প্রায় সম্পূর্ণ কাজে আকস্মিক বিঘ্ন আসতে পারে। কর্মে অধিক পরিশ্রমে স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা। ... বিশদ
অন্যজন লিখলেন, ‘কিতনা খওফ হোতা হ্যায় শাম কে আন্ধেরো মে/পুছ আন পরিন্দো সে জিনকে ঘর না হোতে।’ অর্থাৎ সন্ধ্যার অন্ধকারের মধ্যে কতটা ভয় মিশে আছে? সেইসব পাখিদের জিজ্ঞাসা কর যাদের ঘর নেই। প্রথম লেখাটি মহম্মদ ইব্রাহিম জওকের লেখা শায়েরি। দ্বিতীয়টি মির্জা আসাদুল্লা গালিবের রচনা।
আজীবন পরস্পরকে ঈর্ষা করে গেলেন। এবং পরস্পরকে গোপনে সম্মানও করে গেলেন। মহম্মদ ইব্রাহিম জওকের সৌভাগ্য যে, তিনি মাত্র ১৯ বছর বয়সেই ঢুকে পড়েছিলেন মুঘল দরবারে। শায়েরি, আয়াত, গজল রচনা করে মুগ্ধ করেছেন সম্রাট ও তাঁর পরিবারকে। মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ ছিলেন শের শায়েরি গজলের ভক্ত। তিনি ছিলেন হৃদয়পন্থী। অর্থাৎ যে রচনা সরাসরি হৃদয়কে বিদ্ধ করবে, আচ্ছন্ন করবে, আপ্লুত করবে, সেটাই হল আসল শিল্প। ঘটনাচক্রে মহম্মদ ইব্রাহিম জওক ছিলেন ঠিক সেরকমই এক কবি। যা শুধু সমঝদার সম্রাট অথবা বিদ্বজ্জনই নয়, রসাস্বাদন করতে পারতেন সাধারণ মানুষও। তিনি ছিলেন জীবনের সন্ধানী।
মির্জা গালিব ছিলেন বিপরীত। তিনি জীবনের মধ্যে থাকা যে নানাবিধ বৈপরীত্য, এই নশ্বর জীবনের বাইরে বহমান কুয়াশাময় এক রহস্যজগৎ এবং যা জীবন থেকে আহরণ করা অসাধ্য সেই বোধকেই শব্দ দিয়ে বাস্তবের মতো করে নির্মাণ করে লৌকিক-অলৌকিকের সীমারেখা মুছে দেওয়ার চিরপ্রয়াসী। তাই জওকের শায়েরি বুঝতে তীব্রভাবে মস্তিষ্ক ঘামাতে হয় না। দুর্বোধ্য মনে হয় না। আর গালিব প্রত্যক্ষ জীবনের কথা বললেও সেখানে মিশে থাকে একটি মৃদু আলেয়ার আলো। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে। কাছে যেতে মোহগ্রস্ত করছে। অথচ মনে হচ্ছে যেন, কাছে যেতে পারলাম না পুরোপুরি। দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরের দরবারে স্বাভাবিকভাবেই সভাকবির স্থান পেয়েছিলেন মহম্মদ ইব্রাহিম জওক। গালিব পাননি। যা ছিল গালিবের এক অপ্রাপ্তি ও ঈর্ষা। তিনি সেই স্থান পেয়েছিলেন বটে। তবে সেটা ১৮৫৪ সালে জওকের মৃত্যুর পর। আর জওকের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার পর গালিব প্রতিটি শায়েরি সভায় আক্ষেপ করতেন, জওক নেই বলে। অর্থাৎ তিনি বিশ্বাস করতেন জওকই একমাত্র গালিবের শায়েরির অভ্যন্তরীণ অনুভবকে স্পর্শ করতে পারতেন। বুঝতেন।
সমকালে কিন্তু গালিবের তুলনায় দরবার ও দিল্লিতে জওকের জনপ্রিয়তা ছিল তুলনামূলকভাবে বেশি। কারণ তাঁর সহজবোধ্যতা। অথচ মহাকালের বিস্ময়কর প্রবণতা আছে। জীবনদেবতার হাতে রয়েছে একটি অদৃশ্য নাগরদোলা। সেখানে দেখা যায়, আজ যে উপরে, কাল সে নীচে। আজ যে খ্যাতির শীর্ষে, কাল সে বিস্মৃতপ্রায়। ঠিক এই চিত্রই প্রতীয়মান হয়েছে ঊনবিংশ শতকের সবথেকে খ্যাতনামা দুই উর্দু শায়রের ক্ষেত্রে। যে জওক ছিলেন মুঘল দরবারের সভাকবি এবং অতীব জনপ্রিয় ও খ্যাতনামা। সেই জওকের নাম আজ সাধারণ মানুষের মন থেকে প্রায় মুছে গিয়েছে।
পক্ষান্তরে যে মির্জা গালিব আক্ষেপ করতেন যে, তিনি হৃদয় খুঁড়ে, মস্তিষ্ককে রক্তাক্ত করে একটি একটি করে পঙ্ক্তি লিখছেন, অথচ সম্রাটের চোখে, সাধারণের চোখে জওক অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছেন। সেই গালিবই কিন্তু শেষ পর্যন্ত শ্রেষ্ঠত্ব ও জনপ্রিয়তার আকাশ স্পর্শ করে রইলেন উত্তরকালে!
পাহাড়গঞ্জে সভাকবি জওককে সপরিবারে থাকার জন্য বাসস্থান দিয়েছিলেন সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর। যা লালকেল্লা থেকে দূরে। গালিব থাকতেন লালকেল্লার অদূরেই বাল্লিমারানে। মানুষের সঙ্গে কথা বলতে বলতে, কোথাও জটলা দেখলে দু’দণ্ড বসে যেতেন। মানুষকে দু’পঙ্ক্তি শায়েরি শুনিয়ে হেঁটেই দরবারে যেতেন গালিব। আর জওক প্রতিদিন পালকি অথবা হাতিতে চেপে আসতেন রাজদরবারে।
বাল্লিমারানে গালিবের বাড়ি আজও এক দর্শনীয় স্থান। কিন্তু কোথায় থাকতেন জওক? কেউ জানে না। পাহাড়গঞ্জের একটি স্থান নির্দিষ্ট ছিল। মনে করা হতো এখানেই ছিল জওকের বাসভবন। কিন্তু কিছু দশক আগেও ছিল সেটি একটি গণ শৌচাগার। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া দিল্লি পুরসভার থেকে ওই জমি অধিগ্রহণ করে নির্মাণ করেছে সমাধিস্থল। আসলে কিন্তু এই সমাধিস্থলেই যে জওককে সমাধিস্থ করা হয় তা নয়। কোথায় তিনি সমাধিস্থ হলেন সেটাও জানা যায় না। যা ভারী আশ্চর্যের! কারণ মুঘল দরবারের সভাকবি এবং সর্বশেষ মুঘল সম্রাটের সবথেকে প্রিয় শায়রের সমাধিস্থ পর্ব তো বেশ ধুমধাম করে হবে। তা হয়নি তাহলে?
জওকের সমাধি আছে। কিন্তু কোথায় আছে? সেটাই এক সন্ধানপর্ব পর্যটকদের কাছে। প্রথমে নামতে হবে রামকৃষ্ণ আশ্রম মার্গ মেট্রো স্টেশনে। চিত্রগুপ্ত রোড ধরে সোজা এগিয়ে বাঁদিকে দেশবন্ধু গুপ্ত রোডের দিকে। এবার সেই রাস্তা ধরে অগ্রসর হয়ে খুঁজতে হবে কোনটার নাম গলি নম্বর সিক্স!
সেই ৬ নম্বর গলিতে ঢুকেই যে পাওয়া যাবে, তা নয়। কারণ ভিতরে আছে গোলকধাঁধা। খুঁজতে হবে! একজন জানে না। দু’জন জানে না। কিন্তু কেউ না কেউ জানে। তারপর দেখা যাবে যে, সামনের ওই ছোট্ট সবুজ অযত্নে ঘেরা ঘাসজমির মধ্যে রয়েছে মহম্মদ ইব্রাহিম জওকের সমাধি। তবে প্রবেশদ্বার সর্বদা খোলা থাকে না। কারণ আসে ক’জন? সত্যি সমাধি? নাকি মিথ্যা সমাধি? জওক ছিলেন মুঘল দরবারের সভাকবি। বহু ভিড় ঘিরে থাকত তাঁকে। তাঁর সমাধি ঠিক ততটাই নির্জন! একা!