শেয়ার ও বিমা সূত্রে অর্থাগম হতে পারে। কাজের প্রসার ও নতুন কর্মলাভের সম্ভাবনা। বিদ্যা হবে। ... বিশদ
হাটে গেঞ্জি বিক্রি করতেন ভোলানাথ। নিজের তৈরি গেঞ্জি। সোদপুরের পানশিলা থেকে ভোর ভোর পৌঁছে যেতেন হাটে। তার পর সাজিয়ে বসতেন গেঞ্জির পসরা। যা আয় হয়, চলে যায় ক'টি পেট। কিন্তু এখন আর চলছে না। লুঙির গিঁট বেঁধে খাটের উপর বসলেন ভোলানাথ। হাসিটা ঘুরছে নীল মাছির মতো। একবার এদিক। একবার ওদিক। বললেন, ‘খুব ধাক্কা লাগল জানেন। আশি বছর বয়স হল। এত বড় ধাক্কা খাইনি খুব একটা।’
—আশি বছর? আপনাকে দেখে কিন্তু বোঝা যায় না।
—আশি বললাম বুঝি? পঁচাশিও হতে পারে। কবে জন্মেছি! হিসেবপত্র নেই। দু’বার মরেছি। যেদিন দেশভাগ হল আর যেদিন দেশ ছেড়ে এলাম। করোনায় আবার সেই ধাক্কা। গরিবের হাট ছাড়া আছে কী!
ভোলানাথ লেখাপড়া জানা লোক। ও-পারে ভিক্টোরিয়া ইস্কুলে পড়েছেন। এ-পারে বিরাটির কলেজে। কিন্তু চাকরির চেষ্টা বিশেষ করেননি। সেই যে এ-পারে এসে গেঞ্জির মোহে পড়লেন, ব্যস। তাতে অবিশ্যি কোনও দুঃখ নেই ভোলানাথের। নিজের হাতে গেঞ্জির কাটিং করেছেন। তারপর নিজেই বাজারে বিক্রি করেছেন। হাঁটতে ভালোবাসেন তিনি। ও-পার থেকে হেঁটেই এসেছিলেন এ মুলুকে। বাড়ির উঠোন, ইস্কুলের মাঠ, হিমমাখা ঘাস হেঁটেই পিছনে ফেলে এসেছেন।
আপনি কোনও দিন চাকরির চেষ্টা করেননি? ভোলানাথ বলেন, ‘এ কে দত্তর নাম শুনেছেন? উনি ছিলেন মানিকগঞ্জের মস্ত বড় সরকারি অফিসার। পরে বদলি হয়ে চলে আসেন খিদিরপুর ডকে। খুব বড় মনের মানুষ। কেউ যদি বলতেন, আমি মানিকগঞ্জের লোক, কিছু না কিছু একটা চাকরি জুটিয়ে দিতেন। তা একবার ভাবলাম তাঁর কাছে যাই। কিন্তু যাওয়া হয়নি।’
—কেন যাননি?
—ভাই এসে ঢুকল ছাপাখানায়। আমি গেঞ্জিকলে। কেউ কোনও দিন গেঞ্জির প্রেমে পড়েছে শুনেছেন? আমি পড়েছি। চলে তো যাচ্ছিল। কিন্তু করোনা এসে সব হিসেব গুলিয়ে দিল। পানশিলার সুভাষনগরে ভোলানাথের ঘর। পাশেই দুর্গাবাড়ি। পুজোর তোড়জোড় কিছু নেই। তাঁর ঘরে হাঁ করে আছে ইট। সিমেন্ট নেই। মাথার উপর বাঁশের সঙ্গে সিলিং ফ্যান ঝুলছে। নীচে একটা চৌকি। সেখানে বালিশে হেলান দিয়ে বসে ভোলানাথের ছেলে। সদ্য কঠিন অস্ত্রোপচার হয়েছে। ভোলানাথ বললেন, ‘এর মধ্যে ছেলেটা কঠিন অসুখে পড়ল। ওষুধ ডেলিভারির কাজ করত। সেই কাজও বন্ধ হয়ে গেল। খাব কী? বয়স হয়েছে তো। এখন মেয়ে-জামাই ভরসা।’ একটা দুঃখের কথা বললেই দু’বার হাসেন ভোলানাথ। দুঃখকে থানা গাড়তে দেন না কিছুতেই। হাওয়া বয় শনশন/তারারা কাঁপে/ হৃদয়ে কি জং ধরে/পুরনো খাপে! বলেন, ‘পদ্মার ইলিশ খেলেন এবার? যা দাম! দেড় সের ইলিশ মাছ এক টাকায় কিনে খেয়েছি। উফফ কী স্বাদ! এক সের দুধ যেন কত ছিল? মনে নেই। সিকি-আধুলি কিছু একটা হবে।’ এ-সব কথা নতুন নয়। কে শুনল, কে শুনল না তাতে তাঁর কিছুই যায় আসে না। কিন্তু তিনি বলে যান দিনভর। যেমন এখন বলছেন, ‘ডিঙি নৌকো চড়ে ঠাকুর দেখতে যেতাম। কী যেন নদীটার নাম! নাকি ওটা বিল? নদীর দু’ধার বেবাক সাদা। যাচ্ছি তো যাচ্ছি। এ গ্রামে, সেই গ্রামে। বক উড়ছে। দূরে ঢাকের আওয়াজ...।’ ভোলানাথের ভর হয়েছে। বাংলাদেশের ভর। গেঞ্জিকলের ঘুপচি ঘরে বসে কতদিন এমন ভরে পেয়েছে। সাদা গেঞ্জি, সাদা বক, সাদা ফটফটে আকাশ—ভোলানাথের সব গুলিয়ে যায়। বলেন, ‘এমন পুজো তো কোনও দিন দেখিনি। কাজ নেই, দু’পয়সা বাড়তি রোজগার নেই, কলা-মুলো নেই। এই দেখুন আমার নাতি।’ দশমাসের নাতিকে কোলে বসান ভোলানাথ। তার কপালে দুটো মস্ত কাজলের টিপ। নাতি হাসে। ভোলানাথও হাসেন। বললাম, কাজলের টিপ এখন তো কাউকে দিতে দেখি না। ভোলানাথ বলেন, ‘দিয়েছে বৌমা। যাতে নজর-টজর না-লাগে।’ হাইফেন দেওয়া ভোলানাথের বাতিক। আশি-পঁচাশি, সিকি-আধুলি, কলা-মুলো, নজর-টজর...। ওই হাইফেনে কী আছে? হয়তো নদীর দু’ধার, হয়তো ইন্ডিয়া-পাকিস্তান, মাঝে নাতি কোলে ভোলানাথ হাসছেন। আশি-পঁচাশির ফারাক। কিন্তু তাতে কী! হাসির কোনও হাইফেন নেই। কাঁটাতারও নেই।