেক্ষেত্রে কেন্দ্রের সহযোগিতা জরুরি। কিন্তু বাস্তব অন্যকথা বলছে। তাই রবিবার নীতি আয়োগের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীকে সামনে পেয়ে ফের রাজ্যগুলির প্রতি কেন্দ্রের বঞ্চনা ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ধ্বংস করার বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়সহ বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা। ক্রমাগত বঞ্চনা অব্যাহত রেখে কেন্দ্রের দ্বিচারিতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, নীতি আয়োগের এই বৈঠককে ‘টিম ইন্ডিয়া’র বৈঠক হিসেবে তুলে ধরতে উদ্যোগী হয়েছিল কেন্দ্র। এতগুলি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল মিলে দেশ যে এক সুতোয় গাঁথা—সেটা বোঝাতেই এই টিম ইন্ডিয়া স্লোগান আমদানি করা হয়েছে। কিন্তু এটা যে চোখে ধুলো দেওয়ার চেষ্টা মাত্র, নিছকই কথার চমক, মোদি সরকারের সেই পর্দাটাই ফাঁস করে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। রাজ্যগুলিকে দুর্বল রেখে যে কেন্দ্র শক্তিশালী হতে পারে না সেই সারসত্যটা প্রধানমন্ত্রীকে বুঝিয়েও দিলেন। রাজ্যের বকেয়া মেটানোর দাবি তুললেন। বললেন, নীতি আয়োগ পরিকল্পনা পাঠায়। সেইমতো রাজ্য সরকার কাজ করার চেষ্টা করে। কিন্তু বহুক্ষেত্রেই বকেয়া সময়মতো না মেটানো সমস্যা হয়। শুধু তাই নয়, পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও বহু সময়ে অনভিপ্রেতভাবে রাজ্যের সঙ্গে কোনওরকম আলোচনা না করেই মোদি সরকার কাজ করছে। যা যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পরিপন্থী। মোদির ভারতে টিম ওয়ার্ক থাকে অবহেলিত। জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়েও কেন্দ্রের ভূমিকার কড়া সমালোচনা করেছেন মমতা। বলেছেন, দেশের ভবিষ্যৎ গড়ার স্বার্থেই শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে সবিস্তারে কেন্দ্র-রাজ্যের আলোচনা মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা জরুরি। কিন্তু তা না করে জাতীয় শিক্ষানীতি রাজ্যগুলির উপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়াস লক্ষ্য করা হচ্ছে।
কিন্তু বার বার প্রধানমন্ত্রীর মুখে আত্মনির্ভর ভারত গঠনের কথা শোনা যাচ্ছে। অথচ কেন্দ্র ছলে-বলে-কৌশলে রাজ্যগুলিকে নানাভাবে বঞ্চিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যেমন এই মুহূর্তে কেন্দ্রের কাছে বাংলার ন্যায্য পাওনা প্রায় ১ লক্ষ ১ হাজার কোটি টাকা। কোন খাতে কত পাওনা তার বিস্তারিত তথ্য প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। নীতি আয়োগের বৈঠকেও সঙ্গত যুক্তিতে এই নিয়ে তিনি সবর হয়েছেন। এমনকী, ১০০ দিনের কাজের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে টাকা দিচ্ছে না কেন্দ্র। প্রশ্ন হল, টাকা না পেলে অগ্রগতি হবে কীভাবে? আবার কয়েকবছর আগে উম-পুন ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত বাংলার ক্ষত মেরামতের জন্য যে টাকা রাজ্যের তরফে চাওয়া হয়েছিল তার অনেকটাই এখনও দেয়নি কেন্দ্র। প্রশ্ন হল, কেন্দ্র না দিলে রাজ্য প্রয়োজনীয় অর্থ কোথায় পাবে? রাজ্যগুলির হাতে তো আর টাকা ছাপানোর যন্ত্র নেই। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কেন্দ্রের কাছ থেকে প্রাপ্য টাকার উপর রাজ্যগুলিকে অনেকাংশেই নির্ভর করতে হয়। সেই বরাদ্দ না পেলে রাজ্য এগবেই বা কীভাবে? দরকার কেন্দ্র-রাজ্য কর কাঠামোর পুনর্বিন্যাসও। আত্মনির্ভর হতে রাজ্যগুলির স্বার্থসুরক্ষা ভীষণই জরুরি। বাগাড়ম্বর চললেও এক্ষেত্রে কেন্দ্রের তরফে সদিচ্ছার অভাব স্পষ্ট।
নীতি আয়োগের বৈঠকে তাই রাজ্যের আর্থিক পরিস্থিতি সামাল দিতে কেন্দ্রীয় করের টাকায় রাজ্যের ভাগ বৃদ্ধিরর দাবি উঠেছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাজ্যগুলির সঙ্গে সমন্বয় করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দাবিটিও ছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে বহু ক্ষেত্রে কেন্দ্রের মতামত প্রায় একতরফাভাবে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যার তীব্র বিরোধিতা করেছেন মমতাসহ কয়েকটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। সত্যিই যদি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়, করে তুলতে হয় আত্মনির্ভর তাহলে সর্বাগ্রে রাজ্যগুলিকে স্বাবলম্বী এবং শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হবে। বঞ্চনা নয়, দরকার কেন্দ্রের তরফে পূর্ণ সহযোগিতা। না-হলে ‘টিম ইন্ডিয়া’ শুধু প্রধানমন্ত্রীর মুখের কথাই রয়ে যাবে। কারণ, মোদি জমানায় যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাটাই যে চ্যালেঞ্জের মুখে! এখন কেন্দ্রের উচিত, প্রকৃত যুক্তরাষ্ট্রীয় ভাবধারা মেনে টিমওয়ার্ক নির্ভর পদক্ষেপ করা। কেন্দ্র-রাজ্য সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করলেই ভারত শক্তিশালী হবে। নচেৎ মোদির ‘টিম ইন্ডিয়া’র স্বপ্নপূরণ অধরা থাকবে।