শেয়ার প্রভৃতি ক্ষেত্র থেকে অর্থাগমের সম্ভাবনা। সন্তানের কর্ম প্রাপ্তির সুখবর পেতে পারেন। কর্মক্ষেত্রে জটিলতা কিছুটা ... বিশদ
বুলবুল পাখি ময়না টিয়ে
আয় না যা না গান শুনিয়ে...’
হ্যাঁ, গান শোনাবে তো! শুধু বুলবুল-ময়না-টিয়া কেন? সেইসঙ্গে থাকবে তোতা-ম্যাকাও-ফেজাল্ট-ময়ূর-সাদা ময়ূর আরও কত নাম না জানা পাখির দল! কিন্তু তাদের দেখা পাওয়ার জন্য যে তোমাদের এই শীতের রোদ্দুর গায়ে মেখে সটান চলে আসতে হবে আলিপুর চিড়িয়াখানায়। গোটা বছর বৃহস্পতিবার বন্ধ থাকলেও আগামী ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত শীতের মরশুমে প্রতিদিনই খোলা থাকছে চিড়িয়াখানা। সময়সীমা সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা। টিকিটের দাম মাথাপিছু ৫০ টাকা। তবে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের লাগবে ২০ টাকা। আছে অনলাইনে টিকিট কাটার ব্যবস্থাও।
এ বছর আলিপুর চিড়িয়াখানা দেড়শো বছরে পদার্পণ করল। ১৮০০ সাল নাগাদ ব্রিটিশ ভারতের তদানীন্তন গর্ভনর জেনারেল রিচার্ড ওয়েলেসলি তাঁর বাসভবনে গড়ে তুলেছিলেন একটি ব্যক্তিগত পশু উদ্যান। এই সেই ওয়েলেসলি, যিনি অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি প্রচলন করার জন্য ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে আছেন। যাইহোক, বিশিষ্ট স্কটিশ চিকিৎসক তথা প্রাণীতত্ত্ববিদ ফ্রান্সিস বুকানন হ্যামিলটন এইসব পশুদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পান। পরবর্তীকালে এটিকে বিধিবদ্ধ চিড়িয়াখানার রূপ দেওয়ার কথা ভাবতে থাকে ব্রিটিশ সরকার। ১৮৪২ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি মিউজিয়ামের কিউরেটর ডঃ জন ম্যাকল্যান্ড কলকাতায় জুলজিক্যাল গার্ডেন তৈরির পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু তখন তা কার্যকর করা যায়নি। ১৮৭৩ সালে লেফটেন্যান্ট গর্ভনর স্যার রিচার্ড টেম্পল কলকাতায় একটি চিড়িয়াখানা স্থাপনের প্রস্তাব দেন। ১৮৭৬ সালের ১ জানুয়ারি প্রিন্স অব ওয়েলস সপ্তম এডওয়ার্ড আনুষ্ঠানিকভাবে আলিপুরে চিড়িয়াখানার উদ্বোধন করেন। ১৮৭৬ সালের ৬ মে চিড়িয়াখানার দরজা জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। বিভিন্ন মানুষের ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা পশুপাখি এখানে রেখে শুরু হয় এর পথচলা। ১৮৮৬ সালের প্রথম দিকে বারাকপুর পার্কের পশুগুলিকে এখানে নিয়ে আসার ফলে আলিপুর চিড়িয়াখানা আরও সমৃদ্ধ হয়। ময়মনসিংহের রাজা সূর্যকান্ত আচার্য ও মহীশূরের রাজা চতুর্থ কৃষ্ণরাজ তাঁদের পশু-উদ্যান থেকেও অনেক পশু দান করেছিলেন এখানে। প্রথম দিকে যে সাম্মানিক ম্যানেজিং কমিটি এই চিড়িয়াখানা চালাত, তার অন্যতম সদস্য ছিলেন বিখ্যাত উদ্ভিদবিদ জর্জ কিং। আলিপুর চিড়িয়াখানার প্রথম ভারতীয় সুপারিনটেনডেন্ট হন রায় বাহাদুর রামব্রহ্ম সান্যাল (১৮৮৫-১৯০৪)। চিড়িয়াখানার ভেতরে দেখতে পাবে তাঁর আবক্ষ মূর্তি।
চিড়িয়াখানার মূল দরজাটি সাজানো পাথরের বাঘ-হাতি-জিরাফ-গন্ডারের মূর্তি দিয়ে। চিড়িয়াখানার পুরো এলাকাটির আয়তন ৪৭ একর। যা দেখতে সময় লেগে যাবে তিন থেকে চার ঘণ্টা। ঢুকতেই মাঝখানে রেলিং ঘেরা মাঠের ওপর রয়েছে সবুজ ঘাস দিয়ে তৈরি জিরাফ আর হাতির বিশাল মূর্তি। রাস্তার একধারে আছে তির চিহ্ন আঁকা বোর্ড। তাতে নির্দেশ দেওয়া আছে বিভিন্ন পশুপক্ষীদের ডেরার। রয়েছে মস্ত বড় একটা ম্যাপ, পুরো চিড়িয়াখানায় কোথায় কী আছে তার বিবরণ সমেত। কয়েকটা বিষয় কিন্তু প্রথমেই মাথায় রেখ, যেমন, কোনওভাবেই যেন পশু ও পাখিরা তোমার কোনও কাজে বিরক্ত না হয়। আর বাইরের কোনও খাবার ওদের যেন খাওয়ানোর চেষ্টা কর না।
চিড়িয়াখানায় বিভিন্ন খাবারের স্টল রয়েছে ‘ফুড কোর্ট’-এ। এছাড়াও বাড়ি থেকে তৈরি করা খাবার এনেও এখানে বসে খেতে পার। তবে খাওয়ার পর থালা-গ্লাস-প্যাকেট-বোতল ইত্যাদি নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে ফেলে দিতে ভুলো না যেন। ছড়িয়ে ছিটিয়ে নোংরা করা কিন্তু মোটেই চলবে না।
চিড়িয়াখানার এবারের নতুন আকর্ষণ ‘ওয়াক-ইন-অ্যাভিয়ারি’। দু’পাশে এবং মাথার ওপর কাচ দেওয়া একটা পাথর বাঁধানো টানেল দিয়ে হেঁটে গেলেই দেখতে পাবে তোমার দু’পাশে উড়ে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির ঝাঁক! তাদের কিচিরমিচির আর হুটোপুটির মাঝখান দিয়েই কিন্তু হেঁটে যেতে হবে। পাখিরা চারপাশে উড়ে বেড়াবে, আর তুমি থাকবে খাঁচার ভেতরে! কী? কেমন মজা?
এবার চল অন্যান্য পশুদের দেখতে। কাচের দেওয়ালের ওপারে বিশাল চত্বরে পরপর দেখতে পাবে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার, জাগুয়ার, শিম্পাঞ্জি, ক্যাঙারু, হায়না, নীলগাই, ভল্লুক, বুনো কুকুর, বনবেড়াল, মেছোবেড়াল, খ্যাঁকশেয়াল, শ্লথ বিয়ার আরও কত কী! আবার কখনও দেখতে পাবে জলাশয়ের পাথর বাঁধানো পাড়ের ওপর সারি সারি কুমির শুয়ে রোদ পোয়াচ্ছে! রয়েছে নানান প্রজাতির হরিণ— কৃষ্ণসার হরিণ, মণিপুরী নাচুনী হরিণ, চৌশিঙা হরিণ, বার্কিং ডিয়ার ও আরও অনেকরকম। মণিপুরী নাচুনী হরিণদের বিশেষত্ব হল, প্রতিবছর এদের শিংগুলো খুলে পড়ে যায়। আবার সেখান থেকেই পরের বছর নতুন শিং গজায়!
নতুন ধরনের একরকম পাখি চোখে পড়ল, যেগুলো উড়তে পারে না! নাম ক্যাসোয়ারি। এদের বাসস্থান ওশিয়ানিয়ার নিউগিনি। এরা ফল আর গাছের পাতা খায়। শুধু পাখি নয়, এখানে এলে দেখা পাবে নতুন ধরনের পশুরও, যার কথা হয়তো তোমরা বইতে পড়েছ। যেমন— আলপাকা। দক্ষিণ আমেরিকার উট শ্রেণির একটি স্তন্যপায়ী প্রাণী এটি। অনেকটা দক্ষিণ আমেরিকার ‘লামা’র মতো। এদের উলের খুব চাহিদা। উটের মতোই তিনকক্ষ বিশিষ্ট পাকস্থলী থাকে এদেরও। খড় আর ঘাস হল এদের খাদ্য। এছাড়া আছে অস্ট্রেলিয়ার এমু পাখি। এরাও উড়তে অক্ষম। তবে, ঘণ্টায় পঞ্চাশ কিলোমিটার বেগে ছুটতে পারে এই এমু। পারে সাঁতার কাটতেও। বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ আর পোকামাকড় হল এদের খাদ্য।
আলিপুর চিড়িয়াখানার বরাবরের বিশেষত্ব হল এখানকার সাদা বাঘ। এখানে অনেকগুলো সাদা বাঘের দেখা পাওয়া গেল। নিজস্ব ‘ডেন’-এ সিংহ-সিংহীর জোরকদম পায়চারিও নজরে পড়ল। বিশাল জলাশয়ে একশৃঙ্গ গন্ডার ও জলহস্তীও পুরনো ঐতিহ্য মেনে রয়েছে। ছোটবড় নানান মাপের হাতির দল দিব্যি খোশমেজাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে দেখতে পাবে। নিজের এনক্লোজারে দুটো জেব্রাকে ছুটোছুটি করতে দেখলাম। আবার জিরাফের এনক্লোজারে দেখলাম, প্রাণীগুলি লম্বা গলা বাড়িয়ে গাছের মগডাল থেকে পাতা ছিঁড়ে খেতে ব্যস্ত!
একসময় এই চিড়িয়াখানায় আড়াইশো বছর বয়সের ‘অদ্বৈত’ নামক কচ্ছপটি বাস করত। অদ্বৈত বেঁচে না থাকলেও এখানে বিভিন্ন সাইজের অনেকগুলো কচ্ছপ রয়েছে। প্রত্যেক পশুপাখিদের এনক্লোজারের সামনে বোর্ডে ছবি সহ সেই পশুপাখিদের নাম, দেশ, খাদ্যতালিকাও দেওয়া আছে। সুতরাং দেখতে দেখতে তোমাদের শেখাও হয়ে যাবে! পশুপাখি তো অনেক দেখা হল, এবার চল যাই ‘ সরীসৃপ ভবন’-এ। আলাদা এই ভবনে কাচের এনক্লোজারের ভেতরে রয়েছে সারি সারি সাপ! তাদের কেউ কেউ বিষধর, কেউ আবার নির্বিষ। বোর্ডে লেখা রয়েছে তাদের নাম— ইয়েলো অ্যানাকোন্ডা, বল্ পাইথন, লাউডগা, কেউটে, বার্মিজ পাইথন, দাঁড়াস, গোসাপ আরও কত জানা-অজানা সাপ! কেউ নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে, আবার কেউ চুপচাপ শুয়ে রয়েছে। সরীসৃপ ভবনের থেকে একটু এগলেই আছে একটা বিশাল প্যাঁচার মূর্তি! তার পেটের ভেতর আছে নক্টারনাল হোম। প্যাঁচার মতো নিশাচর প্রাণীদের আবাসস্থল।
আলিপুর চিড়িয়াখানা হল এমন এক জায়গা যেখানে জল-স্থল-অন্তরীক্ষ তিন দিকের বাসিন্দারই দেখা পাওয়া যায়। তাই চিড়িয়াখানা সংলগ্ন অ্যাকোরিয়ামটা দেখতে ভুলো না যেন আবার! ওখানে কাচের ভেতর রয়েছে নানান প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণী। দেখতে দেখতে মনে মনে পৌঁছে যাবে জলের নীচের রাজত্বে! একটা কারণে মনটা খারাপ হয়ে গেল! আগে শীতকালে চিড়িয়াখানার ঝিল ভরে থাকত পরিযায়ী পাখির ঝাঁকে, সেই ঝিল এখন শূন্য পড়ে রয়েছে তাদের আসার প্রতীক্ষায়। কিন্তু একটা পরিযায়ী পাখিও আসেনি! সবটাই হল উষ্ণায়নের কুফল! স্যুভিনির শপ থেকে চিড়িয়াখানার ‘মেমেন্টো’ অবশ্যই নিয়ে নিও! পাবে বাঘ-সিংহ-হাতি-শিম্পাঞ্জির মুখোশ! জন্তু-জানোয়ারের ছবি দেওয়া কফি মাগ, চাবির রিং, টিশার্ট, পেন্সিল, ইরেজার আরও কত কিছু!
তাহলে, আর দেরি কেন! দেড়শো বছরের আলিপুর চিড়িয়াখানা ঝটপট দেখে এসো!