প্রায় সম্পূর্ণ কাজে আকস্মিক বিঘ্ন আসতে পারে। কর্মে অধিক পরিশ্রমে স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা। ... বিশদ
‘রটন্তী কালী!’ কৌতূহলী প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানালেন, রটন্তী শব্দের মধ্যে রয়েছে রটে যাওয়া কথাটি। রটে যাওয়া অর্থাৎ মুখে মুখে প্রচারিত হওয়া। কিন্তু কী রটেছিল সেটা জানতে আমাদের ফিরে যেতে হবে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের কাহিনিতে।
কৃষ্ণের বাঁশির আওয়াজ শুনে শ্রীরাধিকা ঘরে থাকতে পারেন না, ছুটে যান কুঞ্জবনে। এদিকে শাশুড়ি জটিলা ও ননদ কুটিলা অনেকবার এই ঘটনার সাক্ষী থেকেছেন। কিন্তু তারা কখনওই রাধার স্বামী আয়ান ঘোষকে তা বিশ্বাস করাতে পারেননি। সেদিন ছিল মাঘ মাসের কৃষ্ণাচতুর্দশী। কৃষ্ণের বাঁশির আওয়াজ শুনে শ্রীরাধিকা বাড়ি ছাড়েন। হাতেনাতে ধরার জন্য গোপনে পিছু নেন জটিলা, কুটিলা। আয়ান ঘোষকে সঙ্গে করে নিয়ে যান কুঞ্জবনে। উদ্দেশ্য, আয়ানকে বিশ্বাস করাতেই হবে শ্রীরাধিকার গোপন প্রেমের কাহিনি।
তাঁদের আসতে দেখে শ্রীরাধিকা কলঙ্কের ভয়ে ভীত হয়ে পড়লেন। শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে বরাভয় প্রদান করেন। কালীরূপ ধারণ করলেন শ্রীকৃষ্ণ। সেই রূপে দেবীর চারটি হাত। এক হাতে বরাভয়, দু’হাতে বাঁশি, আর এক হাতে খড়্গ। গলায় বনমালা। শ্রীরাধা সেই কালীরূপের পুজো শুরু করলেন। আয়ান ঘোষ ছিলেন শক্তির উপাসক, কালীর পূজারি। শ্রীরাধাকে কালীপুজো করতে দেখে আপ্লুত হয়ে গেলেন আয়ান ঘোষ। সেদিন শ্রীরাধা রটনা বা কলঙ্কের হাত থেকে বাঁচার জন্য কালী রূপধারী শ্রীকৃষ্ণ অর্থাৎ কৃষ্ণকালীর পুজো করেছিলেন। মাঘ মাসের কৃষ্ণাচতুর্দশী তিথিতে শ্রীকৃষ্ণ ও কালীর মিশ্ররূপের নতুন বিগ্রহ পুজোর সূচনা করলেন শ্রীরাধা। নাম মাহাত্ম্যেই বোঝা যায়, দেবী রটনা অর্থাৎ কলঙ্কনাশিনী দেবী। শ্রীরাধার প্রেম-কলঙ্ক ভঞ্জনের পুজো পরিণত হল অপবাদ-নিন্দা-কলঙ্ক দূরে রাখার পুজোতে। দেবীর নাম হল ‘রটন্তী কালী’। গুসকরা শ্মশানঘাটের বিপরীতে একদালান বিশিষ্ট রটন্তী কালীমন্দির। আনুমানিক ১২৬৫ বঙ্গাব্দে সাধক মহাবিষ্ণু চোংদার রটন্তী পুজো উপলক্ষ্যে মেলার সূচনা করেন। সেই থেকে পুজো ও মেলা আজও চলে আসছে।
স্থানীয় ওই বাসিন্দাই জানালেন, রতন খ্যাপা নামে এক সিদ্ধ তান্ত্রিক গুসকরায় এই পুজোর প্রচলন করেছিলেন। শ্মশানের একপাশে জোড়া তালগাছ দেখিয়ে উনি বললেন, ‘এখানেই ছিল সেই তান্ত্রিকের সাধনক্ষেত্র। তান্ত্রিকের দেহরক্ষার পরে দেবীপুজোর ভার পড়ে চোংদার জমিদারদের উপর।’ দেবী যে রটন্তী কালী নামে পরিচিত হলেন তার আরও এক কিংবদন্তি আছে। রতন খ্যাপাই ছিলের স্বামী বিশুদানন্দ। প্রতিদিন রাতে তিনি শ্মশানে যেতেন সাধনভজন করতে। সাধারণ মানুষ রতন খ্যাপা ওরফে স্বামী বিশুদানন্দকে খুব ভালোবাসত। রোগ নিরাময়ের জন্য তারা তান্ত্রিক সাধকের কাছে যেত। তিনি তাদের চিকিৎসা করতেন। বেশিরভাগ লোকই সুস্থ হয়ে উঠত। রতন খ্যাপার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে কয়েকজন পুরোহিত আর রাজকর্মচারী সমানে চোংদার জমিদারদের কান ভাঙানো শুরু করে। বাস্তবে যেমনটা হয়। চোংদাররা সেইসব কুটিল মানসিকতার লোকেদের একই কথা শুনতে শুনতে বিশ্বাস করতে শুরু করেন। রতন খ্যাপার গতিবিধিতেও সন্দেহ হয় চোংদার জমিদারদের। একরাতে কয়েকজন গোপনে রতন খ্যাপাকে অনুসরণ করলেন। ঘটনাচক্রে সেই দিনটি ছিল মাঘী কৃষ্ণাচতুর্দশী। শ্মশানে পৌঁছে তাঁরা ভয়ঙ্কর দর্শনা দেবীকে দেখে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যান। জ্ঞান হারাবার আগে তাঁরা দেখেন, রতন খ্যাপা কালীভজনায় রত। তান্ত্রিক সাধকই তাঁদের শুশ্রুষা করেন। জ্ঞান ফিরতে তাঁরা রতন খ্যাপার পা জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চান। মাঘী কৃষ্ণাচতুর্দশীর
গর্ভগৃহের পঞ্চমুণ্ডির আসনের উপর উঁচু বেদিতে চতুর্ভুজা মা রটন্তী কালী শিবের বুকের উপর দাঁড়িয়ে। প্রসন্নতা ও কারুণ্যে ভরা মায়ের এমন মুখ খুব কমই দেখা যায়।
প্রতিবছর মাঘ মাসের রটন্তী চতুর্দশীতে মাটি দিয়ে মায়ের বিগ্রহ নির্মাণ করা হয়। সাতদিন ধরে পুজো হয়। পুজোর পরে মায়ের বিসর্জন হয় পাশের কুনুর নদীতে। বিসর্জনের পর প্রতিমার গা থেকে মাটি ধুয়ে গেলে কাঠামোটি আনা হয় মন্দিরে। সেখানে মাটি দিয়ে শুধুমাত্র দেবী বিগ্রহ ও মহাদেবের মুখমণ্ডল তৈরির পর কাঠামোর বাকি অংশ কাপড় পরিয়ে সারা বছর পুজো করা হয়।
শাক্তদের এটি বিশেষ দিন। শ্রীকৃষ্ণের জীবনের সঙ্গে জুড়ে যাওয়ায় বৈষ্ণবদের কাছেও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। আবার এই চতুর্দশী তিথির সঙ্গে যোগ রয়েছে মহাদেবের। তাই শৈবদের কাছেও এই দিনটির গুরুত্ব অপরিসীম। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরেও এদিন একসঙ্গে পুজো হয় মা ভবতারিণী, রাধাকৃষ্ণ ও মহাদেবের। কথিত আছে, শ্রীরামকৃষ্ণদেব একবার বলেছিলেন, ‘রটন্তী কালীপুজোর ভোরে দেখলাম, দক্ষিণেশ্বরের গঙ্গায় স্বর্গ থেকে দেবতারা নেমে এসেছেন স্নান করতে।’
সেই কারণে আজও বহু মানুষ দক্ষিণেশ্বরের গঙ্গার তীরে রটন্তীর ভোরে পুণ্যস্নান করতে আসেন।
রটন্তী চতুর্দশীতে বাংলায় শ্যাম ও শ্যামার সম্মিলিত কালীরূপের উপাসনা করা হয়। বাংলা ভাষায় রটন্তী কালীর প্রথম বন্দনাটি গেয়েছিলেন কবি-সাধক রামপ্রসাদ সেন—
‘তেমনি তেমনি তেমনি করে নাচ দেখি মা!
ব্রজে যেমন নেচেছিলে হয়ে বনমালী—
অসি ছেড়ে বাঁশী লয়ে,
মুণ্ডমালা ছেড়ে বনমালা ধরে,
তেমনি করে নাচ দেখি মা!’