কর্মে সাফল্য ও সুনাম বৃদ্ধি। ব্যবসায় অগ্রগতি ও প্রসার। অর্থাগম যোগ শুভ। স্বাস্থ্য বিশেষ ভালো ... বিশদ
ইন্টারনেট কিংবা অডিও ভিস্যুয়াল আসার আগের যুগে সাধারণত দেখা যেত, মানুষ সকালে সংবাদপত্র পড়ছেন। হয়তো কর্মস্থলে যাওয়ার তাড়নায় সকালে প্রতিটি সংবাদ খুঁটিয়ে পড়া হল না। তাঁরা রাতে বাড়ি ফিরে আবার সেই সংবাদপত্র পড়তেন অনেক বিস্তারিতভাবে। আজ সকালে ঘটে যাওয়া কোনও ঘটনার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ আগামী কাল সকালে সংবাদপত্রে পড়া হতো। আর তার আগে রেডিও কিংবা টিভির সংবাদে কিছুটা জানা হয়ে যেত। তবে বিস্তারিত এবং পূর্ণাঙ্গ বিবরণের জন্য পরদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হয়েছে। কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ হল, ওই যে সকালে সংবাদপত্র পাঠ করে সে কাজে বেরিয়ে গেল, তারপর সারাদিন কিন্তু তার আর কোনও নিউজের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংস্পর্শ রইল না। সে জানছে না যে, তার ব্যস্ততার ফাঁকে দেশে বিদেশে কত কিছু ঘটে যাচ্ছে। সেগুলি জানতে পারা যাবে পরদিন সকালে আবার সংবাদপত্রে। সে সারাদিন ধরে ভাবার সময় পেয়েছে সকালে পড়ে আসা সংবাদগুলিকে।
এই চিত্রটি সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে। এখন মোবাইল নামক যন্ত্র চলে আসা এবং ইন্টারনেট নামক একটি উচ্চপ্রযুক্তির কারণে মানুষ সবথেকে বেশি যে জিনিসটি বহন করে চলে, যাপন করে চলে এবং ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে যার সঙ্গে, সেটি হল, নিউজ। মোবাইলের স্ক্রিন খুললে নানাবিধ মাধ্যমে সবথেকে সামনে হাজির হয় নিউজ। শুধুই যে নিউজ পোর্টাল, ওয়েবসাইটের নোটিফিকেশন কিংবা সংবাদমাধ্যমের ওয়েব ভার্সান নিউজ বহন করে নিয়ে আসে মোবাইলে তা নয়। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, প্রতিটি মানুষের মধ্যেই একজন করে সাংবাদিক বাস করছে। অর্থাৎ প্রত্যেকেই সংবাদ দিতে আগ্রহী। তাই ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটস অ্যাপের মতো সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিনিয়ত দুটি বিষয়ই মানুষ জানায়। হয় কোনও না কোনও নিউজ অথবা নিজের ওপিনিয়ন।
কোনও বিখ্যাত মানুষের মৃত্যু হলে কিংবা ভারত কোনও খেলায় জয়ী হলে দেখা যায়, কমবেশি সকলেই সেই দুঃখ ও আনন্দের সংবাদ নিজের ওয়ালে জানাচ্ছেন, শেয়ার করছেন বন্ধুদের। অথচ সেই সংবাদ সকলেই কমবেশি জানতে পারবে একটু পর অথবা ইতিমধ্যেই জেনে ফেলেছে। কিন্তু তাঁর মনে হচ্ছে আমাকেও জানাতে হবে। অর্থাৎ আমার কাছে একটি নিউজ পেয়ে অন্যরা যেন বিস্মিত হয়, ক্রুদ্ধ হয়, আনন্দ পায়। মানুষের রিয়াকশন তৈরি হোক আমার মাধ্যমে। তাই পাড়ায়, শহরে, রাজ্যে, দেশে, বিদেশে কী কী ঘটেছে সেটার অবিরাম ধারাবিবরণী সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়া হয়। এর অন্যতম সুবিধাজনক দিক হল, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে অন্তহীন নিউজ পাওয়া যায় কোনও আর্থিক ব্যয় না করে। ফেসবুক গোটা বিশ্বের সবথেকে বড় মিডিয়া কোম্পানি, যাদের নিজেদের কোনও ক্রিয়েশন নেই। অর্থাৎ ফেসবুক অন্য কোম্পানির তৈরি করা নিউজ শেয়ার করার সুযোগ করে দেয় ইউজারদের। গুগলও তাই। নিজের কথা অন্যকে জানানোর এই তাড়না আন্দাজ করে ২০০৬ সালের পর থেকে ফেসবুক একের পর এক নতুন ফিচার যুক্ত করে। লাইক, ট্যাগিং ফিচার এবং শেয়ার। দ্রুত ফেসবুকের মার্কেট শেয়ার প্রভূত বৃদ্ধি পায়।
রাজনীতিক থেকে সাধারণ মানুষ, সকলেই নিউজ সংগ্রহ করেন মিডিয়া থেকেই। সেই নিউজ শেয়ার করেন এবং নিজেকে ব্যস্ত রাখেন আলাপ আলোচনা আড্ডায়। কিন্তু পাশাপাশি আবার মিডিয়াকেই সবথেকে বেশি সমালোচনা করেন তাঁরা। কেন করেন? কারণ, তাঁর মনের মতো পছন্দসই সংবাদ যেখানে পাওয়া যায়নি অথবা বিপরীত কোনও অভিমত পাওয়া গিয়েছে, তখন তাঁর কাছে সেই মিডিয়া খারাপ হয়। সেটা সোমবার হতে পারে। আবার বুধবার হয়তো সেই মিডিয়াতেই তাঁর পছন্দমতো এবং মনের অবস্থানের সঙ্গে মানানসই একটি সংবাদ পাওয়া গেল। তখন আবার সেই সংবাদটি তিনি শেয়ার করেন। সেদিন সেই মিডিয়া তাঁর কাছে হয়ে উঠছে বিশ্বাসযোগ্য। অর্থাৎ মিডিয়ার প্রতি ক্ষোভ অথবা ভালোবাসা নয়। তাঁর কাছে মাপকাঠি হল, আমার মন যা চায়, আমার রাজনৈতিক অবস্থান যা দাবি করে এবং আমি যাতে সন্তুষ্ট হই, সেরকম সংবাদ কোথায় পাওয়া যাবে! এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি প্রবণতা। কিন্তু দেখা যায়, বাংলা সংবাদপত্রগুলিতে অসংখ্য সাধারণ জীবনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সংবাদ থাকে। বাসস্ট্যান্ডে শেড নেই, বাজার জলমগ্ন, গঙ্গাভাঙন, কোনও একটি হল্ট স্টেশনের বেহাল দশা, কোনও প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ইন্ডোর পরিষেবা বন্ধ দীর্ঘদিন ধরে, সারের দাম আকাশছোঁয়া ইত্যাদি নানাবিধ সংবাদ থাকে মিডিয়ায়। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় কখনও কেউ এই নিউজগুলি নিয়ে চর্চা করে না। গুরুত্ব কম দেওয়া হয়।
দ্রুত ওপিনিয়ন দেওয়ার বিপদ কী? বিপদ হল, বিচারবুদ্ধি ব্যবহার না করে কিছু একটা বলে দেওয়ার প্রবণতা এবং তারপর সেটি ভুল প্রতিপন্ন হওয়া। যেমন সম্প্রতি দেখা গেল, স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার বিরুদ্ধে বহু মানুষ গর্জে উঠেছিলেন। প্রচুর ওপিনিয়ন দিয়েছিলেন যে, এটা একটা শিক্ষার বিরুদ্ধে চক্রান্ত। অথচ তার কিছুদিনের মধ্যে সংক্রমণ আকাশছোঁয়া হয়ে গেল। এখন কিন্তু আর সেই স্কুল খোলার পক্ষের সওয়ালগুলি দেখা যাচ্ছে না। তাই ওই ওপিনিয়ন দেওয়ার আগে থট প্রসেসের বিশ্লেষণ দরকার ছিল যে, কেন এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সরকার? যে কাজে সমালোচনা করার দরকার, সেটা তো অবশ্যই করা উচিত। কিন্তু কোনটায় করব, কোনটায় করব না, দুটিতেই আগে দরকার ভাবার! ভাবা কমে যাচ্ছে। ওপিনিয়ন বেড়ে যাচ্ছে!
অযোধ্যার যুবক সলিল ত্রিপাঠি মিরাটের জেপি ইনস্টিটিউট অফ হোটেল ম্যানেজমেন্ট থেকে পাশ করে একের পর এক হোটেলে চাকরি করেছেন ম্যানেজার হিসেবে। করোনার প্রথম ঢেউয়ে তাঁর চাকরি চলে গেল। ২০২১ সালে একটি কাফেতে চাকরি পেলেন। এপ্রিল মাসে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ। আবার চাকরি গেল। সংসার চালাতে একজন ম্যানেজার খাবার ডেলিভারি বয় হিসাবে ঢুকলেন একটি সংস্থায়। আগে বেতন পেতেন ৪৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা। এখন ডেলিভারি বয় হিসেবে বেতন পাচ্ছিলেন ১০ হাজার টাকা। দিল্লিতে স্ত্রী, সন্তান। অযোধ্যায় পরিবার। আয় বাড়াতে দিন এবং রাত, দুটি শিফটে কাজ করেছিলেন। গত শনিবার রাতে খাবার ডেলিভারি করার একটি অর্ডার মোবাইলে নিচ্ছিলেন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে। পিছন থেকে দিল্লি পুলিসের এক কনস্টেবল তাঁকে গাড়ির ধাক্কা মারে। মত্ত অবস্থায়। ঘটনাস্থলে মৃত্যু হয় ৩৮ বছরের সলিলের। অথৈ জলে শিশুসন্তানকে নিয়ে স্ত্রী সুচেতা। করোনা এবং জীবিকা। এরকম কোটি কোটি ঘটনা আছে গত দেড় বছরে।
যে পাঁচ রাজ্যে আগামী ১০ ফেব্রুয়ারি ভোট হচ্ছে তার প্রতিটি রাজ্যে গত পাঁচ বছরে জীবিকা হারানোর সংখ্যা বিপুল। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি জানাচ্ছে, উত্তরপ্রদেশে ১৬ লক্ষ মানুষ কাজ হারিয়েছে পাঁচ বছরে। পাঞ্জাবে সাড়ে তিন লক্ষ। উত্তরাখণ্ডে সাড়ে ৪ লক্ষ মানুষ কর্মহীন হয়েছে। গোয়ায় ১৪ শতাংশ কমে গিয়েছে ওয়ার্কফোর্স। ভারতের চিত্রটা কী? সবথেকে চাহিদা যে চাকরির অর্থাৎ নিয়ম করে প্রতি মাসে বেতন আসবে, এরকম জীবিকা ভারতে বিপুলভাবে কমে গিয়েছে। যাকে পরিভাষায় বলা হয় স্যালারিড জব। এই চাকরি ২০১৯ সালে ভারতে ছিল ২১ শতাংশ। ২০২১ সালে হয়েছে ১৯ শতাংশ।
কোন দুটি ঘটনা সবথেকে বেশি দেখা গিয়েছে করোনাকালে? জীবিকা চলে গিয়েছে। আর অন্যদিকে, বিপুলভাবে বেড়েছে ওষুধের দাম। ইন্ডিয়ান ড্রাগ ম্যানুফাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন সরকারের কাছে দাবি করেছে, নন সিডিউলড ওষুধের দাম বছরে ২০ শতাংশ করে বাড়ানোর অনুমতি দেওয়া হোক। কারণ তাদের ইনপুট কস্ট অনেক বেড়ে গিয়েছে। অর্থাৎ আরও বাড়তে চলেছে ওষুধের দাম। দ্বিতীয় বৃহত্তম বৃদ্ধি খাবারের দাম। এই প্রতিটি সংবাদ তো মিডিয়া মারফত পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু কতটা আন্দোলিত করছে আমাদের? কতটা চর্চার বিষয় হয়ে উঠছে এই বেঁচে থাকার লড়াইয়ের উদ্বেগগুলো? যদি আমরা চর্চা না করি, যদি আমাদের প্রতিদিনের ওপিনিয়ন প্রদান উৎসবে এই ইস্যুগুলি না উপস্থিত হয়, তাহলে কাদের লাভ? রাষ্ট্রের!