সাংবাদিকতা মানে উস্কানির পালে হাওয়া দেওয়া নয়। সাংবাদিকতার অর্থ সঠিক তথ্য পরিবেশন। সেটাও বিবেচনা এবং বোধবুদ্ধির দাঁড়িপাল্লায় চাপানোর পর। জাস্টিসের দাবি মানেও আইন, সংবিধান কিংবা প্রতিষ্ঠানকে অস্বীকার করা নয়। এবং যারা ৩৬৫ দিন, ২৪ ঘণ্টা আমাদেরই সুরক্ষার জন্য পথে দাঁড়িয়ে থাকে, সেই পুলিসের পুরো ফোর্সটাকে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করানোও নয়। ৫৫ দিন তদন্ত চালিয়ে সিবিআই শিয়ালদহ আদালতে যে চার্জশিট দিয়েছে, তাতে এই প্রত্যেকটি বাক্য কি সত্যি বলে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না? ধৃত সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় যে ৯ আগস্ট রাতে ঘটনাস্থলে ছিল এবং ধর্ষণ-খুনে সে-ই যুক্ত, তা একদিনের মধ্যেই প্রকাশ্যে এনেছিল কলকাতা পুলিস। সেইসঙ্গে তাকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছিল। কলকাতা পুলিসের হাতে মামলাটা থাকলে সাতদিনের মধ্যে যে চার্জশিট পেশ হতো, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। সিবিআইয়ের তত্ত্বাবধানে চার্জশিট জমা পড়ল, কিন্তু প্রায় দু’মাস পর। আর তাতে নাম শুধু একজনের—সঞ্জয় রায়। তাহলে গত ৫৫ দিন ধরে সিবিআইয়ের তদন্তে বাংলা কী পেল? সাজিয়ে নেওয়া যাক। ১) কলকাতা পুলিসের উপর সাধারণ মানুষের চূড়ান্ত অনাস্থা তৈরি ও ফোর্সের মনোবল ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা। ২) বিচারের নামে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে স্রেফ সরকার-বিরোধী মঞ্চে পরিণত করা। ৩) বিশ্বমঞ্চে প্রতিদিন বাংলার নামে অসম্মানের ঝুলি উপুড় করা এবং ৪) আমরা-ওরায় সমাজকে ভাগ করে দেওয়া।
অচলাবস্থা কখনও ভদ্র-সভ্য রাজ্যের বা সমাজের পরিচয় হতে পারে না। অথচ সেটাই চলছে। লাগাতার। বাইরের রাজ্যের ব্যবসায়ীরা বাংলার নাম শুনলেই আঁতকে উঠছেন। বক্তব্য একটাই—বাংলায় তো আন্দোলন। ব্যবসা হবে কী? এটা কি আপনার-আমার জন্য খুব ভালো বিজ্ঞাপন? বোধহয় না। তাও চলছে। একটা শ্রেণি প্রতিদিন এই ফর্মুলাতেই সার-জল দিয়ে গিয়েছে। গরিব মানুষ চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে গিয়েছে। জমি-বাড়ি বন্ধক রেখে বেসরকারি হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছে। কেউ কেউ শেষ নিঃশ্বাসটুকু নিয়েও বাড়ি ফিরতে পারেনি। কী দোষ ছিল তাঁদের? তাও সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা শ্রেণি লিখেছেন, ডাক্তাররা ঠিক করছে। প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, আপনি কি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা অ্যাফোর্ড করতে পারেন? এরা কিন্তু পারে না। আপনি কি আপনার পরিবারের জন্য শুধুই সরকারি হাসপাতালের উপর নির্ভরশীল? এদের কিন্তু আর জি কর, এনআরএস, পিজি বা মেডিক্যাল কলেজ ছাড়া গতি নেই। এবার একটু অন্য লাইনে প্রশ্ন করা যাক। বাড়িতে চুরি হলে আপনি কি সিবিআই ডাকবেন? না। আপনি স্থানীয় থানাতেই যাবেন। তাহলে কেন ওই মহিলা কনস্টেবল বা সার্জেন্ট গত দু’মাসে রক্তে ভেসেছেন? ধরে নিলাম আপনি সাধারণ মানুষ। তার মানে আপনি আয়কর দেন, জিএসটি দিয়ে জিনিসপত্রও কেনেন। সেই টাকায় রাস্তাঘাটের উন্নয়ন হয়, বাড়িতে জল আসে, সরকারি কর্মচারীরা মাইনে পান, আবার ডাক্তাররা যে সরকারি হাসপাতালে প্রায় বিনামূল্যে পড়ে, সেই টাকাটারও জোগান হয়। একবারও কি প্রশ্ন করেছেন, তোমরা পড়ায় ফিরছ না কেন? কাজে ফিরছ না কেন? আন্দোলনের কি অন্য পথ নেই? আসলে আমাদের ওই ছোট ছোট ভাইবোনদেরও আর কিছু করার নেই। রাজনীতির অমোঘ আকর্ষণে এবং নির্দিষ্ট কিছু ‘বাধ্যবাধকতায়’ একেবারে কানাগলিতে পৌঁছে গিয়েছেন তাঁরা। মানুষ কিন্তু দেখছে, স্বাস্থ্যসচিবকে সরানো ছাড়া তাঁদের সব দাবিই মানা হয়েছে।
পরিকাঠামো তৈরিতে একটু সময় লাগে। সেটা ম্যাজিক নয়। সরকারি প্রক্রিয়া। পরিকল্পনা, টেন্ডার, তারপর কাজ। তার সময়সীমাও সরকার বেঁধে দিয়েছে। তাহলে অনশন কেন? প্রচারে থাকার জন্য? বিচারটা কি আসল চাহিদা নয়?
বিচারটা কী? কে দেবে বিচার? অভয়ার সঙ্গে ৯ আগস্ট যা হয়েছে, তা কোনও অবস্থাতেই মেনে নেওয়া যায় না। দোষীর কঠোরতম শাস্তিও যেন কম পড়ে যায়। কিন্তু দোষী না হওয়া সত্ত্বেও কি কাউকে কাঠগড়ায় তোলা যায়? শাস্তি দেওয়া যায়? ধর্ষণ-খুনে সঞ্জয় ছাড়া অন্য কারও উপস্থিতিই তো সিবিআই দেখাতে পারেনি। তাহলে ৫৫ দিন পর চার্জশিটে নিশ্চয়ই তার উল্লেখ থাকত। তা কিন্তু নেই। উল্টে ধামাচাপা এবং দুর্নীতিতেই ফোকাস করেছে কেন্দ্রীয় এজেন্সি। তাহলে কি ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, ধর্ষণ এবং খুন একা সঞ্জয়ই করেছে? ‘বর্তমান’ কিন্তু বহু আগেই লিখেছিল, ধর্ষক একা সঞ্জয়ই। তা আন্দোলন এবং রাজনীতির গোড়ার দিকে থাকা লোকজনের পছন্দ হয়নি। আমরা সাধারণ গরিব মানুষের ভোগান্তির কথা লিখেছি। সেটাও তাদের বিলকুল নাপসন্দ। তাই আমরা-ওরায় সমাজটাকে ভাগ করে দেওয়ার প্রবল চেষ্টায় মেতেছে ছেঁদো রাজনীতির তামাক খাওয়া একটা শ্রেণি। সত্যি তাদের কাছে সেটাই, যা সরকারের বিরোধী। বিচার তাদের কাছে তখনই হবে, যখন তাদের তালিকায় আগে থেকে লিখে রাখা নামগুলো ফাঁসিকাঠে ঝুলবে। একটিও কথা বলা যাবে না, যা সরকারের পক্ষে যেতে পারে। তাহলেই সেই ব্যক্তি হয়ে যাবেন চটিচাটা। খুব মনোগ্রাহী শব্দ নাকি? তাহলে বলতেই হয়, রাজ্যের সিংহভাগ মানুষই চটিচাটা। গত বিধানসভা, লোকসভা এমনকী উপ নির্বাচনের ফলও সে কথাই বলেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু হাঁকডাকেও সেই পরিস্থিতি বদলাবে না। কয়লা বা গোরু পাচারের মামলায় অনুব্রত মণ্ডলরা কিন্তু একে একে প্রায় সবাই জামিন পেয়ে গিয়েছেন। চার্জশিটে তাঁদেরও নাম ছিল। তাহলে সিবিআই তদন্তের কী হল? উপযুক্ত প্রমাণ মিলল না? নাকি সবটাই সাজানো ছিল? রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত!
প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা যদি সত্যিই থাকে, তার ফল ছাব্বিশের ভোটে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। কিন্তু তার জন্য ততদিন অপেক্ষাও করতে হবে। রাজ্যটাকে লাটে তুলে দিলে আপনার বা আমার সন্তানের সুবিধা হবে না। ‘উৎসব’ শুনলেই এক একজন যেভাবে হাঁ হাঁ করে উঠছেন, তাতে মনে হচ্ছে যেন তাঁদের কিডনি বা হৃদ্পিণ্ড কেটে নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তাঁরা কিন্তু ভাবছেন না, উৎসবে যোগ না দেওয়ার বিলাসিতা তাঁদের পক্ষে দেখানো সম্ভব। কিন্তু যাঁরা শুধু এই পুজোর চারটে দিনের উপার্জনের অপেক্ষায় থাকেন, তাঁরা কী করবেন? মিছিলের জন্য জামাকাপড়ের ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা মার খাবেন। মানুষ কিন্তু নতুন জামা কিনবে। অনলাইনে। তাহলে কি উৎসব থেকে বিরত থাকা গেল? না, গেল না। শুধু গরিব মানুষের পেটে লাথিটা ঠিকঠাক পড়ল। এটাই বিপ্লব তো? এঁরাই কেউ হয়তো তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মকে ভিন রাজ্যে বা ভিন দেশে পাঠিয়ে দেবেন। আন্দোলন-আন্দোলন খেলার পর কোনও কোনও প্রতিবাদী নিজেও চলে যাবেন। ক্ষত কিন্তু রয়ে যাবে বাংলার গায়ে। ওই খোঁচাখুঁচি করার অধিকার আমাদের কাউকে কিন্তু সংবিধান দেয়নি। জন্মভূমিও না।
দু’মাসের আন্দোলন। অথচ, সরকার বা পুলিস কেউই বাধা দেয়নি। লাঠিচার্জ করে তুলে দেয়নি অবস্থান। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, আন্দোলন সাধারণ মানুষের অধিকার। আর ন্যায্য দাবি পূরণ সরকারের কর্তব্য। এই দুটোই গত দু’মাসে হয়েছে। গণতন্ত্রের জয় এখানেই। তাহলে এই অসহিষ্ণুতা কেন? এবার একটু ভেবে দেখার সময় কি হয়নি? ভাবতে হবে। কী পেলাম। আর কী হারালাম। ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগে ভবিষ্যতে হয়তো সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট দেবে সিবিআই। তাতে প্রভাবশালী কারও নামও থাকতে পারে। কিন্তু তখনও মনে রাখতে হবে, অভিযোগ মানেই দোষী নয়। দোষ প্রমাণ করতে হবে সিবিআইকেই। প্রমাণ দিতে হবে। তার উপর ভিত্তি করে রায় দেবে আদালত। সেটা হবে বিচার। ততদিন ধৈর্য ধরতেই হবে। দোষী শাস্তি পাবেই। কিন্তু নিষ্পাপের যেন মাথা হেঁট না হয়। আর বাঙালি হয়ে বাংলাকে কলঙ্কিত করার দাগ যেন আমাদের ‘হোয়াইট কলারে’ লেগে না থাকে।