কর্মে সাফল্য ও সুনাম বৃদ্ধি। ব্যবসায় অগ্রগতি ও প্রসার। অর্থাগম যোগ শুভ। স্বাস্থ্য বিশেষ ভালো ... বিশদ
উত্তরপ্রদেশ জুড়ে আজ একটাই প্রতিধ্বনি, চুপচাপ অখিলেশের সাইকেলে ছাপ। দলিত ও ওবিসি, যাদব-অযাদব ভোটারদের মধ্যেও দ্রুত ছড়িয়ে যাচ্ছে এই একটাই ‘মন্ত্র’। হ্যাঁ মন্ত্রই বটে। গত পাঁচ বছর জুড়ে এক রাজপুত মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর অনুগামীদের একাধিপত্য ও অনাচারের ভাঙতে মুসলিম, যাদব-অযাদব, দলিত, ব্রাহ্মণ সবাই দ্রুত সঙ্ঘবদ্ধ হচ্ছে। যোগী ক্ষমতায় আসার পর থেকে একে একে উন্নাও, হাতরাস থেকে শুরু করে লখিমপুর খেরি, বারবার রাজ্যের প্রান্তিক মানুষই আক্রান্ত হয়েছেন। জোটেনি সুবিচার। সেই থেকেই সবার মনে যে চোট পৌঁছেছে, তা ভোটের যন্ত্রে যোগী সরকারকে গদিচ্যুত করতে প্রায় টর্নেডোর আকার নিচ্ছে। সেই অভিঘাতে ভেসে যাচ্ছে ঝাঁ চকচকে জ্যাকেট আর রংবাহারি দশ লাখি পোশাকে প্রধানমন্ত্রীর হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়নের ফিরিস্তি। কোথাও রাস্তা তো কোথাও মন্দির সংস্কারের সদর্প ঘোষণা। এখনও সব প্রার্থীর নাম চূড়ান্ত হয়নি, তবু বিপদ বুঝে সব ফেলে গোরক্ষপুরের মঠে রাত কাটাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ। ছুটছেন দলিতের ঘরে খিচুড়ি খেতে। এও তো বাংলার পর্ণকুটিরে অমিত শাহের পঞ্চব্যঞ্জন ভোজনেরই ব্যর্থ পুনরাবৃত্তি ছাড়া আর কিছু নয়।
শোনা যাচ্ছে, শুধু মায়াবতীর দলিত আর ওবিসি ভোটই নয়, বিভিন্ন মঠ মন্দিরের প্রধানরা পর্যন্ত সরকারটার উপর হঠাৎ ক্ষিপ্ত। মায় ব্রাহ্মণরাও। শাসক দলের মাটি ক্রমেই আলগা হচ্ছে বুঝে প্রকাশ্যে তাঁরা সেই অসন্তোষ জানাতেও শুরু করেছেন। বিপদটা এখানেই। শক্তিশালী সবলের বিরুদ্ধে সচরাচর লোকে মুখ খোলে না। কিন্তু যেই জনগণ বুঝে যায় সর্বশক্তিমানের পায়ের তলার মাটি সরছে, অমনি বেরিয়ে আসে ভিতরের চাপা ক্ষোভ আর অসন্তোষ। আঁধি হয়ে সেই ঝড় ওলটপালট করে দেয় সবকিছু। রাজনীতির পরতে পরতে তারই উদাহরণ ছড়িয়ে। উত্তরপ্রদেশেও এক দেড় বছর আগেও যে লড়াইটাকে একপেশে সহজ মনে হচ্ছিল, সেই অঙ্কটাই ক্রমে যেন কঠিন হয়ে যাচ্ছে শাসকের ক্রমাগত দল ভাঙা আর আচমকা দলিত বিদ্বেষের জোড়া ফলায়। মাত্র তিনদিনে তিন মন্ত্রী সহ আটজন বিধায়ক দল ছেড়েছেন। এখানেই শেষ নয়। তালিকাটা দীর্ঘ এবং এই ভাঙন চলতেই থাকবে, এমনই বলছেন ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যাওয়া নেতারা। সদ্য মন্ত্রিসভা ছাড়া ধরম সিং সাইনি তো বলেই দিয়েছেন, গত দেড় বছর ধরেই সম্পর্কটা ঠিক ‘সাপে নেউলের’ হয়ে গিয়েছিল। সেই থেকে শুধু সময় খুঁজছিলেন ভোট ঘোষণার। চলতি মাস জুড়েই নাকি এমনটা চলবে।
বিজেপির বিপদ কিন্তু শুধু দলিত আর ওবিসি ভোট হারানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। সুকৌশলে অখিলেশ তুলে এনেছেন প্রায় বিস্মৃত মণ্ডল রাজনীতিকেও। যোগী-মোদির হিন্দুত্বের তাসের বিরুদ্ধে হঠাৎ সামনে আসা প্রয়াত বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়ের মণ্ডল রাজনীতির ভূতও ভয় দেখাচ্ছে গেরুয়া শক্তিকে। তার মানে ভয় এবং ভক্তি দুটোই আর বিশেষ অবশিষ্ট নেই যোগী সরকারের উপর। আরও পরিষ্কার করে বললে নরেন্দ্র মোদির ব্যক্তিত্বের উপর। আট ন’মাস আগে বাংলার মানুষ করে দেখিয়েছে। এবার ভারতীয় রাজনীতির নির্ণায়ক অন্যতম বৃহৎ প্রদেশের পালা। সাত দফার ভোট শুরুর ২৪ দিন আগে এই লেখা যখন লিখছি তখন লখনউতে নিজের সরকারের মধ্যেকার অপ্রত্যাশিত বিদ্রোহের জেরে মোদি-যোগী সহ তামাম গেরুয়া শিবির দিশাহারা। কিন্তু এই দলিত বিদ্রোহ একদিনে হয়নি। এবং এমনটা যে অচিরেই ঘটতে চলেছে সেই খবরও লখনউ থেকে দিল্লিতে বিজেপির সাততারা সদর দপ্তরের অন্দরে খুব একটা অজানা ছিল না।
ভারতবর্ষে ভোট শুধুই কাজের মাপকাঠিতে হয় না, জাতপাতের জটিল সামাজিক কলাকৈবল্যে হয়, তা চিরদিনই ঘোর বিতর্কের বিষয়। কোনও ছোট্ট পরিসরে সেই তর্কের মীমাংসা অসম্ভব। উত্তরপ্রদেশের ভোটে বিচিত্র এই জাতপাতের অঙ্কটা চিরদিনই খুব গোলমেলে। সর্বশেষ জনগণনা অনুযায়ী, ডবল ইঞ্জিন যোগীর রাজ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভোটব্যাঙ্ক হচ্ছে দলিত ও ওবিসিরা। সেখানে দলিত রয়েছে প্রায় ২১ শতাংশ। আর ওবিসিরা সংখ্যায় মোট জনসংখ্যার ৪৪ শতাংশ। মুসলিম জনসংখ্যা ২০ শতাংশ। এতদিন দলিত ভোটের সিংহভাগ থাকত মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টির নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু মোদি জমানায় দলিত ও ওবিসি ভোটের দখল অনেকটাই বিজেপির হাতে যাওয়ার দরুন ২০১৭ সালের বিধানসভা ভোটে রাজ্যের ৪০৩টি আসনের মধ্যে ৩২৫টি দখল করে তাক লাগিয়ে দেয় গেরুয়া শক্তি। কিন্তু এবার সেই অঙ্কের পরিবর্তন হচ্ছে। একদা কাঁসিরাম মায়াবতীর একচ্ছত্র অনগ্রসর শ্রেণির মানুষের আস্থা জমা হচ্ছে অখিলেশের প্রতি। সঙ্গে যে ওবিসি ও যাদব ভোট মোদি জমানায় গেরুয়ামুখী হয়েছিল তাও এবার পথ বদলে সাইকেলে সওয়ার। এই জটিল জাতপাতের রসায়ন চিরদিনই উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিকে ভারতের ভোট মানচিত্রে অনন্য স্থান দিয়েছে। এবারও আগামী ১০ মার্চ যখন পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনী ফল বেরবে, তখন সেই ভোট রসায়নের অদ্ভুত গতিপ্রকৃতির দিকেই নজর থাকবে সবার।
সেদিন সবিস্তারে লিখতে হবে মুলায়ম পুত্রের দলিত ও ওবিসি ভোট জয়ের বিশদ বিবরণ। সঙ্গে যাদব ও অযাদবদের আস্থা ফিরে পাওয়ার রসায়ন। যেমন বাংলায় কোটি কোটি টাকা খরচ করে নেতা কিনেও ভোটারের মনের তল খুঁজে পাননি অমিত শাহরা, তেমনি একই জিনিস ঘটছে লখনউ, মিরাট, গোরক্ষপুর থেকে শুরু করে মোদির যত্নের বারাণসীতেও। ঘটা করে এক্সপ্রেসওয়ে’র উদ্বোধন কিংবা নবরূপে কাশীর পবিত্র মন্দিরে প্রবেশের পথের আমূল সংস্কার সত্ত্বেও আচমকা এমনটা যে ঘটবে তা কে জানত। উচ্চবর্ণের জনসমর্থনও যে খুব একটা ভালো জায়গায় নেই সেই খবরও দিল্লির ক্ষমতার অলিন্দে পৌঁছে গিয়েছে। ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টাও চলছে জোরকদমে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে কেউ বলতে পারে না। বাকি মাত্র তিন সপ্তাহের কিছু বেশি। তারপরই উত্তরপ্রদেশের সাত দফার নির্বাচন পর্ব শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও ২০১৪, ২০১৭ এবং অবশ্যই ২০১৯ সালের মোদি ম্যাজিক কি সব মুছে ফেলে আবার ভেল্কি দেখাতে পারবে? সম্ভাবনাটা কিন্তু ফিকে হচ্ছে ক্রমশ।
কোনও অস্ত্রই, বছরের পর বছর ধার ও ভার বজায় রেখে মুশকিল আসান করতে পারে না। নরেন্দ্র মোদিরও সেই দশা হতে চলেছে। একজন প্রধানমন্ত্রী সব কাজ ভুলে সপ্তাহে পাঁচদিন গিয়ে পড়ে রয়েছেন এক অঙ্গরাজ্যের ভোট জিততে। বিজ্ঞাপনটা মোটেই সুখদায়ক নয়। তারপরও ৭২ ঘণ্টায় তিন মন্ত্রী সহ আটজন বিধায়ক শাসক দলের ছত্রছায়া ছেড়ে সাইকেলে সওয়ার। এর থেকে শিক্ষাটা কী? পশ্চিমবঙ্গে মোদি অমিত শাহের অনৈতিক কর্মকাণ্ডেরই কি জবাব মিলছে সুদূর লখনউয়ের ভুলভুলাইয়ার অন্দরে।
১৮ জুন, ১৮১৫ তারিখটা আমাদের সবার জানা। আজ থেকে দু’শো বছর আগে ওয়াটারলুর যুদ্ধে নেপোলিয়ন পরাজিত হয়েছিলেন। আগামী ১০ মার্চ উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব সহ পাঁচ রাজ্যের ভোটের ফল ঘোষণা। লখনউয়ে যোগীরাজ খতম হলে নরেন্দ্র মোদির দিল্লির তখতও যে নড়বড়ে হয়ে যাবে তা বলাই বাহুল্য। উত্তরপ্রদেশের গাঁ থেকে শহরে ঝড় তুলে দিয়েছেন মুলায়ম পুত্র। গোরক্ষপুর থেকে হিন্দুত্বের পোস্টার বয়কে দাঁড় করিয়ে আর নরেন্দ্র মোদি বারাণসীতে ঘাঁটি গেড়ে কি বাঁধের ভাঙন রুখে দিতে পারবেন? অযোধ্যার মন্দির কি বাঁচাতে পারবে গেরুয়া শাসনকে? একবার অখিলেশ সফল হলে দেশের প্রতিটি রাজ্যে মোদি বিরোধী জোটও রাতারাতি সঙ্ঘবদ্ধ হবে। মুষলপর্ব ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছবে বিজেপির অন্দরেও। যাঁদের চুপ করিয়ে গুজরাত থেকে নেতা ও অফিসার আমদানি করে এতদিন রাজ্যপাট সামলেছেন প্রধানমন্ত্রী, তাঁরাও কি ছেড়ে দেবেন? শোনা যায়, দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গেও নাকি একটা ঠান্ডা দূরত্ব তৈরি হতে শুরু করেছে তাঁর। বনিবনা বিশেষ হচ্ছে না। তাই অপেক্ষা এখন শুধু ১০ মার্চের ফলের। উত্তরপ্রদেশে যোগীরাজ পুনরায় প্রতিষ্ঠা না হলে তখনই বোঝা যাবে বুকের ছাতিটা আসলে ৫৬ না ১৭ ইঞ্চির। ২০২২ সালে নতুন ভারতের আত্মপ্রকাশ হবে, কথা দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু কোনও প্রতিশ্রুতিই তিনি রাখেননি। দ্বিগুণ হয়নি কৃষকের আয়ও। কিন্তু লখনউয়ে অখিলেশ সরকার ক্ষমতায় এলে নিশ্চিতভাবে সম্পূর্ণ হবে ক্ষমতার বৃত্তটা। গেরুয়ামুক্ত উত্তরপ্রদেশ! সেই সঙ্গে দৌড় চব্বিশের মহাযুদ্ধের। সেই নতুন জাগ্রত ভারতের জন্যই অপেক্ষা আপাতত।