কর্মে সাফল্য ও সুনাম বৃদ্ধি। ব্যবসায় অগ্রগতি ও প্রসার। অর্থাগম যোগ শুভ। স্বাস্থ্য বিশেষ ভালো ... বিশদ
বঙ্গে জোর ধাক্কা খাওয়ার পর আসন্ন পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন বিজেপির ‘অ্যাসিড টেস্ট’। এই লড়াইয়ে বিজেপি জয় হাসিল করতে না পারলে ২০২৪-এর ক্ষমতা দখলের দৌড় থেকে ছিটকে যাবে। তবে, উত্তরপ্রদেশ এবং পাঞ্জাব গেরুয়া শিবিরের কাছে এবার কঠিন চ্যালেঞ্জ। উত্তরপ্রদেশ দখলে রাখতে পারলেই বিজেপির ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট টিম দেশজুড়ে নরেন্দ্র মোদির হয়ে ঢাক পেটাতে নেমে পড়বে। বঙ্গ বিজেপিও তাকিয়ে আছে সেদিকেই। কিন্তু উত্তরপ্রদেশে দলের ভাঙনে তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্নও ক্রমশ বিবর্ণ, ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে।
মর্নিং শোজ দা ডে। ইংরেজি এই প্রবাদটি সত্যি হলে বলাই যায়, যোগী আদিত্যনাথের লড়াই এবার যথেষ্ট কঠিন। কারণ তাঁর দলের অনগ্রসর মুখ বলে পরিচিত নেতারা এক এক করে তাঁকে ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। এমনিতেই হাতরাস কাণ্ড থেকে কোভিডকালে গঙ্গায় মৃতদেহ ভাসানোর ঘটনায় যোগী সরকারের ব্যাপক ড্যামেজ হয়েছে। তার উপর নির্বাচন ঘোষণা হতেই একের পর এক মন্ত্রী এবং বিধায়ক বিজেপি ছাড়ছেন। অভিমুখ সমাজবাদী পার্টি। কারণ তাঁরা বুঝতে পেরেছেন, বিজেপি ‘ডুবন্ত জাহাজ’। তাই নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ঝাঁপ দিচ্ছেন।
বাংলাতেও বিধানসভা নির্বাচনের আগে অনেকে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে গিয়েছিলেন। কিন্তু, তার সঙ্গে উত্তরপ্রদেশের দলবদলের একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। বাংলায় দলবদলের পিছনে ছিল সিবিআই, ইডি আতঙ্ক। কিন্তু উত্তরপ্রদেশের ঘটনা একেবারেই উল্টো। এখানে বিজেপি ছাড়লে রয়েছে কেস খাওয়ার ভয়। তা সত্ত্বেও ঝুঁকি নিয়ে যাঁরা জেহাদ ঘোষণা করছেন, তাঁদের আর যাই হোক আত্মসমর্পণকারী বলা যাবে না, বরং ‘বিদ্রোহী’ বলাই ভালো।
‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করায় দলত্যাগী মন্ত্রী স্বামীপ্রসাদ মৌর্যকে ‘শিক্ষা’ দিতে মাঠে নেমে পড়েছে যোগী প্রশাসন। দলত্যাগের ২৪ ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই সাত বছর আগের মামলায় মৌর্যের বিরুদ্ধে জারি করা হয়েছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। বালির বস্তা দিয়ে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা। তবে, সেই ‘বালির বস্তা’ বিদ্রোহের তোড়ে খড়কুটোর মতো ভেসে যাচ্ছে। তাই একের পর এক মন্ত্রী ও বিধায়ক বিজেপি ছাড়ছেন। আপাতত দলত্যাগী মন্ত্রীর সংখ্যা তিন এবং বিধায়ক পাঁচ হলেও লাইনে কতজন আছেন বলা মুশকিল।
দলত্যাগী দারা সিং চৌহান শুধু যোগীজি মন্ত্রিসভার সদস্যই ছিলেন না, তিনি রাজ্যের পিছিয়ে পড়া শ্রেণির অন্যতম জনপ্রিয় মুখ। তাঁর কথায়, ‘রাজ্যের কৃষক এবং কর্মহীন তরুণদের প্রতি এই সরকারের উপেক্ষা কোনওভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আর দলিত তথা অনগ্রসর শ্রেণির সংরক্ষণ নিয়ে তো রীতিমতো ছেলেখেলা করছে এই সরকার। সেই হতাশা থেকেই আমি দলত্যাগে বাধ্য হলাম।’ অথচ এই যোগীজিই বাংলায় এসে বেকারত্ব, চাষির উন্নতি নিয়ে কত না ডায়ালগ দিয়েছিলেন। চালুনিই অবশ্য সূচের বিচার করে। রামমন্দিরের শিলান্যাস হয়তো বিজেপিকে কিছুটা মাইলেজ দেবে। কিন্তু সেটা উত্তরপ্রদেশ ধরে রাখার জন্য যথেষ্ট নয়। এটা গেরুয়া শিবিরের নেতারাও জানেন। তাই লোকসভা ভোটের কথা মাথায় রেখে উত্তরপ্রদেশের ঘাটতি মেটাতে পাঞ্জাবকে টার্গেট করেছে বিজেপি। কংগ্রেসের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে আশান্বিত গেরুয়া শিবির। ফিরোজপুরে ঘটনার পর বিজেপি ভেবেছিল, তারা হাতে চাঁদ পেয়ে গিয়েছে। হঠাৎই এসে গিয়েছিল এজেন্সিকে দিয়ে কংগ্রেস সরকারকে দুরমুশ করার সুযোগ।
বেশ কিছু এজেন্সি কাগজে কলমে ‘স্বশাসিত’ হলেও নিয়ন্ত্রক কেন্দ্রীয় সরকার। এজেন্সির ‘রুট ম্যাপ’ তারাই তৈরি করে দেয়। ঘটনা পরম্পরা বলছে, বিজেপি জমানায় এজেন্সি সবসময় বিরোধী দলের ও প্রশাসনের ‘মাথা’কে টার্গেট করে। বাংলায় বিধানসভা নির্বাচনের সময়েও একই স্ট্র্যাটেজি নিয়েছিল বিজেপি। প্রথমেই পশ্চিমবঙ্গের পুলিস প্রধানকে, তারপর বেছে বেছে জেলা প্রশাসনের কর্তাদের সরিয়েছিল। বিজেপি জমানায় যেন রাজনীতির দাবা খেলা চলছে। সেই স্ট্র্যাটেজিতে একইভাবে ভোটের আগে পাঞ্জাব সরকারের মাথাগুলোকে ঘায়েল করতে চেয়েছিল বিজেপি। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও নেতাদের রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবিতে মিলেছিল তারই ইঙ্গিত। তবে, সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছেন অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। তাঁর কথায়, পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ও হাইকমান্ড সব জেনেবুঝেই প্রধানমন্ত্রীকে ‘হত্যার ষড়যন্ত্র’ করেছিল। তবে, সুপ্রিম কোর্ট দায়িত্ব না নিলে জল কতদূর গড়াত বলা মুশকিল।
ভাতিন্দা বিমান বন্দরে প্রধানমন্ত্রী ‘বেঁচে ফেরা’র কথা বলে গোটা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তারপর দিল্লি ফিরেই রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ। তখনই বোঝা গিয়েছিল, পাঞ্জাবের নির্বাচনে ‘প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা’কেই ইস্যু করতে চাইছে বিজেপি। কৃষিপ্রধান পাঞ্জাবে ‘কৃষক বিরোধী’ বিজেপির সামনে এছাড়া অন্য উপায়ও ছিল না। তাই হয়েছিল পাকিস্তান প্রসঙ্গ তুলে জাতীয় ভাবাবেগ তৈরির চেষ্টা। কিন্তু সেই চেষ্টাও বিফলে গেল।
প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার ষড়যন্ত্রের মতো একটা মারাত্মক ও জবরদস্ত ইস্যু যে এভাবে মাঠে মারা যাবে, তা বিজেপি নেতারা কল্পনাও করতে পারেননি। তাঁরা ভাবতেও পারেননি, ল’ইয়ার্স ভয়েসের করা মামলার জেরে কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে দিয়ে পাঞ্জাব সরকারকে দুরমুশ করার গেমপ্ল্যান ভেস্তে যাবে।
পাঞ্জাবের চান্নি প্রশাসনের উপর আঘাত হানার জন্য কেন্দ্রীয় এজেন্সি যে ঝড়ের গতিতে এগচ্ছিল, তা পাঞ্জাবের অ্যাডভোকেট জেনারেলের কথাতেই স্পষ্ট। শীর্ষ আদালতকে তিনি বলেছেন, ‘আমরা ইতিমধ্যেই সাতটি শোকজ নোটিস পেয়েছি। প্রতিটিতেই এই ঘটনার জন্য কড়া শাস্তির হুমকি দেওয়া হয়েছে।’ তাঁর দাবি, নোটিসের সব তথ্যই অনুমান ভিত্তিক তথা পূর্ব পরিকল্পিত। তদন্ত না করেই পাঞ্জাবের কংগ্রেস সরকারকে শূলে চড়ানোর চেষ্টা যে হয়েছিল, তা সুপ্রিম কোর্টের মহামান্য বিচারপতিদের কথাতেও ফুটে উঠেছে। কেন্দ্রের প্রতিনিধি কার্যত বিচারপতি হিমা কোহলির ভৎর্সনার মুখে পড়েছিলেন। বিচারপতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলেছিলেন, আপনারা ইতিমধ্যেই মনস্থির করে ফেলেছেন, তাহলে আর আদালতে কেন? কেন্দ্রের প্রতিনিধির কাছে অপর বিচারপতি সূর্যকান্তর প্রশ্ন ছিল, আপনারাই সরাসরি বলে দিচ্ছেন রাজ্য সরকারের অফিসাররা দোষী। এঁদের দোষী সাব্যস্ত করল কে? আর প্রধান বিচারপতি এনভি রামনার মন্তব্য ছিল আরও শ্লেষাত্মক। প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন তদন্ত কমিটির এক্তিয়ার নিয়ে।
বিচারপতিদের এই ক্ষোভের যথেষ্ট কারণ আছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত ফিরোজপুর কাণ্ডে তদন্ত বন্ধের মৌখিক নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও পাঞ্জাব সরকারের সাতজন অফিসারকে কেন্দ্র শোকজ করেছে। একই সঙ্গে দিয়েছে শাস্তির হুমকি। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা এবং কার গাফিলতিতে ফিরোজপুরের ঘটনা তার যথাযথ তদন্ত চায় সুপ্রিম কোর্ট। দেশের মানুষের সামনে সত্যিটা তুলে ধরতে চায় সুপ্রিম কোর্ট। তাই গঠন করেছে তদন্ত কমিটি।
এই কমিটি যেমন বিজেপির তোলা প্রধানমন্ত্রীকে খুনের চক্রান্তের অভিযোগ খতিয়ে দেখবে, তেমনি তদন্তের আতসকাচের নীচে যাচাই হবে এসপিজির সেদিনের ভূমিকাও। তদন্তে জানা যাবে, কৃষক বিক্ষোভের মুখে ঠেলে দিয়ে সত্যিই প্রধানমন্ত্রীকে মারার চক্রান্ত হয়েছিল, নাকি রজ্জুতে সর্পভ্রম? এটা পলিটিক্যাল স্টান্ট কি না, সেটাও জানা যাবে। একই সঙ্গে স্পেশাল প্রোটেকশন গ্রুপের অফিসারদের বিরুদ্ধে কর্তব্যে গাফিলতির যে অভিযোগ উঠেছে, তারও বিহিত হয়ে যাবে। সুপ্রিম কোর্ট বুঝিয়ে দিল, তদন্তের অজুহাতে রাজনীতি আর চলবে না। অনেকে বলছেন, ভোটের আগে দুরমুশ করার জন্যই চান্নি সরকারের অফিসারদের দিল্লিতে ডাকা হয়েছিল। ভোটের ময়দানে তাঁদের নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া অথবা ‘কাঠের পুতুল’ বানানোই ছিল লক্ষ্য। সেই উদ্দেশ্যে পাঞ্জাব সরকারের অফিসারদের দেওয়া হয়েছিল শাসানি। কেন্দ্রের বেপরোয়া মনোভাব স্পষ্ট হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অগ্রাহ্য করার মধ্যে দিয়ে। তদন্তভার হাতে নিয়ে শীর্ষ আদালত শুধু বিজেপির বাড়া ভাতে ছাই দেয়নি, দিলীপ ঘোষের ভাষায়, রগড়েও দিয়েছে।