প্রায় সম্পূর্ণ কাজে আকস্মিক বিঘ্ন আসতে পারে। কর্মে অধিক পরিশ্রমে স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা। ... বিশদ
কবি জীবনানন্দ দাশের ‘রূপসী বাংলা’র ‘কতদিন সন্ধ্যার অন্ধকারে’ কবিতায় আছে হেমন্তের পল্লিবাংলার আকাশ প্রদীপের কথা। গ্রামে অনেকে আকাশ প্রদীপকে ‘ফানুস’ বলে। ‘ফানুস’ শব্দটির উৎস গ্রিক শব্দভাণ্ডার। যার অর্থ মোমবাতি। ফানুস নামক বাতি জ্বেলে অভিবাদন করার প্রথা ছিল প্রাচীন মিশরে। শোনা যায় তারও আগে নাকি ফ্যারাওরা সাইরিয়াস নামে নক্ষত্রের উদয়কালে উৎসব পালন করতেন। সেই উৎসবে যে মশাল ব্যবহৃত হতো সেটাই নাকি ফানুস। হিন্দুদের পাশাপাশি বৌদ্ধদের কাছেও আকাশদীপ জ্বালানো এক জনপ্রিয় উৎসব। এই উৎসবে তারা ফানুসও ওড়ায়। আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা তিথিতে সিদ্ধার্থ সংসার ত্যাগ করেছিলেন। সেই সময় তাঁর সঙ্গী ছিলেন ছন্দক। অনোমো নদীর তীরে পৌঁছনোর পর ওখানেই তাঁরা রাজপোশাক খুলে ফেলেন। এরপর সিদ্ধার্থ তলোয়ার দিয়ে নিজের চুল কেটে সেই চুল আকাশে নিক্ষেপ করলেন। দেবরাজ ইন্দ্র স্বর্গে সেই চুলগুলি সংগ্রহ করে একটি সোনার ঝুড়িতে ঢাকা দিয়ে রাখেন। দেবরাজ ইন্দ্রের সংরক্ষিত সিদ্ধার্থর চুলের স্মরণেই বৌদ্ধরা আকাশ প্রদীপ দেখান।
আকাশ প্রদীপ তৈরি হয় বাঁশের বাঁখারি, সরু তার বা সুতো দিয়ে। এছাড়া পাতলা রঙিন কাগজ, আঠা, সুতলি দড়ি, একটা লোহার এস, আর একটা বাঁশও দরকার। বাঁশটি প্রথমে ফাটিয়ে প্রায় দেড় ফুট মাপের চারটে সরু গোলাকার দণ্ড কেটে বার করতে হয়। ছয় ও আট ইঞ্চির মতো বত্রিশটি সরু কাঠি বার করতে হয়। সেগুলি রীতি অনুসারে বেঁধে রঙিন কাগজে মুড়ে দেওয়া হয়। রঙিন কাগজটা আঠা দিয়ে ভালো করে সাঁটতে হয় যাতে খুলে না যায়। ভিতরে থাকে বাতি বা প্রদীপ দেওয়ার স্ট্যান্ড। বাঁশের মাথায় দড়ি দিয়ে লোহার এসটি বেঁধে সেখান থেকে আকাশ প্রদীপটি ঝোলানোও হয়। স্থানীয় মালাকাররা আগে নিজের হাতে আকাশ প্রদীপ তৈরি করতেন। আকাশ প্রদীপ এখন প্রায় অবলুপ্তির পথে। বর্তমানে তৈরি করা আকাশদীপের বদলে নানা রকমের বৈদ্যুতিক বাতিতে বাড়ি সাজানো হয় কার্তিক মাস জুড়ে।
হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, পূর্বপুরুষরা আসেন মহালয়ার দিন তিল তর্পণের জল নিতে। কালীপুজোর অমাবস্যার দিন তাঁদের ফিরে যাওয়ার পালা। পরলোক যাত্রায় তাঁদের পথ দেখানোর জন্যই আকাশ প্রদীপ জ্বেলে রাখা হয় সারারাত। আবার এই প্রদীপ জ্বেলে আবাহন করা হয় পিতৃলোকে, প্রেতলোকে থিতু হওয়া পূর্বপুরুষদেরও। সেই আলো পথ ধরে যাতে তাঁরা আশীর্বাদ দিতে আসতে পারেন তাঁদের উত্তরসূরিদের। প্রদীপ জ্বালানোর সঠিক সময় হল যখন সদ্য বিকেল শেষে অন্ধকার নামে। আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রতি আমরা সদা শ্রদ্ধাশীল। এই শ্রদ্ধা, যত্ন মিশে রয়েছে ওই সাঁঝবেলায় জ্বালিয়ে রাখা আকাশ প্রদীপে।
আকাশ প্রদীপের মধ্যেও রয়েছে নানা নিয়ম। দ্বিমুখী প্রদীপ জ্বালানো হয় ঈশ্বরের কৃপা এবং দীর্ঘজীবন লাভের জন্য। ত্রিমুখী প্রদীপের আলোতে শত্রুর কু-নজর এড়ানো যায় আর চতুর্মুখী আলো জ্বালানো হয় সন্তানের দীর্ঘজীবন কামনা করে।
প্রদীপ আসলে আমাদের দেহেরই প্রতীক। আকাশ প্রদীপ আসলে মানুষের নশ্বর শরীরের মতো ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম—এই পঞ্চভূতে তৈরি। ক্ষিতি বা মাটি তার কায়া তৈরি করে। অপ অর্থাৎ জলে তা আকার পায়। তেজ অর্থাৎ আগুন, আত্মার মতোই স্থিত হয় তার অন্তরে। মরুৎ বা হাওয়া সেই আগুনকে জ্বলতে সহায়তা করে। আর ব্যোম অর্থাৎ অনন্ত শূন্য জেগে থাকে প্রদীপের গর্ভে।
কার্তিক মাসে এই আকাশ প্রদীপ জ্বালানোর পিছনে আরেকটি কারণ আছে। বলা হয়, ভগবান বিষ্ণু পরম সন্তোষ লাভ করেন যদি কার্তিক মাসে মন্দিরে বা বাড়িতে প্রদীপ জ্বালানো হয়। কার্তিক মাসে নিয়ম করে রাধাকৃষ্ণ মন্দিরে প্রদীপ প্রজ্বলনে নাকি পাপক্ষালন হয়। এতে শুধু নিজের নয়, সমাজেরও মঙ্গল হয়।
শাস্ত্রে আছে আশ্বিনের সংক্রান্তি থেকে কার্তিক মাসের সংক্রান্তি পর্যন্ত প্রতিদিন সাঁঝবেলায় এই প্রদীপ দেওয়া হয় ভগবান বিষ্ণু এবং মা লক্ষ্মীকে কৃতজ্ঞতা ও সম্মান জানানোর জন্য।
শীতের সময় মানুষের অগ্নিসঞ্চয়ের অভ্যাসও নিহিত রয়েছে আকাশ প্রদীপে। যা অনেক পরে রূপান্তরিত হয়েছে ব্রাহ্মণদের অগ্নিহোত্র রক্ষার আচারে। বড় কাঠ দিয়ে যজ্ঞ উপযোগী এক পুরুষপ্রমাণ দণ্ড তৈরি করা হয়। ওই দণ্ডে যবাঙ্গুল পরিমাণ ছিদ্র করা হয়। তাতে লাগানো হয় দু’হাত পরিমাপের রক্তবর্ণের পট্টি। অষ্টকোণযুক্ত সেই পট্টির ভিতরে রাখা হয় আমাদের দেহের প্রতীক একটি প্রদীপকে। প্রদীপটি স্থাপন করার সময় মন্ত্র উচ্চারণ করা হয়— ‘দামোদরায় নভসি তুলয়ং লোলহ সহ / প্রদীপং তে প্রযচ্ছামি নমোঽনন্তায় বেধসে।’ এর অর্থ হল কার্তিক মাসে লক্ষ্মী দেবীর সঙ্গে দামোদরের উদ্দেশেও আমি আকাশে এই প্রদীপ দিচ্ছি। বেধ অনন্তকে নমস্কার।
আকাশ প্রদীপ জ্বালানোর সময় অনেকে বলেন, ‘নিবেদ্য ধর্ম্মায় হরায় ভূম্যৈ দামোদরায়পাথ ধর্ম্মরাজে। প্রজাপতিভ্যত্ত্বথ সৎপিতৃভ্যঃ প্রেতেভ্য এবাথ তমঃ স্থিতেভ্যঃ।’ অর্থাৎ আকাশ প্রদীপটি লক্ষ্মী নারায়ণকে নিবেদন করার পাশাপাশি আবাহন করা হয় পিতৃলোক, প্রেতলোকে থিতু হওয়া পূর্বপুরুষদেরও।