সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনি প্রচেষ্টায় সাফল্যের সম্ভাবনা। ন্যায্য অর্থ সঠিক সময়ে নাও পেতে পারেন। অর্থপ্রাপ্তির যোগ ... বিশদ
সঙ্গম অবশ্য তখনই জমজমাট। ওই জনসমাগমের জন্য যদিও ‘জমজমাট’ বা ‘ভিড়’ সঠিক শব্দ নয়। অষ্টমীর রাতে শ্রীভূমির ভিড়কে পাঁচ লক্ষ দিয়ে গুণ করলে কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যেতে পারে। দেখে বোঝার উপায় নেই, রাত তখন সাড়ে বারোটা। ২৫ মিটার দূরে দূরে এলইডি ল্যাম্পপোস্ট। সাদা আলোয় ঝকঝক করছে গোটা চত্বর। যেন দিনের আলো ফোটার আগেই দিন হয়েছে সঙ্গমে। হালকা মেজাজে ভিড় সামলাচ্ছিলেন সিআরপি জওয়ানরা। হাতে ফাইবারের লাঠি। তবে হাতের লাঠি হাতেই থাকছে। মাঝেমধ্যে উঁচু করে ভয় দেখানো ছাড়া সেটার বিশেষ কাজ নেই। রাত ৩টে থেকে ধীরে ধীরে বাড়ল ব্যস্ততা। ব্যারিকেড দেওয়ার কাজ ততক্ষণে শেষ। চার-পাঁচটা ঘোড়সওয়ার পুলিস একপাক ঘুরে ‘হটো ইঁয়াহাসে’ বলে ভিড় একটু সরালেন। কিছুক্ষণের মধ্যে অবশ্য অবস্থা যা ছিল তাই।
জনস্রোত ক্রমশ বাড়ছে। শাহী স্নানের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে বুঝতে পেরে ধীরে ধীরে পজিশন নেওয়া শুরু করেছে অপেক্ষমান জনতা। ব্যারিকেডের দু’ধারেই। আরও এক ঘণ্টা ওইভাবেই কাটল। চারটের পর থেকে আসরে নামলেন উত্তরপ্রদেশ পুলিসের কর্তারা। তাঁদের নির্দেশ মিলতে তৎপর সিআরপি জওয়ানরাও। ব্যারিকেড টপকানোর চেষ্টায় দু’-এক ঘা লাঠির বাড়িও পড়ল কয়েকজনের পিঠে। তার মধ্যে শুরু হল বালির উপর আলপনা দেওয়া। শাহী স্নানে সাধু-মহারাজদের স্বাগত জানানোর জন্য। সঙ্গম ঘাটের ভিড় খালি করে দেওয়া হয়েছে। সামনেটা ফাঁকা হয়ে যাওয়ায় ঠান্ডা হাওয়ার সঙ্গে উড়ে আসা জলের ছিটে যেন আলপিনের মতো বিঁধছে মুখে। আঙুল, নাক জমে যাওয়ার অবস্থা। ভোর সাড়ে পাঁচটা বাজতেই অপেক্ষার অবসান। সঙ্গম চত্বরে পা রাখলেন মহানির্বাণী পঞ্চায়েতি আখড়ার সাধুরা। কারও সর্বাঙ্গে উল্কি, অদ্ভুত জটাজুটের কেশবিন্যাস। হাতে তরবারি, ত্রিশূল, গদা, চিমটা। কেউ কেউ আবার এসেছেন খালি হাতেই। ভক্তদের ‘হর হর মহাদেব’, ‘জয় শ্রীরাম’, ‘গঙ্গামাতা কি জয়’ চিৎকারের মধ্যেই গঙ্গা-যমুনা সঙ্গমে লাফিয়ে নামলেন সাধুরা। মাথা ডুবল সঙ্গমের বরফ ঠান্ডা জলে। জটার জল ছিটকে উঠল পাড়ে। চিৎকার ততক্ষণে জনগর্জনে পরিণত হয়েছে। পর পর আসতে শুরু করেছে সাত শৈব আখড়ার সন্ন্যাসীরা। তারপর আসবে উদাসীন, নির্মল আখড়া।
স্নানে নামছেন সাধুরা। ততক্ষণে স্নান সেরে পারে উঠে ছাই মাখছেন নাগা বাবারা। সেই বিভূতি নেওয়ার জন্য কী আকুতি! শুধুই মাথার ভিড়। মাথায় একবার হাত ছুঁয়ে বাবার আশীর্বাদ পেতে উদগ্রীব তরুণ-তরুণী থেকে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সকলে। আখড়ার স্নান শেষ। অতি উৎসাহী কিছু পুণ্যার্থী আর ধৈর্য ধরতে না পেরে ছুটলেন ঘাটের দিকে। নেমেও পড়লেন অনেকে। ততক্ষণে আবার আসতে শুরু করেছেন বিভিন্ন আখড়ার সাধু, সাধ্বীরা। সঙ্গে ভক্তকুল। ফুল-মালায় সজ্জিত রথে চড়ে। খবর আসতেই ফের পুণ্যার্থীদের সরিয়ে খালি করা হল ঘাট। সঙ্গম চত্বরে থেকে ততক্ষণে সেই লাইন তখন ৮ নম্বর নম্বর পন্টুন ব্রিজ হয়ে এসে দাঁড়িয়েছে অন্যপারে।
সাধু-সন্তদের স্নানের চাপ একটু কমতেই বাঁধ ভাঙা ঢেউয়ের মতো সঙ্গমে আছড়ে পড়লেন ভক্তরা। ত্রিবেণী সঙ্গমের প্রবল ঠান্ডা হাওয়া আর জল তখন ভক্তির উষ্ণতায় ভরপুর। তাঁদের সামলাতে জলের মধ্যে ঘোড়া নিয়ে নেমে টহল দিল পুলিস। সঙ্গে জলপুলিসের নজরদারি।
সরকারি হিসেব অনুযায়ী, প্রায় সাড়ে তিন কোটি পুণ্যার্থী এদিন স্নান করেছেন সঙ্গমে। সেই উপচে পড়া ভিড় দেখলে প্রশ্ন জাগতে বাধ্য, এ কি শুধুই ধর্মবিশ্বাস, নাকি ভারতের সনাতনী আত্মাকে খুঁজে পাওয়ার এক অমোঘ চেষ্টা? ‘আমি’র ভিতরের ‘আমি’কে খুঁজতে কতশত নাস্তিকও ডুব দিয়েছেন এই এই সঙ্গমে। এটাই কুম্ভমেলার মাহাত্ম্য। আধ্যাত্মবাদের এই রূপ দেখেই একদা মুগ্ধ হয়েছিলেন মার্ক টোয়েন। সেই আবেগ, শ্রদ্ধাই তাঁবু শহরকে বদলে দিল বিশ্বাসের শহরে। সিটি অব ফেইথ।