প্রায় সম্পূর্ণ কাজে আকস্মিক বিঘ্ন আসতে পারে। কর্মে অধিক পরিশ্রমে স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা। ... বিশদ
ফেলুদা ওর মানিব্যাগের ভিতর থেকে সড়াৎ করে একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে আমাকে দেখতে দিল। দেখি তাতে ছাপার অক্ষরে লেখা রয়েছে Prodosh C. Mitter, Private Investigator।
‘কৈলাস চৌধুরীর পাথর’ গল্পে আমাদের প্রথম পরিচয় হল ফেলুদার ভিজিটিং কার্ডের সঙ্গে। প্রদোষ মিত্তিরের মতো বহু পেশাদারের এই ভিটিজিং কার্ডই ছিল ব্রান্ডিং। তাই সাধারণভাবে আমরা ভিজিটিং কার্ড বললেও সেটা আসলে বিজনেস কার্ড।
ভিজিটিং কার্ডের শুরুটা হয় একটু অন্যভাবে, আঠারো-উনিশ শতকের ইউরোপে। আর সেই প্রথা রীতিমতো জাঁকিয়ে বসেছিল ঔপনিবেশিক ভারতে। কারওর বাড়ির কড়া নেড়ে গৃহকর্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চাওয়ার কথাও ভাবা যেত না ভিক্টোরিয়ার যুগে। আর তাই নিজের আগমন ঘোষণা করার জন্য কার্ড দেওয়ার বাধ্যতামূলক প্রথা থেকে এই কার্ডকে ‘কলিং কার্ড’-ও বলা হতো।
কোনও নতুন জায়গা একজন নবাগতকে কতটা গ্রহণ করল, সেটা বোঝা যেত এই কার্ডের দেওয়া নেওয়ার সূক্ষ্ম সামাজিকতায়। ফর্মাল পোশাক পরে একগুচ্ছ ভিজিটিং কার্ড নিয়ে বিভিন্ন বাংলোয় দেখা দিতেন নতুন আগন্তুকরা। বাড়ির মহিলাটি গাড়িতে বসে থাকতেন। আর তাঁর স্বামী স্ত্রীর কার্ড নিয়ে দিয়ে আসতেন। গৃহ সহায়ক খুব গম্ভীরভাবে কার্ডটি গ্রহণ করতেন। বাড়িতে একাধিক মহিলা থাকলে প্রত্যেকের জন্য আলাদা করে কার্ড দেওয়ার প্রথা ছিল। কার্ডটি গৃহকর্ত্রীর কাছে পৌঁছলে তিনি সিদ্ধান্ত নিতেন যে, অতিথিদের সঙ্গে দেখা করবেন কি না। তবে সাধারণ প্রথা ছিল প্রথমেই জানিয়ে দেওয়া যে, মালকিন বাড়ি নেই— ‘নট অ্যাট হোম’। প্রথম দিকে কার্ড হাতে পাওয়ার পর পরিবর্তে অতিথিদের হাতেও তুলে দেওয়া হতো কার্ড। যার মাধ্যমে ইঙ্গিত দেওয়া যে, এই আলাপ পরিচয়ের পর্ব চালিয়ে যেতে গৃহকর্ত্রীর আপত্তি নেই। তবে সেই রিটার্ন কার্ড না দেওয়া হলে বা খামের মধ্যে দেওয়া হলে খুব সূক্ষ্মভাবে উল্টোটা বোঝানো হতো। পরবর্তী সময়ে রিটার্ন কার্ড দেওয়ার প্রথা উঠে গিয়ে নবাগতদের ডিনার বা চায়ের নিমন্ত্রণ করা হতো।
উনিশ শতকের কার্ড দেওয়া-নেওয়ার মধ্যে খুব কৌতূহলব্যঞ্জক দিক ছিল কার্ডের কোনা ভাঁজ করা। নানা ভাঁজের নানা মানে। উপরের ডান দিকের কোনা ভাঁজ করার অর্থ কার্ডের মালিক স্বয়ং এসেছিলেন। কাউকে অভিনন্দন জানানোর উদ্দেশ্যে এলে কার্ডের উপরের বাঁ-দিকের কোনা আর সমবেদনা জানানোর জন্য এলে নীচের বাঁ-দিকের কোনা ভাঁজ করে দেওয়ার হতো। আবার লম্বা ছুটিতে যাওয়ার আগে বিদায় জানানোর জন্যে দেখা করতে এলে নীচের ডান দিকের কোনা ভাঁজ করে রেখে যেতেন দর্শনার্থী।
এই দেখা করা ও কার্ড দেওয়ার সহবত বা এটিকেটের কোনও সর্বজনগ্রাহ্য সাধারণ নিয়ম ছিল না। বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির নিয়মের সঙ্গে মাদ্রাজ বা বম্বে প্রেসিডেন্সির নিয়ম মিলত না। ব্যাচেলাররা দেখা করতে এলে, দস্তুর ছিল গৃহকর্তা ও গৃহকর্ত্রীর জন্য দু’খানি কার্ড রেখে যাওয়ার। অবশ্য ব্যতিক্রম ছিল নববধূদের ক্ষেত্রে। নিয়মের আরও একটি ব্যতিক্রম ছিল ভারতে অস্থায়ীভাবে নিযুক্ত ব্রিটিশ সেনা রেজিমেন্টের অফিসারদের স্ত্রীরা। তাঁরা ভারতীয় রেজিমেন্টের ব্রিটিশ অফিসারদের স্ত্রীদের সঙ্গে প্রথম দেখা করতে যেতেন না। আর এটা নিয়ে দ্বিতীয় পক্ষের গভীর অসন্তোষের কথাও গোপন থাকেনি সেকালের নানা সামাজিক দলিলে।
এই সামাজিক নিয়মের সূক্ষ্ম তারতম্যের ফলে নতুন আগন্তুকটি অনেক সময়েই সামাজিক বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতেন। তেমন ঘটনার সাক্ষী বিশ্বনাথ লাহিড়ী, যিনি দেশ স্বাধীন হওয়ার পর উত্তরপ্রদেশের প্রথম ভারতীয় আইজি হয়েছিলেন। ব্রিটিশ আমলে সদ্য চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর তাঁর ট্রেনিং হয় মুরাদাবাদে। ট্রেনিং কলেজের প্রিন্সিপাল তাকে সেখানকার বিবাহিত অফিসারদের এক তালিকা দিয়ে তাঁর সুবিধামতো কার্ড রেখে আসতে বলেন। গত শতকের দ্বিতীয় দশকে অভিজাত বাংলোতে শুধু গৃহকর্ত্রীর নাম লেখা ‘নট অ্যাট হোম’ বাক্স টাঙানো থাকত। নবাগত ব্যাচেলারের উচিত ছিল দু’টি কার্ড সেই বাক্সে ফেলে আসা। কিন্তু এক বাড়িতে শুধু একটি কার্ড ফেলে এসে মহা বিড়ম্বনায় পড়েন লাহিড়ী মশাই। অন্য এক বাড়িতে গিয়ে শুনলেন যে সাহেব বাড়ি নেই। সেক্ষেত্রেও দু’টি কার্ড ছেড়ে আসার নিয়ম না মেনে মেমসাহেবের সঙ্গে দেখা করার জন্য বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলেন বিশ্বনাথবাবু। তাই গৃহকর্ত্রী বাধ্য হলেন তাকে ভেতরে ডাকতে। ফলে ভদ্রলোক আবার সমাজে হাসির খোরাক হলেন। দেখা করতে যাওয়া ও ভিজিটিং কার্ড দেওয়ার সামাজিক প্রথাকে মানুষ ঠিক কতটা গুরুত্ব দিতেন, সেটা বোঝা যায় ইউরোপ ও আমেরিকায় প্রকাশিত সামাজিক শিষ্টাচার বা এটিকেট-এর বিভিন্ন গাইড বইতে ভিজিটিং কার্ড দেওয়া-নেওয়া মান্য প্রথা থেকে শুরু করে তার নকশা ও বিষয়বস্তু নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা। ১৯৩৩-এ প্রকাশিত এটিকেটের বইতে লিলিয়ান আইকলার লিখছেন, কার্ড সব সময় সরল টাইপফেস ব্যবহার করে সাদার উপর কালো দিয়ে ছাপা উচিত। রংচঙে ও জমকালো কার্ড তার মালিকের সন্দেহজনক রুচির পরিচয় বহন করে। পরবর্তী সময়ে দুনিয়া কাঁপানো সঙ্গীত দল ‘বিটলস্’ যখন বিখ্যাত হয়নি, সে সময়ে তাদের কার্ড দেখে সেই রুচির কথাটাই মনে হয়।
১৯২৮ সালের কলকাতার সাহেব এলাকাগুলিতেও এই সামাজিক প্রথা চালু থাকার কথা জানা যায়। ব্রিটিশ আমলের শেষদিকে শৈশব কাটানো মানুষদের স্মৃতিকথা নিয়ে লরেন্স ফ্লেমিং সংকলনে জনৈক অ্যান বার্কিনশ’ বলছেন যে, বালিগঞ্জের সানি পার্ক ছেড়ে তাঁরা আলিপুরে যে বাড়িতে উঠলেন, সেখানে কলিং কার্ডের জন্য আলাদা বাক্স ছিল। নতুন বাড়িতে এসে তিনিও তাঁর মায়ের সঙ্গে অন্য বাড়িতে কলিং কার্ড ছাড়তে যেতেন।
কার্ড রাখার কেস যেমন কাগজের মণ্ড, কাঠ বা কচ্ছপের খোলের মতো সহজলভ্য জিনিস দিয়ে তৈরি হতো, তেমনই সোনা, রুপো বা হাতির দাঁতের কেস ব্যবহার করতেন অভিজাতরা। দক্ষিণ ভারত, কচ্ছ, কাশ্মীর, লখনউ, কলকাতা— সব জায়গার কারিগররা নিজেদের শিল্পের বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলতেন এই কাজে। কলকাতায় এই কাজে কুক অ্যান্ড কেলভি অথবা হ্যামিল্টনের অ্যান্ড কোং-এর মতো সাহেব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমানে পাল্লা দিতেন এই শহরের বাঙালি সংস্থা, যেমন দাস অ্যান্ড দত্ত, গিরীশচন্দ্র দত্ত বা গোপীনাথ দত্ত। এই প্রতিষ্ঠানগুলির বিশেষত্ব ছিল স্থানীয় গ্রামীণ বা সামাজিক দৃশ্যকে রুপোর বিভিন্ন পাত্রে ফুটিয়ে তোলা। কলকাতার কারিগরদের হাতের কার্ড কেস ঔপনিবেশিক শিল্পসামগ্রীর নিদর্শন হিসেবে বিশেষ মর্যাদা পেয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ভিজিটিং বা কলিং কার্ড দেওয়া-নেওয়ার প্রথা ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে গিয়ে কার্ড বলতে একমাত্র চালু থাকে বিজনেস কার্ড। ঠিক যেমন অপ্সরা থিয়েটার মামলায় ‘লালমোহন গাঙ্গুলী, রাইটার’ লেখা কার্ড ছাপিয়েছিলেন জটায়ু।