কর্মক্ষেত্রে অশান্তি সম্ভাবনা। মাতৃস্থানীয় কারও শরীর-স্বাস্থ্যের অবনতি। প্রেমে সফলতা। বাহন ক্রয়-বিক্রয়ের যোগ। সন্তানের বিদ্যা-শিক্ষায় উন্নতি।প্রতিকার— ... বিশদ
বাবা ছিলেন রানিগঞ্জ কোলিয়ারি এলাকার ডাক্তার। বাবার মতোই ডাক্তার হতে চেয়েছিলেন নমিতা চক্রবর্তী। কিন্তু ঘটনাচক্রে হয়ে গেলেন যাত্রার বিশিষ্ট অভিনেত্রী। মানুষ তাঁকে চেনেন শর্মিষ্ঠা গঙ্গোপাধ্যায় হিসাবে। কোলিয়ারিতে বিভিন্ন যাত্রা দল যায়। তাদের আড্ডা জমে ডাক্তার গুরুপদ চক্রবর্তীর বাড়িতে। ফলে সকলকেই চিনতেন শর্মিষ্ঠাকে। কিন্তু কখনও তিনি যাত্রাশিল্পী হবেন, এটা কল্পনাতেও ছিল না। একদিন আকাশবাণীতে গানের অডিশন দিতে এসেছেন তাঁর শিক্ষকের সঙ্গে। সেখানে দেখা চলচ্চিত্র পরিচালক পিনাকী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গীত-শিক্ষকের সঙ্গে পরিচয় ছিল। তিনি শর্মিষ্ঠাকে দেখে বললেন, ‘আমার ছবিতে ওকে দিয়ে একটা রোল করাতে চাই। ছবির নাম ‘ভক্তের ভগবান’। ওর চরিত্রটা হবে কালী ঠাকুরের।’ শর্মিষ্ঠা বলেছিলেন, ‘আমি ছবিতে অভিনয় করেছি শুনে আনন্দময় বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘অভিনয়ই যদি করবি, তবে তুই যাত্রায় অভিনয় কর।’ পরিচালক গোপেন দেব গিয়ে ধরলেন বাবাকে। যাত্রায় অভিনয়ের অনুমতি চাইলেন।’ অনুমতি মিলে গেল। শর্মিষ্ঠা চলে এলেন যাত্রায়। তখন শ্রীদুর্গা অপেরা নামে একটি দল ছিল। নতুন দল। উৎসাহ নিয়ে এলেন বটে কিন্তু যাত্রার কষ্ট যে কতটা তা আগে বোঝেননি। কিন্তু সেই দল চলল না।
পরের বছর পঞ্চু সেনের ডাকে যোগ দিলেন লোকনাট্য দলে। সে বছর লোকনাট্যের যাত্রা শুরু। শিল্পী তালিকাও ঝলমলে। শ্যামল সেন, কেতকী দত্ত, সমীর লাহিড়ী। পালা ‘মুকুন্দ দাস’ এবং ‘মর্জিনা অবদাল্লা’। তখন ভালো করে মেক আপ করতেও জানতেন না। নিজের হাতে শর্মিষ্ঠাকে মেক আপ করে দিতেন কেতকী দত্ত। রিহার্সাল হল। কিন্তু যেদিন দল প্রথম শোয়ে বের হবে, সেদিনই গোঁ ধরে বসলেন শর্মিষ্ঠা। তিনি অভিনয় করবেন না। বাড়ি ফিরে যাবেন। কেন না দল যাচ্ছে লরিতে। সামনে ড্রাইভারের পাশে সাধারণত তখন বসতেন দলের প্রধান চরিত্রের অভিনেতা অভিনেত্রীরা। সেই সুবাদে সামনে জায়গা হল সমীর লাহিড়ী এবং কেতকী দত্তের। কিন্তু শর্মিষ্ঠা বললেন, তিনি এভাবে যেতে পারবেন না। মহা সঙ্কট! সমাধানে এগিয়ে এলেন সমীর লাহিড়ী। বললেন, ‘শর্মিষ্ঠাই সামনে বসুক। আমি না হয় লরির উপরে চেপে যাব।’
পরের বছর লোকনাট্যে এলেন শেখর গঙ্গোপাধ্যায়। সে বছর দলের পালা ছিল উৎপল দত্তের ‘দিল্লি চলো’। তখন শর্মিষ্ঠা মনস্থির করে ফেলেছেন, আর যাত্রা করবেন না। এত কষ্ট করে থাকা তাঁর সহ্য হচ্ছিল না। সেসময় শেখরবাবুই তাঁকে দল না ছাড়ার অনুরোধ করলেন।
সেই প্রথম শেখর গঙ্গোপাধ্যায়কে দেখা। তার আগে বাবার কাছে শুনেছিলেন শেখরের নাম। ‘বাবা আমাকে বললেন, ‘একটা ছেলে আমাদের এখানে এসে ‘রামকৃষ্ণ’ চরিত্রে অভিনয় করে গেল। কী অভিনয় করল! আমি এত ভালো রামকৃষ্ণের অভিনয় আগে দেখিনি।’ শেখরবাবু, নিরঞ্জন ঘোষের অনুরোধে আর যাত্রার সঙ্গত্যাগ হল না। তাছাড়া সেবছর থেকে বাসও এল। ওই বছরে লোকনাট্যের আলোড়নকারী পালা ছিল ‘দিল্লি চলো’। এলেন উৎপল দত্ত। নতুন ছন্দে বাঁধলেন যাত্রাকে। প্রতিটি চরিত্রের মধ্য দিয়ে তৈরি করলেন এক নতুন অভিনয় ধারা। সে কী দুরন্ত টিম! ছিলেন বিজন মুখোপাধ্যায়ও। আর একটি পালাও সে বছর ছিল। ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পাঁচ পয়সার পৃথিবী’।
‘দিল্লি চলো’ পালায় সোখা চরিত্রটি করে খুব সুনাম হল শর্মিষ্ঠার। নাগা বিপ্লবী চরিত্র। সেই পালায় অসাধারণ একট গান ছিল তাঁর কণ্ঠে। জ্বলন্ত প্রদীপ হাতে করে কুড়ি-বাইশ জন মঞ্চে ঢুকে গান গাইতেন। শর্মিষ্ঠা লিড করতেন। স্টেজের সমস্ত আলো নিভিয়ে দেওয়া হতো। শুধু ওই হাতের প্রদীপের আলোয় অভিনয় হতো। অপূর্ব একটা সিকোয়েন্স তৈরি হতো। কয়েকটি ভাষায় সে গান গাইতে হতো। ‘বাসি ফুলের মালাগুলো জলে ফেলে দে/.. সামা জিলিয়াং জিলিয়াং সামা’। খুব হাততালি পেত সিনটা। ওই পালায় একটা দৃশ্য ছিল। শর্মিষ্ঠা দৌড়ে এসে ইংরেজদের আসার খবরটা দিচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই হাঁফাতে হাঁফাতে সংলাপটা বলতে পারছেন না। রিহার্সালে সেটা দেখে উৎপল দত্ত তাঁকে বললেন, ‘তুই এই বাড়ির একতলায় চলে যা। তারপর সিঁড়ি দিয়ে ছুটতে ছুটতে আয়। এসে এখানে ডায়ালগটা বল। দেখ কীভাবে সত্যি করে হাঁফাতে হাঁফাতে কথাটা থ্রো করছিস।’ এভাবেই শিখেছেন।
লোকনাট্যেই শেখরবাবুর সঙ্গে প্রেম ও বিবাহ। বিয়ে নিয়ে শর্মিষ্ঠা বললেন, ‘আমার থেকে শেখরবাবু অন্তত কুড়ি বছরের বড় ছিলেন। কিন্তু প্রেম হয়ে গেল। তিনি ছিলেন আমার শিক্ষকের মতো। অনেক কিছু তাঁর কাছ থেকেই .শিখেছি। আমার প্রেমের মধ্যেই তাই শ্রদ্ধার স্থান ছিল অনেকখানিই। কিন্তু যাত্রাওয়ালার সঙ্গে কিনা বিয়ে! আমার বাড়ির অনেকেই এটা পছন্দ করল না। সেই সময় অনেক আত্মীয় আমাদের বয়কট করেছিল। কিন্তু আমার বাবা সেদিন পাশে দাঁড়িয়েছিল বলেই সেই প্রেম বিয়ে পর্যন্ত পৌঁছেছিল।’
তখনও তিনি নমিতা চক্রবর্তী। তখনকার বহু লিফলেট হ্যান্ডবিলে এই নাম পাওয়া যাচ্ছে। তারপর তরুণ অপেরায় এসে হয়ে গেলেন শর্মিষ্ঠা। একদিন অমর ঘোষ শান্তিগোপালকে বললেন, ‘ওর নমিতা নামটা সেকেলে। অন্য নাম দেওয়া দরকার।’ তারপর শান্তিগোপাল এবং অমর ঘোষ মিলে নামকরণ করলেন শর্মিষ্ঠা। তারপর থেকেই তিনি শর্মিষ্ঠা গঙ্গোপাধ্যায়। তরুণ অপেরায় অভিনয় করলেন, ‘হিটলার’, ‘লেনিন’, ‘আমি সুভাষ’ ইত্যাদি পালায়।
উৎপল দত্ত না থাকলে অবশ্য শর্মিষ্ঠা এই খ্যাতি পেতেন না। তিনি তাঁকে হাতে ধরে অভিনয় শিখিয়েছেন। পাশে পেয়েছিলেন শেখরকেও।
উৎপল দত্তের বিভিন্ন অমর পালায় তিনি অভিনয় করেছেন, ‘দিল্লি চলো’র পাশাপাশি ‘সমুদ্র শাসন’, ‘ফেরারী ফৌজ’ প্রভৃতি পালায়। শিল্পীতীর্থ দলে তিনি অভিনয় করলেন ‘দ্বীপান্তর’ পালায়। সেখানে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করতেন জ্যোৎস্না দত্ত। আর ছিলেন অসীমকুমার, গুরুদাস ধাড়া, সীমা বসু প্রমুখ। সেবছর ‘সন্তোষী মা’ খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। সেই পালায় শর্মিষ্ঠা করতেন মেজবউয়ের চরিত্র। চরিত্রটা খলনায়িকার। সেই অভিনয় দেখে বহু দর্শক রুষ্ট হয়ে কটূমন্তব্য করতেন। ‘কোথাও কোথাও দর্শকরা মাঝে মাঝে মঞ্চে উঠে আমাকে মারতে আসত। আমি তখন সন্তান সম্ভবা। আমাকে আড়াল করে বাঁচাতেন জ্যোৎস্নাদিই। সেই খলনায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেই পেয়েছিলাম দিশারী পুরস্কার।’ ‘দ্বীপান্তর’ পালায় একটা দৃশ্যে ছিল স্বামীর মৃত্যুর দৃশ্য। সেখানে একটা কান্নার সিন ছিল। দীর্ঘ সেই দৃশ্যের অভিনয় প্রসঙ্গে শর্মিষ্ঠা পুরনো স্মৃতি ফিরিয়ে এনে বললেন, ‘সেই অভিনয়ে এতটাই মানসিক যোগ তৈরি হয়ে যেত যে ওই দৃশ্যের শেষে গ্রিন রুমে ফিরে অনেকদিনই আমি অজ্ঞান হয়ে যেতাম।’
বহু সার্থক পালায় অভিনয় করেছেন তিনি। সত্যম্বর অপেরায় ‘দিন বদলের ডাক’, ‘কান্না ঘাম রক্ত’, অগ্রগামীতে করলেন ‘বাবা তারকনাথ’, ‘কালো তলোয়ার’, বঙ্গলোক অপেরায় করলেন ‘ভিখারি সম্রাট’, আর্য অপেরায় করলেন ‘দামামা ওই বাজে’ ইত্যাদি। অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। দিশারীর পাশাপাশি নটরাজ পুরস্কার, আইকা পুরস্কার ইত্যাদি।
শেখর গঙ্গোপাধ্যায় সম্পর্কে শর্মিষ্ঠা বললেন, ‘শেষের দিকে শেখরবাবু অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। একটা জায়গায় শো করতে গিয়ে উনি পায়ে তার জড়িয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। তারপর থেকেই ওঁর মধ্য একটা পরিবর্তন দেখতে থাকি। যাত্রার ডায়ালগ ভুলে যেতে লাগলেন। মনটাও উদাসী হয়ে গেল তাঁর। মাঝে মাঝে বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতেন। সেই সঙ্গে বাড়ছিল মদ্যপানের অভ্যাস। বহুবার বহু জায়গা থেকে গিয়ে ধরে নিয়ে এসেছি। সেই সময় চিকিৎসার জন্য অনেক সাহায্য পেয়েছি সুভাষ চক্রবর্তীর সঙ্গে।’ জীবনের জুটি একদিন ভেঙে গেল। ২০০৯ সালের ২১ এপ্রিল বিদায় নিলেন শেখর। সবকিছুর মধ্যেও আজ এক শূন্যতা ঘিরে আছে শর্মিষ্ঠাকে। শেখরবিহীন জীবনে জুড়ে আছে নানা স্মৃতি। দুই মেয়েকে শোনান সেই সব কাহিনী। এখনও মনে আছে বিভিন্ন পালার গান। মাঝে মাঝে ডুবে যান সেই সব গানে।