পরামর্শে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডাঃ জ্যোতির্ময় পাল।
একটি মশা। গায়ে সাদা-কালো ডোরাকাটা দাগ। স্বচ্ছ জলে জন্মায়। নাম এডিস ইজিপ্টাই। আর এই মশাই হয়ে উঠেছে গোটা রাজ্যের ত্রাস! এডিস ইজিপ্টাই-এর দাপটে বাংলার প্রায় প্রতিটি কোণের মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন ডেঙ্গুতে। মুশকিল হল, ফি বছর ডেঙ্গুর সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লেও এখনও অসংখ্য মানুষ এই রোগটি নিয়ে যথেষ্ঠ সচেতন নন। ফলে রোগীর পরিচর্যায় এবং ডেঙ্গু দমনে খামতি রয়েই যাচ্ছে। এসবের মাঝে পড়ে অনেক রোগীর সমস্যা বেশ জটিল আকার ধারণ করছে। এই পরিস্থিতিতে রোগটি সম্বন্ধে সঠিক তথ্যই মানুষের কাছে জীবনদায়ী হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ
চার ধরনের ডেঙ্গু ভাইরাস রয়েছে— ডেঙ্গু ১, ডেঙ্গু ২, ডেঙ্গু ৩, ডেঙ্গু ৪। তবে ডেঙ্গুর যেই ভাইরাসেই আক্রান্ত হোন না কেন, প্রাথমিক রোগলক্ষণ কিন্তু মোটের উপর একই থাকে।
এই রোগের মূল উপসর্গ হল জ্বর। ডেঙ্গু জ্বরের তীব্রতা বেশি থাকে  চোখের পিছনে ব্যথা হতে পারে  মাথা যন্ত্রণাও থাকতে পারে  হাড়ে এবং পেশিতে ভীষণ ব্যথা হয়  বমি বমি ভাব বা বমি হতেও পারে  অনেকের শরীরে লাল-লাল র্যা শ বেরতেও দেখা যায়। ত্বক চুলকায়।
তবে সমস্যা অনেকটা বেড়ে গিয়ে থাকলে ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোম এবং ডেঙ্গু হেমারেজিক ফিভারে মানুষ আক্রান্ত হতে পারেন। ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোমের ক্ষেত্রে আক্রান্তের ব্লাডপ্রেশার নেমে যায়। উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায় ইউরিনের পরিমাণ। ডেঙ্গু হেমারেডিক ফিভারে রোগীর শরীরের মধ্যে রক্তপাত শুরু হয়ে যায়। কালো পায়খানা, গায়ে কালো দাগ দেখা যেতে পারে। এমনকী মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ পর্যন্ত হতে পারে। তবে আশার কথা হল, এই ধরনের সমস্যা খুব কমই হয়। তাই অযথা চিন্তা বাড়িয়ে লাভ নেই।
রোগ নির্ণয়
ডেঙ্গু জ্বর নির্ধারণ করতে ডেঙ্গু এনএস১ অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করতে হয়। এছাড়া রোগীর শারীরিক অবস্থা যাচাই করে নিতে চিকিৎসক টোটাল ব্লাড কাউন্ট, প্লেটলেট কাউন্ট, লিভার এনজাইম টেস্ট ইত্যাদি পরীক্ষা করানোর পরামর্শও দিতে পারেন।
চিকিৎসা
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ ভিত্তিক চিকিৎসা করতে হয়। এক্ষেত্রে জ্বরের জন্য প্যারাসিটেমল ট্যাবলেট দেওয়া হয়। রোগীকে প্রচুর জলপান করতে বলা হয়। অন্তত পক্ষে দিনে তিন থেকে চার লিটার জলপান করা দরকার। এছাড়া নিয়মিত নানা পরীক্ষার মাধ্যমে রোগীর স্বাস্থ্যের উপর নজর রাখতে হয়।
খাবার
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে খাবারের দিকে অবশ্যই বিশেষ নজর দিতে হবে। এক্ষেত্রে সহজ পাচ্য, মশলা ছাড়া খাবার খাওয়া চাই। কারণ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত অনেকেরই ডায়ারিয়া হয়। এছাড়া ডেঙ্গু হলে গা গোলানো ভাব, হজমের সমস্যা বাড়ে। ফলে মশলা দেওয়া, ফ্যাট জাতীয় খাবার এড়িয়ে যেতে বলা হয়।
ডেঙ্গুতে পেঁপে পাতার রস
ডেঙ্গুতে পেঁপে পাতার রস খাওয়ার প্রচলন হয়েছে। বলা হয়, পেঁপে পাতার রস খেলে প্লেটলেট বাড়ে। তবে এই কথার কোনও বিজ্ঞান ভিত্তি নেই। উল্টে পেঁপে পাতার রস খেলে বমি বমি ভাব আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই পেঁপে পাতার রসের বিষয়ে চিন্তা না করাই ভালো।
কখন হাসপাতাল?
সাধারণত এই নিয়মগুলি মেনে চললে ডেঙ্গু থেকে সহজেই সেরে ওঠা যায়। তবে কোনও সমস্যা জটিল আকার ধারণ করলে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি হতে পারে। এই বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে নির্দিষ্ট গাইডলাইন রয়েছে। সেই নির্দেশিকা অনুযায়ী একজন চিকিৎসক সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।
কখন প্লেটেলেট দিতে হয়?
একজন সুস্থ মানুষের প্লেটলেট দেড় লক্ষ থেকে সাড়ে চার লক্ষর মধ্যে থাকা উচিত। তবে ডেঙ্গু হলে প্লেটলেট দ্রুত হারে কমতে থাকে। এবার প্লেটলেট দশ হাজারের নীচে নেমে গেলে রোগীর শরীরে রক্তক্ষরণ হওয়ার আশঙ্কা শুরু হয়ে যায়। তাই তখন রোগীকে আলাদা করে প্লেটলেট দিতে হয়। আবার প্লেটলেট ১০ হাজারের বেশি থাকার পরও রোগীর রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে গেলে প্লেটলেট দিতে হয়।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে
ডেঙ্গুর চিকিৎসার বদলে ডেঙ্গু প্রতিরোধে বেশি করে জোর দিতে হবে— বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার রাখুন  ডেঙ্গু মশা পরিষ্কার স্বচ্ছ জলে জন্মায়। তাই বাড়ির আশপাশে বৃষ্টির জল জমতে দেওয়া যাবে না। ভাঙা পাত্র, টায়ার, চায়ের কাপ, টব সহ জল জমতে পারে, এমন জায়গাগুলিকে চিহ্নিত করে নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে  হাত-পা ঢাকা জামা কাপড় পরুন  মশারি টাঙিয়ে ঘুমান  মশার ধূপের বদলে রোল-অন ব্যবহার করতে পারে। 
সায়ন নস্কর