প্রায় সম্পূর্ণ কাজে আকস্মিক বিঘ্ন আসতে পারে। কর্মে অধিক পরিশ্রমে স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা। ... বিশদ
তাই আজও যেন কালীপুজোয় তারাপীঠ হয়ে ওঠে ভাব-ভক্তি-ত্যাগ-বৈরাগ্যের অমরাবতী। আমরাও সেই অতীতকীর্তির সাক্ষ্যবাহী পূণ্য সফরে বেড়িয়ে আসি।
উদয়পুর গ্রামে কালীবাড়ি
তারাপীঠের খুব কাছেই উদয়পুর গ্রামে হয় প্রাচীন এই কালীপুজো। আয়োজক তারাপীঠ মন্দিরের সেবায়েতরা। বংশপরম্পরায় তাঁরা বার্ষিক ও মানসিক পুজো করে আসছেন। কথিত আছে, কালীপুজোর দিন সারারাত বামদেব মা তারার পুজো করে পরদিন ভোরবেলায় চলে আসতেন উদয়পুরে। সেখানে আগে মায়ের পুজো করতেন। তারপর তিনি অন্নজল মুখে দিতেন। এখানে শিশুভাবে তিনি মায়ের সঙ্গে রঙ্গরসিকতা করতেন। নানান বায়না করতেন। মায়ের ভোগ দিলে তাঁকে খাইয়ে। পানদোক্তা জোগাড় করে ফিরে আসতেন। অন্য সময় বেদিতে পুজো হলেও কালীপুজোর দিন ঠিক রাত ১২টায় উদয়পুর কালীমন্দিরে কালীমূর্তি এনে রাতভর মায়ের পুজো হয়। মন্দিরের সামনেই দিঘি। একসময় এই মন্দিরে এত বলি হতো যে বলির রক্তে দিঘির জল লাল হয়ে যেত। এখনও বলি হয়, তবে তা সংখ্যায় আগের তুলনায় অনেক কম। পুজো উপলক্ষ্যে এখানে মেলা বসে। ছোট মন্দির কিন্তু পরিবেশটি বড়।
প্রাচীন রীতি মেনে তারাপীঠ মন্দিরের পূজারিরা রাতে মায়ের পুজো সেরে অন্নভোগ মুখে না দিয়েই চলে যান উদয়পুর কালীবাড়িতে। পরদিন সেখানে মায়ের পুজো দিয়ে প্রসাদ খেয়ে সারাদিন আনন্দ করে কাটান। সন্ধেবেলায় ফিরে আসেন তারাপীঠে। উদয়পুর গ্রাম তারাপীঠ মন্দির থেকে মাত্র তিন কিমি।
আটলা গ্রামের শ্যামাকালীর থান
বামদেবের পিতা সর্বানন্দ, মাতা রাজকুমারী দেবী ও দিদি জয়কালীর ভালোবাসার মাধুর্যে সিঞ্চিত হয়ে শিশু বামাচরণ তিলে তিলে বড় হচ্ছেন। সর্বানন্দ আত্মভোলা, সংসারের বিষয় আশয় সম্পর্কে উদাসীন। সময় পেলেই তিনি গ্রামের সিদ্ধস্থান কালীতলার শ্যামাকালীর থানে গিয়ে চুপটি করে বসে থাকেন। শ্যামাকালীর থানে বসে বড় শান্তি পান তিনি। তাঁর সামান্য জমি-জমা থেকে চাষবাস করে যেটুকু আয় হয় তা দিয়ে তিনি সংসার চালাবার চেষ্টা করতেন। কিন্তু সংসার তাতে চলতে চায় না। তবু সদানন্দ এই ব্যাপারে একেবারেই নির্বিকার ছিলেন। আটলা গ্রামের কালীতলায় গিয়ে শ্যামাকালীর চরণে বসলেই সব চিন্তার অবসান হতো। তাই সুযোগ পেলেই প্রাণভরে বেহালা বাজিয়ে সজল নয়নে গান শোনাতেন মাকালীকে। বড় মেয়ে জয়কালী ও বড়ছেলে বামাকেও কখনও কখনও সঙ্গে করে নিয়ে যান কালীতলায়। এই কালীই বর্তমানে আটলার খ্যাপাকালী নামে প্রসিদ্ধ। তারাপীঠে যাঁরা আসেন, তাঁরা অনেকেই বামদেবের জন্মস্থান দর্শন করতে আটলায় যান। খ্যাপাকালী মন্দিরটি আটলা গ্রামেই। বামদেবের জন্মভূমি ছাড়িয়ে আরও কিছুটা গেলে বাঁদিকে পড়ে। গ্রামের শেষ মাথায় একটি বটগাছের নীচে পাকা বেদির সামনে শিলামূর্তিতে আঁকা রয়েছে মায়ের মুখমণ্ডল। বেদির সামনে নাটমন্দির ও হাড়িকাঠ। মাঘ মাসের অমাবস্যার দিন পুজো উপলক্ষ্যে নীল রঙের প্রায় আট ফুট উচ্চতার মূর্তি এনে আরাধনা করা হয়। সেই সময়ে প্রায় দেড়শো থেকে দুশো ছাগ বলি হয়ে থাকে। এছাড়াও প্রতি মঙ্গল ও শনিবার মানতের বলিদান হয়। গ্রামের ভিতরে সেবায়েত ভট্টাচার্য পরিবারের বাসস্থান। একসময় খ্যাপাকালীর বেদির উপর একটি বটের ডাল সারাবছরই বেদি স্পর্শ করে থাকত। কিন্তু মায়ের বার্ষিক পুজোর দিন ওই বটের ডালটি সকাল থেকেই ক্রমশ উপরে উঠতে শুরু করত। এবং পুজোর আগে প্রায় আট থেকে দশ ফুট উঁচুতে উঠে যেত। কিন্তু অবাক করা কাণ্ড হল প্রতিমা বিসর্জনের পর পুনরায় পূর্বাবস্থায় ফিরে আসত বটের সেই মোটা ডালটি। তবে সেই ডালটি এখন আর নেই। ২০০৭ সালে মায়ের পাকা মন্দির হওয়ার পর ডালটি আপনা থেকেই ভেঙে যায়।
ঐতিহ্যময় মন্দিরটিও বামদেবের বড় প্রিয় ছিল। বলতে গেলে এখান থেকেই তাঁর সাধন জগতের হাতেখড়ি। খ্যাপাকালী মন্দিরে কার্তিক মাসের কালীপুজোর রাতে গোপনে অনুষ্ঠিত হয় তান্ত্রিক ভৈরবী চক্রানুষ্ঠান। তন্ত্রমতে, এই ক্রিয়াকলাপ অত্যন্ত গোপনীয় এবং সেই সঙ্গে অতি পবিত্র। এতে সিদ্ধ বীরাচারী সাধকরাই কেবল অংশগ্রহণ করতে সক্ষম। তন্ত্রসিদ্ধ মহাপুরুষ খাঁকিবাবা, বামাখ্যাপা, সিদ্ধভৈরব অঘোরী বাবা, গুহাবাবা, ব্রহ্মানন্দ সরস্বতী প্রমুখ সাধক মানব কল্যাণের জন্য তারাপীঠ ও বক্রেশ্বরে এই চক্রানুষ্ঠান করতেন। এই মন্দির ও তার সংলগ্নস্থানে বেশ কিছু কুকুরের দেখা পাওয়া যায়। এদেরকে কেউ মারে না, তাড়ায়ও না। এরা সব ভৈরব। তাই দর্শনার্থীরা এই সারমেয়দের খাবার দিয়ে তৃপ্ত করে।
আকালীপুরের গুহ্যকালী
মন্দিরে অধিষ্ঠিত মহারাজ নন্দকুমার প্রতিষ্ঠিত বিরল দর্শন দ্বিভুজা গুহ্যকালী বিগ্রহ। এই কালীমূর্তির মতো মূর্তি আর কোথাও দেখা যায় না। যেমনই ভীষণা তেমনই ভয়ঙ্কর দর্শনা। এই দেবীমূর্তির সঙ্গে জড়িয়ে আছে মহাভারতের জরাসন্ধ, বিদেশি শাসক ওয়ারেন হেস্টিংস, কাশীর রাজা চৈত সিং ও মাতৃসাধক বামাখ্যাপার নাম। অতীতে দেবী মগধরাজ জরাসন্ধের পূজিতা গৃহদেবী ছিলেন। পরবর্তীকালে কাশীরাজ চৈত সিংয়ের রাজমন্দিরে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। তারপর ইংরেজ শাসনকালে ওয়ারেন হেস্টিংসের সময় কাশী আক্রান্ত হলে এই দেবীকে লন্ডনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। এই খবর বিশ্বস্ত কর্মচারীর কাছ থেকে শোনা মাত্র কাশীরাজ বিলম্ব না করে দশাশ্বমেধ ঘাটের কাছে একটি গোপন স্থানে দেবীকে লুকিয়ে রাখেন। পরবর্তীকালে মহারাজ নন্দকুমার দেবীর স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে মাতৃমূর্তি উদ্ধার করে জলপথে নৌকা করে ব্রাহ্মণী নদী দিয়ে তাঁর নিজ জন্মভূমি ভদ্রপুরে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন। সেই সময় সম্ভবত গঙ্গার সঙ্গে ব্রাহ্মণী নদীর সংযোগ ছিল। নৌকা করে ব্রাহ্মণী নদী দিয়ে আসার সময় মহারাজ নন্দকুমার লক্ষ করেন যে, নৌকাটি তাঁর গ্রাম ভদ্রপুরে না থেমে দ্রুতগতিতে সামনের দিকে ভেসে আকালীপুরের অরণ্যবেষ্টিত শ্মশানঘাটের কাছে এসে আপনা আপনিই থেমে যায়। মহারাজা বুঝলেন, এখানেই অবস্থান করা দেবীর ইচ্ছা। তখন তিনি শ্মশানের পাশে পঞ্চমুণ্ডির বেদি স্থাপন করে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করেন। রামপুরহাট-নলহাটি রাস্তার নাগোরা মোড় থেকে আকালীপুর মাত্র ৫ কিমি।
ব্রাহ্মণী নদীর তীরে আকালীপুর গুহ্যকালীর দেবীমূর্তি নানান কিংবদন্তিতে পূর্ণ। অষ্টকোণ বিশিষ্ট মন্দিরে দেবীর অবস্থান। গর্ভমন্দিরের তিনটি দরজা। দক্ষিণ দিকের দরজাই প্রধান। এছাড়া পূর্ব-পশ্চিমদিকে আরও দু’টি দরজা রয়েছে। দেবীর বিগ্রহ তিনটি প্রবেশদ্বার দিয়েই দেখা যায়। দেবী পঞ্চমুণ্ডির আসনের উপর নাগের মস্তকে বিরাজ করছেন।
দেবীর কালো অঙ্গে সর্পের অলঙ্কারের ছড়াছড়ি। দু’টি কর্ণে অলঙ্কার রূপে রয়েছে দুটি শব শিশু। মস্তকে সহস্র নাগের কিরীট। বাঁ কাঁধে সর্পের যজ্ঞোপবীত। দুই হাতে সর্পবলয় ও কোমরে সাপের কোমরবন্ধনী। অন্যান্য কালীমূর্তির সঙ্গে একটিই মিল খুঁজে পাওয়া যায়, সেটি হল এই দেবীর গলায়ও রয়েছে নৃমুণ্ডমালার সঙ্গে রক্তজবার মালা। দেবী ত্রিনয়না, করালবদনা, লোলজিহ্বাময়ী ও ভয়ঙ্করী। দেবীর দু’টি হাতই বরাভয় মুদ্রায় রয়েছে। চোখগুলি দীর্ঘায়তা। আকালী কালীকে যেকোনও দিক থেকেই দর্শন করা যাক না কেন মনে হবে দেবী যেন তার দিকেই বিস্ফারিত নেত্রে তাকিয়ে আছেন।
মন্দির থেকে মাত্র ৬০-৭০ হাত দূরে আকালীপুরের প্রাচীন শ্মশানক্ষেত্র, তারপরেই নদী। গ্রামের নামের সঙ্গে দেবী বিগ্রহের নামটিও আকালী কালী। সাধক বামাখ্যাপা মাঝেমধ্যেই এখানে এসে মাকে দর্শন করে তাঁর সঙ্গে রহস্যময় আলাপ করতেন। যেমন বলতেন, ‘কীরে বেদের বেটি, কেমন আছিস?’ তিনি আকালীকালীকে বেদের মেয়ে নামেই সম্বোধন করতেন। তবে তিনি কখনওই এখানে কিছু মুখে দিতেন না এবং রাত্রিবাস করতেন না। মায়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে রাত গভীর হলেও সেই রাতেই তিনি পায়ে হেঁটে ফিরে যেতেন বত্রিশ কিমি দূরবর্তী তারাপীঠে।
বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী, দেবনাথ দাস