কর্মে সাফল্য ও সুনাম বৃদ্ধি। ব্যবসায় অগ্রগতি ও প্রসার। অর্থাগম যোগ শুভ। স্বাস্থ্য বিশেষ ভালো ... বিশদ
বাংলায় সেই দ্রোহকাল তিন বছরের। লড়াই শুরু ১৯৪৬-এ। এর মধ্যে দেশটা ভাগ হয়ে গিয়েছে। শাসন পাল্টে গিয়েছে। চলে গিয়েছে ১৫ আগস্ট, ১৯৪৭। তার মধ্যেই কিছু বদ্ধপাগল মানুষ আর প্রগতি শিবিরের টানে আসা কিছু লেখক, ছবি আঁকিয়ে, গায়ক, সঙ্গীতকার বেমালুম নিজেদের স্বপ্নগুলোর সঙ্গে চাষিদের লড়াইয়ে একটা গিঁট বেঁধে ফেলেছিলেন।
এই সময়ই দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার রাজপুর-সোনারপুর-বারুইপুর অঞ্চলের খেপুদা (খগেন রায়চৌধুরী) আবিষ্কার করেছিলেন সলিল চৌধুরীর সাংস্কৃতিক দক্ষতা। দুর্ভিক্ষে মৃতপ্রায় বাংলা খুঁজে পেয়েছিল বেঁচে ওঠার গণসঙ্গীত। ‘হেই সামালো হেই সামালো/ হেই সামালো ধান হো, কাস্তেটা দাও শান হো..।’ এ দেশের কৃষিজীবী মানুষের নিজের জমি আর ফসলের উপর যে অধিকার রয়েছে তার দৃঢ়তার পিছনে এক ঋজু স্তম্ভ ছিল তেভাগা আন্দোলন।
আসলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসিত ভারতে এক নতুন ধরনের জমিদারশ্রেণির পত্তন হয়েছিল। ১৯২০ সাল থেকে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে কৃষকরা কর-মকুব, কর-ছাড়ের আন্দোলন করতে থাকেন। পাঞ্জাবে গদর পার্টির নেতৃত্বে, গুজরাতে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে কর-মকুব করার দাবি নিয়ে কৃষকরা সংগঠিত হতে থাকেন। দাবি উঠতে থাকে ফসলের এক-তৃতীয়াংশের বেশি খাজনা না দেওয়ার।
১৯৪৬-এর ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়। লক্ষ লক্ষ বর্গাদার (আধিয়ার) ফসল তোলেন নিজেদের খামারে। হাজার হাজার কৃষকের বিরুদ্ধে মামলা হয়। যে আন্দোলন ছিল আধিয়ারদের, তা অচিরেই হয়ে ওঠে ভূমিহীন খেতমজুরদেরও আন্দোলন। কৃষক নেতা অবনী লাহিড়ীর কথায়, ‘যখন তেভাগা আরম্ভ হয়, ভূমিহীনরা ও দিনমজুররা ব্যাপকভাবে যোগ দিয়েছিলেন। অথচ, এই শ্রেণিটির রাজনৈতিক দাবি আমাদের প্রত্যক্ষ কর্মসূচিতে বিশেষ কিছু ছিল না। আমরা, এমনকী আধিয়াররাও ভাবতে পারেনি দিনমজুররা এভাবে জঙ্গি মনোভাব নেবেন।’ ১৯৪৭ সালের ৪ জানুয়ারি দিনাজপুরের চিরির বন্দরের তালপুকুর গ্রামে পুলিসের গুলিতে শহিদ হন সমিরুদ্দিন আর শিবরাম। তেভাগা বিদ্রোহের প্রথম শহিদ তাঁরাই। সমিরুদ্দিন ছিলেন খেতমজুর আর শিবরাম ছিলেন সাঁওতাল আধিয়ার।
সালটা ১৯৪৭। তারিখ ২০ ফেব্রুয়ারি। আধা নয়, তে-ভাগ চাই। জান দেব, তবু ধান দেব না— কৃষকদের স্লোগানে বালুরঘাটের খাঁপুর গ্রামের মাটি সেদিন কেঁপে উঠেছিল। জমিদার এবং ব্রিটিশ পুলিসের সামনে মাদলের তালে বুক চিতিয়ে স্লোগান দিচ্ছিলেন যশোদারানি সরকার, কৌশল্যা কামারনি, চিয়ারসাই শেখ, গুরুচরণ বর্মন, মাঝি সরেন, হোপনা মার্ডিরা। তাঁদের পিছনে শতাধিক চাষি। পাঁজরের হাড় বের হওয়া খালি গা। পরনে বস্ত্র বলতে হাঁটু পর্যন্ত এক টুকরো মলিন ধুতি। ডুগডুগি বাজিয়ে দীর্ঘ বঞ্চনার প্রতিবাদ ও ধানের অধিকারের দাবিতে সোচ্চার হয়ে দলটি এগিয়ে যেতেই পুলিস এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে শুরু করে। গুলিতে ২২ জন নিহত কৃষকের রক্তে লাল হয়ে ওঠে খাঁপুরের মাটি। ৫০ জনের বেশি কৃষক পুলিসের গুলিতে জখম। নিরস্ত্র চাষিদের উপর ব্রিটিশ পুলিসের ১৩১ রাউন্ড গুলি চালানোর ঘটনা প্রকাশ হতেই শিউরে উঠেছিল গোটা দেশ। সাক্ষী আত্রেয়ী নদী...
ততদিনে কৃষক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল অবিভক্ত বাংলার ১৯টি জেলায়। নবজাগরণের তূর্যবাদন। উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর, রংপুর, জলপাইগুড়ি তখন তেভাগার প্রধান লড়াই কেন্দ্র। এছাড়া চব্বিশ পরগনা, মালদা, যশোর, খুলনা, বগুড়া, ঢাকা, ফরিদপুর, নোয়াখালি, চট্টগ্রাম, পাবনা, মেদিনীপুর, নদীয়া, হুগলি, হাওড়া, বাঁকুড়া, বীরভূমেও ছড়িয়ে পড়েছিল তেভাগার স্ফুলিঙ্গ। অজিত বসু, বিষ্ণু চট্টোপাধ্যায়, ইলা মিত্র, কংসারী হালদার, সুশীল সেন, নুর জালাল, কৃষ্ণবিনোদ রায়, ভূপাল পাণ্ডাদের নেতৃত্বে গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছিল কৃষক সভার আওয়াজ: আধি নাই, তেভাগা চাই। বিনা রসিদে ভাগ নাই। পাঁচ সেরের বেশি সুদ নাই। কর্জ ধানে সুদ নাই। বাজে কোনও আদায় নাই। জমি থেকে উচ্ছেদ নাই। জান দেব তবু ধান দেব না। নিজ খোলানে ধান তোল। লাঙল যার জমি তার...
বিদ্রোহী কৃষকরা চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন তাঁদের মূল শত্রুকে। প্রায় সাড়ে পাঁচ লক্ষ মধ্যবিত্ত পরিবারের হাতে প্রায় বিশ লক্ষ আবাদি জমি থাকলেও, অল্প সংখ্যক জোতদার-জমিদারের অধীনে ছিল প্রায় এক কোটি একর আবাদি জমি। প্রকৃত শত্রু বড় জমিদার-জোতদার, আমলাতন্ত্র। চব্বিশ পরগনার সংগ্রামী কৃষক নেতা হেমন্ত ঘোষাল লিখেছেন, ‘গ্রামে গ্রামে প্রচারাভিযান সংগঠিত হল। বলা হল, তেভাগার লড়াইয়ে নামতে তিনটি শর্ত পূরণ করতে হবে। পরিবারপিছু একজন যুবক, একটি টাকা ও একটি লাঠি দিতে হবে। অদ্ভুত সাড়া পাওয়া গেল। ২০ দিনের মধ্যে ১ হাজার ২০০ জোয়ান ছেলে, ১ হাজার ২০০ টাকা ও ১ হাজার ২০০টি লাঠি সংগৃহীত হল।... পরিবারের শক্ত-সমর্থ পুরুষটিকে লড়াইয়ে পাঠিয়েই তারা ক্ষান্ত হল না, ঘাঁটি আগলানোর জন্য ২০ দিনের মধ্যেই ১ হাজার ৫০০ জনের সংগঠিত নারী প্রতিরোধবাহিনী গড়ে তুলল।’ বাংলাদেশের নড়াইলে কৃষকনেত্রী সরলা সিংয়ের নেতৃত্বে তিনশো নারীর সংগ্রামী বাহিনী লড়াইয়ের ময়দানে।
মেদিনীপুরে মহিলা নেত্রী বিমলা মাজীকে পাঠানো হল মেয়েদের সংগঠিত করার জন্য। চোদ্দো বছরে বিধবা হওয়া ইস্তক থান পরতে হতো মেদিনীপুরের মেয়েটিকে। সাল ১৯৪৩। পাড়হীন শাড়িতে বিষণ্ণ, মাইতি-বাড়ির মেয়েটির জীবন একদিন আমূল বদলে যায়। রঙিন শাড়ি পরিয়ে তাঁকে কর্মযজ্ঞে টেনে আনেন বাম আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী মণিকুন্তলা সেন। সেই বিমলাই হয়ে ওঠেন মেদিনীপুরের তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী। তেভাগার তিন বছর অনেকগুলো ভাগাভাগি মুছে দিতে পেরেছিল। না খেতে পাওয়া মুসলিম কৃষকের সঙ্গে না খেতে পাওয়া হিন্দু চাষার ভাগাভাগি দূর হটেছিল। তাদের মরদ, ব্যাটা-র জান-ধান বাঁচাতে গিয়ে মেয়েদের কাজ ছেলেদের কাজের ভাগাভাগিও গিয়েছিল কমে। তিন বছরে কমপক্ষে ২৭ জন কৃষক রমণীকে হত্যা করে একথার স্বীকৃতি দিয়েছিল রাষ্ট্র।
২৪ পরগনার দক্ষিণে তখন জ্বলছে আগুন। লালগঞ্জ, চন্দনপিঁড়ি— কাকদ্বীপের আশপাশের অঞ্চলগুলিতে বেজে উঠেছিল যুদ্ধের দামামা। ৬ নভেম্বর ১৯৪৮। চন্দনপিঁড়িতে হাজার হাজার কৃষক আগুন জ্বালিয়ে আন্দোলন শুরু করল। মহিলারা আসছে, শিশুরা আসছে, আর তাদের নেতৃত্বে অহল্যা। হঠাৎ পুলিসের গুলি। রক্তে ভিজে উঠল মাটি। গর্ভবতী মা অহল্যা গড়িয়ে পড়লেন মাটির রাস্তায়। কী ভয়ঙ্কর সে আগুন। সেদিন প্রাণ হারিয়েছিলেন অহল্যা, উত্তমী, বাতাসী, সরোজিনী, অশ্বিনী, গজেন্দ্র ও দেবেন্দ্র। সেই মৃত্যুর শোকে আত্মপ্রকাশ হয়েছিল সলিল চৌধুরীর ‘শপথ’। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘আমরা তো অনেক রঙিন বিপ্লবের কবিতা লিখেছি। কিন্তু শপথ লিখে সলিল বুঝিয়ে দিয়েছে ও কত বড় মাপের কবি।’
১৯৪৯-এ তেভাগার লড়াই শুরু হয় হাওড়া-হুগলিতে। ৯ সেপ্টেম্বর সাঁকরাইলের হাটাল গ্রামে ভরদুপুরে পুলিস প্রহরায় জমিদারের বাহিনী ধান কেটে নিয়ে গেলে মেয়েরা শাঁখ বাজাতে থাকেন। শুরু হয় পুলিসের সঙ্গে সংঘর্ষ। পুলিস এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে থাকে। বীরাঙ্গনার মতো লড়ে গুলিবিদ্ধ হন চোদ্দো বছরের কিশোরী-বধূ মনোরমা। নিহত হন সাধুবালা, যশোদাময়ী ও আরও ছ’জন মহিলা। ১৯ ফেব্রুয়ারি। হুগলি জেলার ডুবির ভেরিতে সন্ধ্যাবেলায় পুলিসের হামলা। মেয়েরা বাঁধের উপর দাঁড়িয়ে সেই হামলাকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন। শহিদ হন সাত মহিলা। যাঁদের অনেকেরই নাম নেই বইয়ের পাতায়, পরিচয় লেখা আছে কারও মা হিসেবে।
তখন সাঁওতাল পরগনার এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে পরিচয় গোপন করে ছুটে বেড়াচ্ছেন সাঁওতালদের ‘রানি মা’ ইলা মিত্র। কিন্তু খুব বেশি দিন প্রশাসনের নজর এড়াতে পারেননি। ১৯৫০ সালের ৫ জানুয়ারি। নাচোল রেলস্টেশনে ধরা পড়ে গেলেন ইলা মিত্র। শুরু হল অকথ্য অত্যাচার। এই স্বাধীন ভারতে লক-আপের মধ্যে কখনও রাইফেলের বাট দিয়ে থেঁতলে দেওয়া হয়েছে তাঁর হাত, কখনও আবার পেরেক ঢুকিয়ে দেওয়া হয় তাঁর পায়ের গোড়ালিতে। তবে এতকিছুর পরেও তাঁর মুখ থেকে বিন্দুমাত্র তথ্য বার করতে পারেনি পুলিস প্রশাসন।
তখন এধার-ওধার সশস্ত্র বিপ্লবের লাইন হাতড়ে বেড়ানো চলছে পুরোদমে। ১৯৪৮-এর কমিউনিস্ট পার্টি সম্মেলনে পুরণচাঁদ যোশিকে সরিয়ে পার্টি সম্পাদক হন রণদিভে। আর তার ঠিক পরেই বে-আইনি ঘোষিত হয় কমিউনিস্ট পার্টি। উত্তরে নিভে আসা তেভাগার আগুন জ্বলে ওঠে দক্ষিণ প্রান্তে। তেলেঙ্গানার গণ-সংগ্রাম। কৃষক বিদ্রোহের অন্যতম সেনাপতি পি সুন্দরাইয়া। অবিভক্ত ভারত থেকে বিভক্ত ভারতে সর্ববৃহৎ কৃষক সংগ্রাম। ১৯৪৬-’৫১ সাল। ৪ হাজার সংগ্রামী নিহত। সংগ্রামটা ছিল জমির অধিকারের সংগ্রাম। প্রায় ১৬ হাজার বর্গমাইল এলাকায় প্রায় ৩ হাজার গ্রামের আনুমানিক ৩০ লক্ষ অধিবাসী গ্রাম পঞ্চায়েতের ভিত্তিতে গ্রাম-রাজ স্থাপনে সফল হয়েছিলেন। সলিল চৌধুরী লিখলেন, ‘কাকদ্বীপে মরে আমরা আবার তেলেঙ্গানায় বাঁচি।’
আজও গোলা ভরা ধান কিনতে আসে মহাজন, নগদ টাকা দিয়ে ধানের বস্তা নিয়ে যায়, চাষির চোখ ভিজে যায়, যেন মেয়ে তাঁর শ্বশুরবাড়ি চলে গেল। তাঁর জীবন ঘিরে জমি। তাগিদ আছে ফসল ফলানোর, স্বপ্ন আছে— সোনালি ধানের স্বপ্ন। তাঁর জেদ, তাঁর লড়াইয়ের ক্ষমতার আন্দাজ পায়নি বহু শাসক। সেই ১৯১৭, সারা ভারত দেখেছিল, এক নতুন লড়াই— চম্পারণে কৃষকদের সত্যাগ্রহ, গান্ধীজির নেতৃত্ব আর ব্রিটিশদের মাথা নোয়ানো। ১৯২১, কেরলে মপালা কৃষক বিদ্রোহ। জমিদাররা হেরেছিল। ‘আমরা ২৩৫’, অহঙ্কারী উচ্চারণের মুখোমুখি বাংলার লড়াই। ৩৪ বছরের সিপিএম শাসনের অবসান। তাও ছিল কৃষক আন্দোলন। আর দীর্ঘ এক বছর ধরে চলতে থাকা আন্দোলনে জলকামান চালিয়ে, কাঁটাতার আর পেরেকের গজাল দিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করে, মিথ্যে মামলা দিয়ে, আন্দোলনজীবী বলে ব্যঙ্গ করেও শেষ পর্যন্ত কৃষি বিল প্রত্যাহার করতে হয়েছে মোদি সরকারকে। প্রধানমন্ত্রী হয়ে যে মহাত্মাকে আঁকড়ে নরেন্দ্র মোদি কংগ্রেসমুক্ত ভারত গড়তে চেয়েছেন, সেই গান্ধীই বলেছিলেন, ‘ইন্ডিয়া লিভস ইন ইটস ভিলেজেস’!
সহযোগিতায় : বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী