প্রায় সম্পূর্ণ কাজে আকস্মিক বিঘ্ন আসতে পারে। কর্মে অধিক পরিশ্রমে স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা। ... বিশদ
শিকলে কালী, লালগোলা, মুর্শিদাবাদ
প্রায় আড়াইশো বছর আগে, মহারাজা যোগীন্দ্রনারায়ণ লালবাগ মহকুমার লালগোলায় তাঁর প্রাসাদের অল্প দূরেই নির্মাণ করেন এই কালী মন্দির। মহারাজা যোগীন্দ্রনারায়ণের এই কালীপ্রাপ্তির ব্যাপারে দু’টি মত শোনা যায়। প্রথম ঘটনা অনুযায়ী, অবিভক্ত বাংলাদেশের কোনও এক জমিদারবাড়িতে দেবীর নিত্যপুজো হতো। আর্থিক বা অন্য কোনও কারণে অপুত্রক জমিদার মনস্থির করলেন তীর্থাবাস করবেন। তাই যাওয়ার আগে সেই দারুবিগ্রহ দান করে গেলেন যোগীন্দ্রনারায়ণকে। সেই মূর্তি নৌকাযোগে এনে মন্দির নির্মাণ ও বিগ্রহ স্থাপন করে নিত্যপুজোর স্থায়ী ব্যবস্থা করলেন যোগীন্দ্রনারায়ণ, যা চলছে আজও। অন্যমতে, বর্তমান কালীমন্দির সংলগ্ন কলকলি দিঘি একসময় যুক্ত ছিল পদ্মার সঙ্গে। স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে যোগীন্দ্রনারায়ণ জানতে পারেন ওই দিঘিতে জলমগ্ন দেবীর অবস্থিতি। পরে তিনি বিগ্রহ উদ্ধার করে স্থাপন করেন মন্দিরে। জনশ্রুতি অনুযায়ী, বিগ্রহ প্রথম প্রতিষ্ঠার সময় ছাগবলি হয় ১০৮টি। সেই রক্তভেজা আঙিনার দিকে দেবী এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুরোহিত নাকি শিকল বেঁধে দেন দু’হাতে। সেইজন্যই দেবীর হাতদু’টি জোড়বদ্ধ। এই কালীই ‘শিকলে কালী’ নামে জনপ্রিয়।
বর্গভীমা, তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর
৫১পীঠের অন্যতম তমলুকের দেবী বর্গভীমাকে নিয়ে লোকশ্রুতি বা গবেষণার শেষ নেই। মঙ্গলকাব্য অনুসারে, এক সওদাগর সিংহল যাওয়ার পথে তমলুক বন্দরে নোঙর করেন। সেই সময় এক ব্যক্তিকে স্বর্ণকলস নিয়ে যেতে দেখেন তিনি। সওদাগর ওই ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করতে তিনি জানান, এখানেই জঙ্গলের ভেতর একটি কুয়ো রয়েছে, যার জলে পিতলের কলস ডোবালেই তা সোনার হয়ে যায়। এই কথা শুনে অনেক পিতলের কলসি কিনে তা ওই জলে ডুবিয়ে সোনা বানিয়ে তা বিক্রি করে বিপুল লাভবান হয়েছিলেন সওদাগর। তাই ফেরার পথে তিনি কুয়োর পাশেই বর্গভীমা মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন।
আবার অন্য এক কাহিনিতে রয়েছে, তাম্রলিপ্তে ময়ূরবংশের দ্বিতীয় রাজা তাম্রধ্বজকে এক মেছুনি জঙ্গল পেরিয়ে মাছ দিতে আসত। সেই সময় মাছগুলোকে সতেজ রাখতে একটি গর্ত থেকে জল নিয়ে ছিটিয়েছিল সে। এর পরেই মাছগুলি আবার জীবন্ত হয়ে যায়। খবর পেয়ে রাজা এসে ওই জায়গায় একটি দেবীমূর্তি দেখতে পান এবং তিনি মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। অনেকে বলেন, ধীবর সম্প্রদায়ের আরাধ্যা ‘ভীমা’ দেবীই ‘বর্গভীমা’।
কেউ কেউ আবার বলেন, তাম্রলিপ্তের ময়ূরবংশের রাজা চতুর্থ গরুড়ধ্বজ প্রতিদিন তাজা শোলমাছ খেতেন। কিন্তু ধীবর প্রতিদিন তাজা মাছ সরবরাহ করতে ব্যর্থ হলে তাকে মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ দেওয়া হয়। এর পর ধীবর স্বপ্নাদেশ পান যে, অনেক শোল ধরে সেগুলিকে শুকনো করে রাখতে হবে। পরে জঙ্গলের একটি কুয়োর জল ছিটিয়ে দিলেই সেগুলি আবার জীবন্ত হয়ে উঠবে। এভাবে রাজাকে মাছ সরবরাহ করতে থাকলে রাজার সন্দেহ হয় এবং তিনি ধীবরকে তাজা মাছের রহস্য জানতে চাইলে সেই কুয়োর কথা সবাই জেনে যায়। রাজা এসে দেখেন, ওই কুয়োর উপর ভেসে রয়েছে এক দেবীমূর্তি। তখনই তিনি দেবী বর্গভীমার মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে জানা যায়।
দেবী বর্গভীমা চতুর্ভুজা। নীচে রয়েছে শায়িত শিবের মূর্তি। মায়ের ডানহাতের উপরটিতে রয়েছে খড়্গ আর নীচেরটিতে ত্রিশূল। উপরের বাম হাতে খর্পর আর নীচের হাতে মুণ্ড। বর্গভীমার দু’পাশে শোভা পাচ্ছে দশভুজা মহিষমর্দিনী ও দ্বিভুজা মহিষমর্দিনী মূর্তি।
ধন্বন্তরী কালী, জয়নগর, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার জয়নগর মজিলপুর এলাকার প্রাচীন কালী ধন্বন্তরী। কথিত আছে, ৪০০ বছরের পুরনো এই মন্দিরে দেবীর স্বপ্নাদেশ থেকে পাওয়া ওষুধ দেওয়া হয়। যা খেয়ে অসুস্থ, রোগে কাতর ভক্তরা সুস্থ হয়ে যান। ভক্তদের বিশ্বাস, গ্যাস, অম্বল থেকে শুরু করে বহু ভয়ানক রোগ দেবীর কৃপায় সেরে যায়। সেই কারণেই দেবীর নাম ধন্বন্তরী। ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে আদিগঙ্গার তীরবর্তী অঞ্চলগুলো ছিল গভীর জঙ্গলাকীর্ণ ও নিরিবিলি। ফলে লোকালয় থেকে দূরে সেই সব স্থানেই তন্ত্রসাধকরা গড়ে তুলেছিল শক্তিসাধনার ক্ষেত্র। তেমনই এক সাধনক্ষেত্র আজকের ধন্বন্তরী কালী বাড়ি।
আজকে যেখানে ধন্বন্তরি কালী মন্দিরটি, আগে সেখানে শ্মশান ছিল। সে সময় জনৈক ভৈরবানন্দ নামে এক তান্ত্রিক গঙ্গার মাঝে তৈরি হওয়া চড়ার উপর বসে সাধনা করতেন। বর্তমানে যেখানে মজিলপুরের ধন্বন্তরী কালী মন্দির অবস্থিত, সেখানেই ছিল তান্ত্রিক ভৈরবানন্দের সাধনক্ষেত্র। পরবর্তীকালে তিনি ডায়মন্ডহারবারের নেতরা গ্রামের জনৈক রাজেন্দ্র চক্রবর্তীকে মজিলপুরে নিয়ে এসে, তাঁকে নিজের আরাধ্য কালীমূর্তি পুজোর দায়িত্ব দেন। সেই সময়েই একদিন রাজেন্দ্রলালকে স্বপ্নে দেখা দেন দেবী ধন্বন্তরী। পুকুরের কাছে পড়ে থাকা একটি নিমকাঠ থেকে দেবী বিগ্রহ তৈরির আদেশ দেন। নির্মিত হয় নিমকাঠের বিগ্রহ। আজও নিমকাঠের বিগ্রহ পূজিত হচ্ছে মন্দিরে। রাজেন্দ্র চক্রবর্তীর সাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে মা কালী তাঁকে একটি বাতের ওষুধ দেন, যা পানের মধ্যে দিয়ে খেলে বাত সেরে যায়। ধন্বন্তরীর মতো ওই ওষুধ কাজ করত বলে কালী বিগ্রহটি ধন্বন্তরী নামে পরিচিত হয় আর মন্দিরের নাম হয় ধন্বন্তরী কালী বাড়ি।
নাককাটা কালী, পাঁড়ে গলি, পুরুলিয়া
পুরুলিয়া শহরের সাত নম্বর ওয়ার্ডের মধ্য-পল্লির পাঁড়ে গলির একেবারে শেষ প্রান্তে নাককাটা কালী মন্দির। কথিত আছে, আজ থেকে প্রায় দু’শো বছর আগে এই এলাকা ছিল জনমানবহীন। এলাকা জুড়ে ছিল বিঘের পর বিঘে ধান জমি। কালীপুজোর আগে এক রাতে ডাকাত দল এই এলাকায় হামলা চালাতে জড়ো হয়। আমন ধান কেটে লুঠ করার ছক কষে। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ান মা শ্যামা। ডাকাত দল তখন ক্ষুব্ধ হয়ে তলোয়ার দিয়ে মায়ের নাক কেটে দেয়। তারপর থেকেই টিলার ওপরে পাথরের মূর্তিকে পুজো করা হয়। পাথরের গায়ে মায়ের যে অবয়ব ফুটে উঠেছে সেখানে শ্যামার নাক কাটা। আজও অতীতের রেওয়াজ মেনে মা এখানে পুজো পান। তবে কার্তিকের অমাবস্যায় শুধু নয়, ফি-সপ্তাহের মঙ্গল ও শনিবার এই পাথরের মূর্তিতে পুজো হয়। হয় বলিও।
শকুন্তলা কালী, কোন্নগর, হুগলি
শতাব্দীপ্রাচীন এই শকুন্তলা মায়ের পুজো শুরু করে একদল ডাকাত। ঠগি ও ডাকাতে ভরপুর ছিল গঙ্গা তীরবর্তী এই অঞ্চল। আজকের কোন্নগর ছিল ঘন বনজঙ্গলে ঢাকা এলাকা। জঙ্গলের মধ্যে এলাকা ভাগ-ভাগ করে ছিল বিভিন্ন ডাকাত আর ঠগিদের ডেরা। বৈশাখ মাসের কৃষ্ণা তৃতীয়া বা তার ঠিক পরের শনিবার রাতে এই কালীকে পুজো দিয়ে সারা বছরের মতো ডাকাতির ব্যবসা শুরু করত ডাকাত ও ঠগির দল। মস্ত অশ্বত্থ গাছের নীচেই ছিল মায়ের থান। সেই সময় এই থানেই পড়ে থাকত রক্তমাখা হাড়িকাট। গাছের ওপরে বাস করত দলে দলে শকুন, তাই এই থানের আরেক নাম শকুন্তলা মায়ের থান। সেই থেকে মায়ের নামও শকুন্তলা রক্ষাকালী মাতা। কালীপুজোর রীতি ও নিয়ম বেশ প্রাচীন। কথিত আছে, দেবী সূর্যের মুখ দেখেন না। তাই নিয়ম মতো মূর্তি বানানো হয় সূর্যাস্তের পর। দ্বিতীয় প্রহর শেষ হলে পুজো শুরু আর সূর্যোদয়ের আগেই দেবীর বিসর্জন হয়। পশুবলির রীতিও রয়েছে প্রথম থেকেই। এক সময়ে হাজার হাজার ছাগ বলি হতো এক রাতে। আজ সে সংখ্যাটাও নেহাত কম নয়।
মহিষখাগী কালী, শান্তিপুর, নদীয়া
শান্তিপুরের বিখ্যাত কালী হল মাতা মহিষখাগী। আনুমানিক ৫৫০ বছর পূর্বে কোনও এক তান্ত্রিক পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসে সাধনা করতে করতে মায়ের রূপ দেখতে পান, সেই থেকেই এই পুজোর সূচনা। কিন্তু সেই তান্ত্রিকের নাম আজও জানা যায়নি। বহুপূর্বে এখানে মহিষ বলি হতো। সেই থেকেই এই মায়ের নাম মহিষখাগী। একবার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র আটটি মহিষ বলি দিতে এসেছিলেন এই মায়ের কাছে এবং তা সম্পন্ন করতে পরের দিন ভোর হয়ে যায়। সেই থেকেই এই পুজো দুই পর্যায়ে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। পুজো বলির আগে পর্যন্ত প্রথম অংশ এবং দ্বিতীয় ভাগ বলিদান পরবর্তী সময়ে হতো। কিন্তু এখন বলি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এক আসনে পুজো সম্পন্ন হয়। মাকে প্রথম পাটে ওঠানোর দিনে থাকে বিভিন্ন নিয়মরীতি। তার পরে মন্দির প্রাঙ্গণ পরিষ্কার করে সেদিন ভোররাতে হয় দধিমঙ্গল। তারপরে অমাবস্যা শুরু হলে বিবাহ রীতি মেনেই পুজো করা হয় মাকে। পরের দিন পালন করা হয় বাসি বিয়ের রীতি। পুজো সম্পন্ন হওয়ার পর কাঁধে করে নিয়ে যাওয়া হয় মাকে বিসর্জনের জন্য।
সাতভাই কালী, বনগাঁ, উত্তর চব্বিশ পরগণা
আজ থেকে প্রায় ১৬০ বছর আগে বনগাঁয় ইছামতী নদীর তীরে গভীর জঙ্গলে সাত ডাকাত ভাই একটি বটগাছের নীচে কালীমূর্তি পুজো করত। তারপর তারা ডাকাতি করতে যেত। সাতভাইয়ের প্রতিষ্ঠিত কালীবিগ্রহ বলেই সম্ভবত সাতভাইয়ের কালী থেকে বর্তমানে নাম দাঁড়িয়েছে ‘সাতভিয়া কালী’। সপ্তদস্যু ও তাদের এক ভগিনীর একনিষ্ঠ পূজার্চনায় দেবী এখানে জাগ্রত হয়েছিলেন। তাই আজও এই দেবীস্থান পবিত্র বলে বিবেচিত হয়।
বর্তমানে সেই বটগাছের নীচে সুন্দর মন্দির নির্মাণ করে দেবীরনিত্য আরাধনা করা হয়। কিন্তু ডাকাতদের দ্বারা পূজিতা দেবী কালিকার বিগ্রহটি এখন আর নেই। সেটি নাকি গাছের ভিতর বিলীন হয়ে গিয়েছে কিংবা রুদ্ধ হয়ে আছে। বর্তমানে সেই জায়গায় বটগাছের গুঁড়িতে মায়ের মুখের আদলে এক অপরূপা মূর্তি করা হয়েছে। চার হাত বানানো হয়েছে গাছের চারটি ডাল দিয়ে। হাতে পরানো হয়েছে শাঁখা, পলা ও সোনার চুড়ি। কালো মুখে রুপোর ত্রিনয়ন বসিয়ে ত্রিনয়নী রূপ দেওয়া হয়েছে। মাথায় মুকুট, নাকে সোনার নথ, টায়রা।
ভুসো কালী, খরমপুর, পূর্ব বর্ধমান
পূর্ব বর্ধমান জেলার মন্তেশ্বর ব্লকের খরমপুর গ্রামে লক্ষ্মীপুজোর পরেই নির্মাণ শুরু হয় প্রায় ৫০ ফুট উচ্চতার এক প্রতিমার। অল্প দিনে বিশালাকার প্রতিমা শুকোতে হয় বলে ব্যবহার করা হয় হ্যালোজেনের আলো। তাতেও পুজোর দিন গভীর রাতে শেষ হয় মূর্তি তৈরি। রাতেই মাটির পাত্রে প্রদীপ শিখা থেকে জমা কালি নিয়ে রাঙানো হয় প্রতিমার শরীর। তারপর গয়না পরিয়ে চক্ষুদান করেন শিল্পী। এই কালীর রং প্রদীপের ভুসোর মতো বলে নাম হয়েছে ‘ভুসো কালী’। কয়েকশো ছাগ বলি হয় কালীপুজোর রাতে।
কালীপুজোর সঙ্গে এ গ্রামে জড়িয়ে রয়েছে আরও একটি রেওয়াজও। গ্রামের সব বাড়িই একতলা। গ্রামবাসীদের বিশ্বাস, দেবী যেহেতু একতলায় থাকেন, তাই সিঁড়ি বেয়ে কেউ উপরে উঠলে দেবী রুষ্ট হন। কিছু বাড়িতে চিলেকোঠা অবশ্য আছে। তবে সেখানেও মই বা অন্য কোনও ভাবে ওঠা হয়। বছর কুড়ি আগে এক বাসিন্দা নিজের বাড়িতে সিঁড়ি করে উপরে ওঠার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু যে দিন সিঁড়ি ঢালাই হয় সেদিনই বাড়িতে আচমকা বাজ পড়ে দেওয়াল ফেটে যায়। এরপর থেকে আর কেউ সিঁড়ি তৈরি করার কথা ভাবেননি।
মণ্ডলা কালী, পাঁতিহাল, হাওড়া
আনুমানিক সাড়ে তিনশো বছর আগে হাওড়া জেলার পাঁতিহাল গ্রামের বর্ধিষ্ণু ঘোষাল পরিবারে মা পূজিতা হতেন। ওই পরিবারের এক পূর্বপুরুষ তন্ত্র সাধনা করতেন। সেই নিয়ে পরিবারে মধ্যে মত বিরোধ হওয়ায় গৃহে কালীপুজো বন্ধ হয়। অন্যদিকে পাঁতিহাল গ্রামের রায় পরিবারের ধর্মপ্রাণ জমিদার স্বর্গত কালাচাঁদ রায়কে দেবী স্বপ্নে আদেশ দেন মণ্ডলা নামক স্থানে দিঘির পাশে তাঁকে প্রতিষ্ঠা করতে। সেই মতো কালাচাঁদ রায় ঘোষাল পরিবারের দ্বিতীয় পুরুষ গৃহীসাধক রামশরণ ঘোষালের সহযোগিতায় পঞ্চমুণ্ডির বেদিতে জ্যৈষ্ঠ মাসের ফলহারিণী অমাবস্যায় কালীপুজো শুরু করলেন কালাচাঁদ রায়। দেবী এখানে দ্বিভুজা, সমুদ্রের জলের মতো উজ্জ্বল গাত্রবর্ণ। একহাতে ছিন্নমুণ্ড এবং অন্য হাতে রুধির পাত্র। জিহ্বা অপ্রকাশমান, দাঁতগুলো সামনের দিকে প্রকাশিত। তিনি সদাহাস্যময়ী। গলায় মুণ্ডমালা এবং কোমরে ছিন্ন নরহস্ত অনুপস্থিত। দেবীর বাঁ পা সামনে এবং ডান পা পিছনে। তিনি শবরূপী শিবের উপর দণ্ডায়মান।
খয়রা কালী, বিথারী, উত্তর চব্বিশ পরগনা
যশোররাজ প্রতাপাদিত্যের পতনের পর মোগল সম্রাট জাহাঙ্গিরের কাছ থেকে ১৬১১ সালে ভবেশ্বর রায় চাঁচড়া সহ নুরনগরের কয়েকটি পরগনা উপহার পান, সঙ্গে রাজা উপাধিও। পরবর্তীকালে জমিদারি পরিদর্শনে এসে চাঁচড়ার রাজা চালাঘরের পরিবর্তে উচ্চ ভিটায় মায়ের পাকা মন্দির ও পিছন দিকে ভোগ রাঁধার ঘর নির্মাণ করে দেন। কারওকারও মতে, পরবর্তীকালে কলকাতার জানবাজারের বাবু রাজচন্দ্র দাস ১৮০৪ সালে রাসমণিকে বিবাহ করে, এই জমিদারি পরিদর্শনে এসে মায়ের মন্দিরের জীর্ণ দশা দেখে পুনর্নির্মাণকরেন। কয়েক দিন রাজচন্দ্র ও রাসমণি সোনাবেড়িয়ায় (বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থিত) তাঁদের কাছারি বাড়িতে বসবাসও করেন।
আজও সেই বিথারী গ্রামে চার শতকের ঐতিহ্য মেনে রানি রাসমণির সংস্কার করা মন্দিরেই হয়ে থাকে খয়রাকালীর পুজো। উচ্চতায় দেবী সাড়ে তিন হাত। দক্ষিণাকালী তথা খয়রাকালীর আদেশে একসময় সোনাই নদীর খয়রা মাছ দিয়েই শুরু হয়েছিল দেবীপুজো। সে রীতি আজও বজায় রেখেছেন উত্তরসূরিরা। খয়রা মাছ দিয়ে পুজোর কারণে, দেবী খয়রাকালী নামে পরিচিত। সারাবছর একটাও খয়রা মাছ পাওয়া যায় না। কিন্তু কালীপুজোর দিন দেবীর কৃপায় মায়ের ঘাটে জাল ফেললে যে খয়রা মাছ ওঠে, তাতেই পুজো হয়ে থাকে খয়রাকালীর।