আমাদের এই দেশকে গড়ে তোলার জন্য অনেকে অনেকভাবে স্বার্থত্যাগ করে এগিয়ে এসেছিলেন। এই কলমে জানতে পারবে সেরকমই মহান মানুষদের ছেলেবেলার কথা। এবার স্বামী বিবেকানন্দ। লিখেছেন চকিতা চট্টোপাধ্যায়।

‘জীবে প্রেম করে যেইজন,
সেইজন সেবিছে ঈশ্বর’
বলেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ, যিনি ছিলেন আধুনিক ভারতের অন্যতম রূপকার!সংস্কার ও আচারের বেড়াজাল সরিয়ে দেশকে জাগিয়ে তুলেছিলেন নতুন মানবতাবোধ ও জাতীয়তাবাদে! আজ তোমাদের শোনাব সেই মহামানবের জীবন কথা।
ঊনবিংশ শতাব্দী হল বাংলার নবজাগরণের যুগ। ঠিক সেই যুগ-সন্ধিক্ষণে নরেন্দ্রনাথের আবির্ভাব ১৮৬৩ সালের ১২ জানুয়ারি সিমলার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে পিতা প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী বিশ্বনাথ দত্ত ও ধর্মপ্রাণা মাতা ভুবনেশ্বরীদেবীর ঘরে। কাশীর বীরেশ্বর শিবের কাছে প্রার্থনা করে ভুবনেশ্বরী পেয়েছিলেন নরেন্দ্রনাথকে, তাই তাঁর ডাকনাম ছিল বীরেশ্বর। আদর করে সবাই ডাকত ‘বিলে’। ছোট্ট বিলের দুরন্তপনায় সবাই অস্থির! তাঁর প্রিয় খেলা ছিল ‘ধ্যান-ধ্যান’। ঘুমনোর আগে প্রতিদিনই তাঁর জ্যোতিদর্শন হতো!
মায়ের কাছেই বাংলা ও ইংরেজি বর্ণমালা শিক্ষা দিয়ে শুরু হল তাঁর শিক্ষাজীবন। ১৮৭৯ সালে মেট্রোপলিটন স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স ও জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশান (বর্তমানের স্কটিশচার্চ কলেজ) থেকে ১৮৮৪ সালে বি.এ. পাশ করলেন। বক্সিং, কুস্তি, ক্রিকেট, অভিনয়, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এমনকী রান্নাবান্নাতেও তিনি ছিলেন পারদর্শী। কলেজের অধ্যক্ষ কবি ও দার্শনিক উইলিয়াম হেষ্টির প্রভাবে আধ্যাত্মিক চিন্তার দিকে মনোযোগী হয়ে পড়লেন ছাত্রজীবনেই। মনের মধ্যে জেগে উঠল সত্যকে জানবার আকুলতা! 
১৮৮০ সালে সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের বাড়িতে প্রথম দর্শন পেলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেবের। সুগায়ক নরেন্দ্রনাথ শোনালেন গান, যা শুনে মুগ্ধ ঠাকুর নরেনকে আমন্ত্রণ জানালেন দক্ষিণেশ্বর যাবার। যে সত্যের সন্ধান নরেন করছিলেন এতকাল, সেই সত্যের পথ তাঁকে চেনালেন ঠাকুর, দিলেন মানব-সেবার দীক্ষা! 
১৮৮৬ সালের ১৬ আগস্ট মহাসমাধি হল ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেবের। গুরুভাইদের নিয়ে বরানগরে একটি পুরনো ভাঙা বাড়িতে নরেন্দ্রনাথ প্রথম প্রতিষ্ঠা করলেন শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ। এরপর ঠাকুরের আদর্শ প্রচারের কাজে লিপ্ত হলেন তাঁরা। নরেন্দ্রনাথ বেরলেন পায়ে হেঁটে ভারত পরিক্রমায়। পরিচয় ঘটল সমাজের উঁচু -নিচু সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে। এঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন খেতরির মহারাজা, কারণ নরেন্দ্রনাথের ‘বিবেকানন্দ’ নামটি তাঁরই দেওয়া। ভারতভ্রমণ শেষে তিনি পৌঁছলেন দক্ষিণ ভারতের কন্যাকুমারিকায়। এখানে সমুদ্রের বুকে ভারত ভূখণ্ডের শেষ প্রস্তরখণ্ডের ওপরে ধ্যানাসনে বসে মনে মনে গ্রহণ করলেন ঘুমিয়ে থাকা মানব সমাজকে জাগিয়ে তোলার জীবন-ব্রত!
মাদ্রাজের (অধুনা চেন্নাই) বহু মানুষ তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁকে অনুরোধ করলেন আমেরিকার বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলনে যোগ দেবার জন্য। নরেন পেলেন স্বয়ং ঠাকুরের স্বপ্নাদেশ। মা সারদাও অনুমতি দিলেন তাঁকে বিদেশযাত্রার।
১৮৯৩ সালে আমেরিকায় এলেন বিবেকানন্দ। অপ্রত্যাশিত সাহায্য পেলেন হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাইটের কাছে, যিনি তাঁকে জোগাড় করে দিলেন যোগ দেবার পরিচয়পত্র।
১১ সেপ্টেম্বর শুরু হল ধর্মমহাসভা। স্বামী বিবেকানন্দ ‘আমেরিকার বোন ও ভায়েরা’ সম্বোধন করে শুরু করলেন তাঁর বক্তৃতা। সাত হাজার শ্রোতা বিপুল করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানাল তাঁকে। সকলেই শ্রেষ্ঠ বক্তা হিসেবে তাঁকে স্বীকার করে নিলেন। শিকাগোর রাস্তায় রাস্তায় টাঙ্গানো হল তাঁর ছবি। আমেরিকার আরও বহু শহরে বক্তৃতা দিলেন স্বামীজি। সেখানকার অনেকেই শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন তাঁর। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন মার্গারেট নোবল, যাঁকে আমরা ভগিনী নিবেদিতা নামে চিনি।
দেশে ফিরতেই পেলেন বীরোচিত সংবর্ধনা! ১৮৯৭ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন রামকৃষ্ণ মিশন এবং ১৮৯৮ সালে বেলুড়ে স্থাপন করলেন শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ। সেই সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণের শিক্ষা প্রচারের জন্য প্রকাশ করতে শুরু করলেন বাংলা ও ইংরেজিতে দুটি মাসিক পত্রিকা ‘উদ্বোধন’ ও ‘প্রবুদ্ধ ভারত’। তিনি গুরুত্ব দিয়েছিলেন স্ত্রী শিক্ষা এবং সমাজের সকল স্তরে শিক্ষাকে পৌঁছে দেওয়ার ওপর। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সফল কথ্য ভাষার একজন প্রবর্তক হিসেবে তিনি নিজে লিখেছেন ‘রাজযোগ’, ‘কর্মযোগ’, ‘জ্ঞানযোগ’, ‘বর্তমান ভারত’, ‘পরিব্রাজক’ প্রভৃতির মতো বই। ভারতবর্ষের সর্বযুগের সর্বকালের যুবসমাজকে তিনি উদ্বুদ্ধ করেছেন। বলেছেন, ‘ওঠো, জাগো লক্ষ্যে পৌঁছবার আগে থেমো না’। তাই তো তাঁর জন্মদিবসটি ‘যুবদিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে থাকে।
১৯০২ সালের ১ জুলাই মাত্র উনচল্লিশ বছর বয়সে ধ্যানের মধ্যেই মহাপ্রয়াণ ঘটে এই মহামানবের!