হাওড়া ব্রিজ পেরিয়ে কলকাতায় ঢোকার মুখে রাজা কাটরা। গেট নম্বর পাঁচ। সকাল সাড়ে দশটা। লোকে লোকারণ্য। ঠেলা, সাইকেল ভ্যানের হর্ন কানের মাথা খেয়ে নিচ্ছে। এই সেই বড়বাজারের রাজা কাটরা। শতসহস্র লোকের জীবিকা অর্জনের ‘পুণ্যক্ষেত্র’। এখানেই কানে এল প্রশ্নটা—‘চিট্টা না ডাবলাস?’ মানে? ‘চিট্টা’ অর্থাৎ অরিজিনাল। আর ‘ডাবলাস’ হল নকল। এই আসল-নকলের খেলা চলছে সাধারণের চোখের সামনেই। কিন্তু সবার মুখে কুলুপ। প্রয়োজনে প্রশাসনও গান্ধারী। চোখে কাপড় জড়িয়ে রেখেছে। ঠিক অনেকটা ‘অন্ধা কানুন’এর মতো।
নামকরা কোম্পানির এক কেজি গুঁড়ো দুধের দাম কত? ৪০৫ টাকা। কিন্তু এখানে মিলবে ৩০০ টাকাতেই! শুনে ক্রেতার প্রশ্ন, ‘কীভাবে দিচ্ছেন দাদা? এই মাল বিক্রি করে কেস খাব না তো?’ লুঙ্গির গিঁটটা টাইট করে বিক্রেতার উত্তর, ‘কী যে বলেন? এখন তো ডাবলাস দুধেরই রমরমা। প্যাকেট ছাড়া নিলে ২৪০ টাকাতেই দিয়ে দেব। এত ভাবলে বেওসা করবেন কী করে?’ তাহলে আপনারা কীভাবে করেন? সহাস্য উত্তর, ‘পাঞ্জাব থেকে মাল আসে। এর বেশি জানতে চাইবেন না।’ শুধু গুঁড়ো দুধ নয়, লঙ্কা-হলুদ-জিরে-গোলমরিচ-বিউলির ডালের বড়ি, সবই পাবেন কম দামে। প্রতিদিন লরি লরি ‘ডাবলাস’ পৌঁছে যাচ্ছে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে। একহাত কিংবা দু’হাত ঘুরে সেই দ্রব্যই থাকছে আমার-আপনার হেঁশেলে।
লকডাউনে চাকরি যাওয়ার পর মুদিখানার দোকান দিয়েছেন আমতলার তপন সামন্ত (নাম পরিবর্তিত)। এক বুদ্ধিদাতার পরামর্শে এসেছেন বড়বাজারে। প্রায় আধঘণ্টা ঘুরে তিনি বুঝতেই পারছেন না কোন দোকান থেকে কেনাকাটা করবেন। হঠাৎ মুশকিল আসান এক কুলি। ‘কী কিনবেন বাবু? বাজেট কত? খুব কম হলে ওই দোকান (আঙুল দেখিয়ে)।’ সেখানে গিয়ে তপনবাবু বললেন, ‘দাদা, দিন সাতেক হল পাড়ায় মুদির দোকান দিয়েছি। কম দামে মাল চাই। গুঁড়ো দুধ, হলুদ, লঙ্কা, পোস্ত, জিরে... পাওয়া যাবে?’ চরম ব্যস্ততা সামলে দোকানদারের উত্তর এল, ‘প্রথমে অল্প মাল নিন। বেচুন। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। আমার কাছে আসলের পাশাপাশি নকলও আছে। ১১০ টাকায় এক কেজি লঙ্কাগুঁড়ো পাবেন, আবার ৩০০ টাকাতেও। কোনটা নেবেন আপনার ব্যপার।’ প্রশ্ন জাগতে পারে, কীভাবে কম টাকায় বিক্রি হচ্ছে? আসল হলুদ ও লঙ্কাগুঁড়োর সঙ্গে মিশছে আতপ চালের ডাস্ট। এছাড়া খোঁজ নিয়ে জানা গেল, মুনাফার জন্য অনেকেই পাঁচ কেজি গোটা জিরের সঙ্গে কেজিখানেক ‘সুলপা’ মেশাচ্ছেন। এক ধরনের বীজ, দেখতে জিরের মতোই। কেজি প্রতি গোটা জিরের দাম ৩০০-৩২৫ টাকা। সুলপা ৮০ টাকা। মেলে পোস্তা বাজারে। মহর্ষি দেবেন্দ্র রোডের দু’পাশের দোকান। কিন্তু প্রকাশ্যে বিক্রি? নৈব নৈব চ। দোকানের সামনে কিছু নেই। যা আছে ভিতরে। পরিচিত কাস্টমার দেখলে বের করে দেবেন। না হলে আপনার ভাগ্যে কিছুই জুটবে না। সহজ-সরল এক ব্যবসাদার অবশ্য বলে ফেললেন, ‘দাদা, রাস্তার উপরের দোকানদাররা কেউই আপনাকে সুলপা দেবে না। ঢুকতে হবে গোলকধাঁধায়। দেখবেন, বেশ কিছু কুলি এদিক-ওদিক ছড়িয়ে রয়েছে। তারাই পৌঁছে দেবে। হাতে শুধু ক্যাশ গুঁজে দেবেন।’ সেখানেও অবশ্য সবটা জলবৎ নয়! অমুকবাবুর রেফারেন্স দেওয়ার পর দোকানদারের টিপস, ‘গ্যারান্টি আছে, কেউ ধরতে পারবে না। প্রথমে সুলপা কম মেশাবেন। খদ্দেরদের অভ্যাস হয়ে গেলে একটু একটু করে ভাগ বাড়াবেন। কিস্যু হবে না।’
ঠিক একইভাবে গোটা বিউলির ডাল ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে, অথচ সেই ডালেরই বড়ি ৭৫ টাকায়। আর পোস্ত? শুনলে চমকে যাবেন। ৬০০ থেকে শুরু, আর শেষ ২২০০ টাকায়। কেউ সুজি মেশাচ্ছেন, কেউ চালমগজ। এছাড়া গোলমরিচে মিশছে পেঁপের বীজ। পাবেন ভেজাল চকোলেটও। সবচেয়ে বড় কথা, প্রতিদিনই সবার চোখের সামনে লরিভর্তি মাল ছড়িয়ে পড়ছে গোটা রাজ্যে। অসাধু ব্যবসাদারদের অতিরিক্ত লাভের নেশায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন আপনি। আমরাও।
জিরে নয়, দেখতে একরকম ‘সুলপা’