কর্মে সাফল্য ও সুনাম বৃদ্ধি। ব্যবসায় অগ্রগতি ও প্রসার। অর্থাগম যোগ শুভ। স্বাস্থ্য বিশেষ ভালো ... বিশদ
৭ জানুয়ারি জাতীয় পরিসংখ্যান অফিসের (এনএসও) তরফে ২০২১-২২ সালের জাতীয় আয়ের প্রথম অগ্রিম অনুমান প্রকাশ করা হয়। যেটাকে ইংরেজিতে বলা হয় ফার্স্ট অ্যাডভান্স এস্টিমেট (এফএই) অফ ন্যাশনাল ইকাম। এই সংক্রান্ত প্রেস রিলিজের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ৯.২ শতাংশ সংখ্যাটি। এনএসও আন্ডারলাইন করেছে যে ২০২১-২২ (৯.২ শতাংশ) স্থির মূল্যে আনুমানিক মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি বৃদ্ধির হিসেবটা নেওয়া হয়েছে ২০২০-২১ (-৭.৩ শতাংশ) সংকোচনের পরিপ্রেক্ষিতে। সরকারের মুখপাত্রদের মতে, আমরা ২০২০-২১ সালে এই পতন মুছে ফেলব এবং ২০১৯-২০ সালের তুলনায় ১.৯ শতাংশের মতো বৃদ্ধি রেকর্ড করব। এটা যদি সত্য প্রমাণিত হয় তবে আমি হব সবচেয়ে সুখী মানুষ। (বিশ্ব ব্যাঙ্কের অনুমান ৮.৩ শতাংশ।)
হায়, এমনটি অকাল উদযাপন হয়ে যাবে। ২০১৯-২০ সালের স্থির মূল্যে জিডিপির পরিমাণ ছিল ১৪৫,৬৯,২৬৮ কোটি টাকা। ২০২০-২১ সালে, মহামারীর কারণে, জিডিপির পরিমাণ কমে হয়েছিল ১৩৫,১২,৭৪০ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ সালে জিডিপির যে পরিমাণ ছিল, আমরা যখন সেটি অতিক্রম করতে পারছি শুধু তখনই বলতে পারব যে পতনচিহ্নটি মুছে ফেলা গিয়েছে এবং আমরা ২০১৯-২০-র শেষে যেখানে ছিলাম সেখানে ফিরে এসেছি। এনএসও-র হিসেব অনুসারে, সেই ফলাফল সম্ভবত ২০২১-২২ সালে মিলবে; আবার অনেক পর্যবেক্ষকের মতে, এটি সম্ভব নয়। কোভিড ১৯ এবং তার নতুন ভ্যারিয়েন্ট রক্তচক্ষু দেখানোর ফলে সংশয় আরও গভীর হয়েছে ।
সাফল্যের লক্ষ্যে দৌড়
আসুন, ফার্স্ট অ্যাডভান্স এস্টিমেটের দিকে আরও ভালো করে তাকাই। এনএসও অনুসারে, জিডিপি ১৪৫,৬৯,২৬৮ কোটি থেকে সামান্য পরিমাণ (১,৮৪,২৬৭ কোটি) বা ১.২৬ শতাংশ বাড়বে। পরিসংখ্যানের বিচারে অঙ্কটি নগণ্য। যদি কোনও একটি জিনিস ভুল হয়ে যায় তবে ‘প্রজেক্টেড এক্সেস আউটপুট’ কিন্তু হাওয়া হয়ে যাবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যদি নাগরিকদের ব্যক্তিগত খরচাপাতি সামান্য কমে যায় কিংবা কয়েকটি বাজারে রপ্তানি ব্যাহত হয় অথবা বিনিয়োগ কিছুটা বিলম্বিত হয়, তাহলে অনুমিত ‘অতিরিক্ত’ অদৃশ্য হয়ে যাবে। আমরা সর্বাধিক যেটা আশা করতে পারি তা হল, ২০২১-২২ সালে, স্থির মূল্যে জিডিপি সমান হবে এবং সেটা ১৪৫,৬৯,২৬৮ কোটি টাকার নীচে নামবে না। এই সংখ্যা বা সাফল্য অর্জনের অর্থ এটাই দাঁড়াবে যে, ভারতীয় অর্থনীতির আউটপুট লেভেল (অর্থাৎ উৎপন্ন পণ্য ও পরিষেবার পরিমাণ), দু’বছর পরে, ২০১৯-২০ সালের মতোই হবে। এজন্য মহামারী এবং অদক্ষ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে ধন্যবাদ জানাই।
ভারত আজকের বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত গতির অর্থনীতি, কিংবা তেমনটাই হবে এমন অহঙ্কার করার কোনও যোগ্যতা নেই। জিডিপি ঝপ করে পড়ে গিয়েছে, তাই উত্থানটি চমকপ্রদ মনে হয়েছে! জিডিপি যদি আরও দুম করে পড়ে যেত, উত্থানটি আরও দর্শনীয় বা চমকপ্রদ লাগত! জিডিপি সমতল রেখে ভারতের অর্থনীতি দু’বছরে রেকর্ড করবে (-)৭.৩ শতাংশ এবং (+)৯.২ শতাংশ। অন্যদিকে, চীনের তরফে +২.৩ শতাংশ এবং +৮.৫ শতাংশ হার রেকর্ড করার এস্টিমেট দেওয়া হয়েছে। তাহলে ভাবতে হচ্ছে, কোন দেশের অর্থনীতির অগ্রগতি হয়েছে এবং কোন দেশ বৃথা অহঙ্কার করে যাচ্ছে?
গড় ভারতীয়রা আরও গরিব হবে
এনএসও-র সংখ্যাও দেখাচ্ছে যে ২০১৯-২০ সালের তুলনায় গড় ভারতীয় ২০২০-২১ সালে বেশি দরিদ্র ছিল এবং ২০২১-২২-এ আরও বেশি দরিদ্র হয়ে যাবে। নাগরিকরা ২০১৯-২০ সালে যে পরিামণ টাকা খরচ করেছিলেন, এই দু’বছরে তার তুলনায় কম অর্থ খরচ করেছেন এবং আরও কম খরচ করবেন। তিন বছরে স্থির মূল্যে মাথাপিছু আয় এবং মাথাপিছু ভোগ ব্যয় এইরকম:
এছাড়াও অন্যান্য উদ্বেগজনক সূচক রয়েছে। সরকারি ব্যয় যথেষ্ট পরিমাণে বাড়ানোর আর্জি ছিল। তা সত্ত্বেও ২০২০-২১ সালে চূড়ান্ত সরকারি মূলধনী ব্যয় (জিএফসিই) পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় মাত্র ৪৫,০০৩ কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছিল। একইভাবে, ২০২১-২২ সালে এই ব্যয় আগের বছরের তুলনায় মাত্র ১,২০,৫৬২ কোটি টাকা বেশি হবে। বিনিয়োগও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। ২০১৯-২০ সালে অর্জিত স্তরের তুলনায় ২০২০-২১ সালে গ্রস ফিক্সড ক্যাপিটাল ফর্মেশন যৎসামান্য পরিমাণ (১,২১,২৬৬ কোটি টাকা) এগবে। একটি মহামারী-বিধ্বস্ত অর্থনীতির পক্ষে এই অগ্রগতি মোটেই যথেষ্ট নয়।
বাস্তব অনুধাবন
মানুষের কথাবার্তায় আলোচনায় অবশ্য জিডিপির চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে গ্যাস, ডিজেল ও পেট্রলের দাম। বেকারত্ব নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। সিএমআইই-র হিসেবে, শহুরে বেকারত্বের হার ৮.৫১ শতাংশ এবং গ্রামীণ বেকারত্বের হার ৬.৭৪ শতাংশ। তবে বাস্তবটা আরও ভয়াবহ! ‘চাকরি’-তে নিযুক্ত অনেক ব্যক্তি ‘ছদ্ম বেকার’ হয়ে পড়েছেন। উদ্বেগ রয়েছে ডাল, দুধ, রান্নার তেলের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম নিয়ে। শিশুদের শিক্ষা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। গ্রামীণ ভারতে এবং দেশের শহুরে দরিদ্র অঞ্চলগুলিতে গত দু’বছরে ছোট ছেলেমেয়েরা কোনও রকম পড়াশোনার সুযোগ পায়নি। শঙ্কা রয়েছে নিরাপত্তার প্রশ্নে। উত্তর ও মধ্য ভারতের রাজ্যগুলির বেশিরভাগ মিশ্র সম্প্রদায় দেশলাই বাক্সের মতো রয়েছে। যেকোনও মুহূর্তে জ্বলে ওঠার ভয় পাচ্ছে। আগুন একবার লাগলেই দাবানলের আকার নিতে পারে। ভাষণে ঘৃণাবর্ষণ, ডিজিটাল মাধ্যমের অপব্যবহার, ট্রোল করা এবং বিশেষভাবে নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধ নিয়ে মানুষ উদ্বিগ্ন। মহামারী এবং করোনার নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট নিয়েও মানুষ ভীষণ ভয়ে আছে।
জনগণের প্রকৃত উদ্বেগকে ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা গুরুত্ব দেন না। বিভিন্ন নির্বাচনী যুদ্ধের ভিতরেই মোক্ষ খুঁজে নিয়েছেন তাঁরা। আর এই কার্যক্রমে নেমে তাঁরা ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করছেন, অসমাপ্ত ব্রিজের উদ্বোধন করে দিচ্ছেন, উদ্বোধন করে দিচ্ছেন ফাঁকা হাসপাতালগুলিও। এই সূত্রে তাঁরা দাবি করছেন, বাকিটাও ঠিক হয়ে যাবে। এটাই হয়ে উঠছে তাঁদের প্রতিদিনের স্লোগান। এটা পরাবাস্তব। ভারত সবচেয়ে দ্রুত গতির অর্থনীতি—এই অহঙ্কারটিও একটি পরাবাস্তব।