প্রায় সম্পূর্ণ কাজে আকস্মিক বিঘ্ন আসতে পারে। কর্মে অধিক পরিশ্রমে স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা। ... বিশদ
মানুষ আর প্রকৃতি একে অপরের সঙ্গে জড়িত। প্রতি পদে আমরা প্রকৃতি থেকে বেঁচে থাকার রসদ জোগাড় করি। একইভাবে আবার প্রকৃতির মাঝে নিজের জায়গা করে নিয়েছে বন্যপ্রাণ। তাই মানুষ, প্রকৃতি আর জীবজন্তু সকলেই একে অপরের সঙ্গে কোনও না কোনওভাবে যুক্ত। এই সংযোগ নিয়েই কলকাতার ফার্ন পল্লির পুজোর থিম তৈরি করেছেন পুজোর অন্যতম কর্মকর্তা সৌমিত্র গুপ্ত ও কিংশুক গুপ্ত। আর সেই কাজটি করানো হয়েছে ঝাড়খণ্ডের সোরাই উপজাতির কয়েকজন মহিলাকে দিয়ে। অলকা আলমের নেতৃত্বে পাঁচজন সোরাই মহিলারা এসেছিলেন ফার্ন পল্লি পুজোর সাজ তৈরি করতে। মনোদেবী, ঊর্মিলাদেবী, দেবন্তীদেবী, সুশীলাদেবী ও পুতলি গঞ্জুর হাতের কাজে সমৃদ্ধ কালকাতার এই পুজোমণ্ডপটি।
কেমন সেই কাজের ধরন? কথা হচ্ছিল অলকার সঙ্গে। বললেন, ‘ঝাড়খণ্ডি উপজাতি সোরাইদের জঙ্গলনির্ভর জীবন। সেখানকার পশু, পাখি, গাছপালা, ফুল, পাতা উঠে এসেছে তাদের শিল্পে। শিল্পের সেই ধারা আজও বর্তমান। সেই ঘরানাই আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও বহন করে চলেছে। এবার সেই শিল্পই দেখতে পাবেন কলকাতার একটি পুজোমণ্ডপে।’
পুজোর সঙ্গে প্রকৃতির মিলন ঘটানোর কথাও জানালেন অলকা। তিনি বললেন, মানুষ তো আর একা বাস করতে পারে না। বিভিন্ন অবলম্বন লাগে তাদের বেঁচে থাকার জন্য। সেই অবলম্বনগুলোই আমরা পাই প্রকৃতির বা জীবজন্তুর মধ্যে। মা দুর্গা যে মর্তে আসেন, আমাদের জীবন আলো করে বিরাজ করেন পুজোর ক’দিন, তিনিও তো আর একা আসেন না। বরং বাঘের পিঠে চড়ে এই পৃথিবীর মাটিতে পা রাখেন। বাংলায় অবশ্য মা সিংহবাহিনী। কিন্তু ভারতের অন্যত্র তিনি ব্যাঘ্রবাহিনী। সে যাই হোক, তিনি আসছেন কোনও একটি পশুর সঙ্গে। তিনি একাই নন, তাঁর সঙ্গে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ সকলেই পেঁচা, রাজহাঁস, ময়ূর বা ইঁদুরের সঙ্গে আসেন। ফলে দেখতেই পাচ্ছেন দেবীর সঙ্গে জীবজন্তু কেমন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাছাড়া মা আসেন হিমালয় থেকে। পুরাণে স্বর্গের নদী, সেখানকার ফুল সব কিছুই বর্ণিত রয়েছে। আমাদের নদীমাতৃক দেশে গঙ্গাকে আমরা মাতৃরূপে আরাধনা করি। সেই গঙ্গাকেই শিব ঠাকুর নিজের জটায় ধারণ করেন। ফলে এই যে দেবতার সঙ্গে প্রকৃতি, বন্যপ্রাণ ও মানুষের সংযোগ তা নতুন কিছু নয়। যুগ ও জীবনের নিয়মেই তা চলে আসছে। সেই মিলনকেই তুলে ধরা হয়েছে সোরাই শিল্পের মাধ্যমে।
মহিলাদের দিয়ে কাজ করানোর কারণ কী? এক্ষেত্রে সুশীলা জানালেন, মহিলাই শুধু এই শিল্পকে তুলে ধরে রেখেছেন এমন নয়। সোরাই উপজাতির নারী-পুরুষ সকলেই এই কাজ করে। আগে বাড়ির মেয়েরা শিল্পের সঙ্গে সেভাবে যুক্ত ছিলেন না। ক্রমশ যুগের সঙ্গে তাদেরও এই শিল্প শেখানো হয়েছে। ‘আমরা বাড়ির দেওয়ালে ছবি আঁকতাম। আমাদের পূর্বপুরুষরা সেই শিল্পই শিখিয়েছিলেন আমাদের। কিন্তু দেখলাম সেই শিল্প স্থায়ী হয় না। যে কোনও দুর্যোগে তা ধুয়েমুছে যায়। তাছাড়া দেওয়ালচিত্রকে সংরক্ষণও করা যায় না। অন্তত আমাদের সেই প্রযুক্তি জানা নেই। তখনই তা কাগজে আঁকার কথা ভাবি। তবে যে কোনও কাগজ নয়। হাতে তৈরি মোটা কাগজে আমাদের শিল্পকে ফুটিয়ে তোলা শুরু করেছি মাত্র বছর দশেক আগে থেকে। এখনও মূলত তা দেওয়ালচিত্র হিসেবেই রয়েছে,’ বললেন সুশীলা।
তাঁর কথার সূত্র ধরেই অলকা বললেন, ‘এই আঁকায় আমরা যে রং ব্যবহার করি তা পুরোপুরি প্রাকৃতিক। কালো, লাল, গেরুয়া আর হলুদ— মাটির এই চারটি রং দিয়ে আমরা আমাদের আঁকার জন্য রং তৈরি করি। তার সঙ্গে কখনও খড়িমাটি, কখনও চুন কখনও কোনও ফুলের নির্যাস মেশাই। সবটা মিলিয়ে একটা পেস্ট তৈরি হয়। সেই মিশ্রণের সঙ্গে জল মিশিয়ে তৈরি করি আঁকার রং। তাতে যে সবসময় তুলির ব্যবহার হয় তাও নয়। অনেক শিল্পীই এখনও রঙে আঙুল ডুবিয়ে নিজের ভাবনাকে ফুটিয়ে তোলেন দেওয়ালে। এইভাবেই আমরা এগিয়ে নিয়ে চলেছি আমাদের শিল্পকে।’
পুজো একেবারেই দোরগোড়ায়। পিতৃপক্ষের অবসান ঘটিয়ে দেবীপক্ষের সূচনাও হয়ে গিয়েছে দিন কয়েক আগেই। দেবীপক্ষে মাকে নিবেদন করার জন্য সোরাই উপজাতি তাদের শিল্পের মাধ্যমে তিনটি শাড়ি বানিয়েছেন। তাঁতের কাপড়ের উপর নিজেদের আঁকা ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁরা প্রাকৃতিক রং ব্যবহার করেই। অলকা বললেন, ‘পুজো এবার তিন দিনেই সমাপ্ত। সেই তিন দিন মা দুর্গাকে যে কাপড় পরানো হবে ফার্ন পল্লির মণ্ডপে সেই কাপড়গুলোও আমরাই তৈরি করছি। আমাদের ব্যবহার্য প্রাকৃতিক রং আর একটু উজ্জ্বল করে তা দিয়ে ছবি আঁকা হয়েছে। সেই শাড়ি পরে মা দুর্গা মণ্ডপ আলো করে থাকবেন। অগুনতি দর্শনার্থী তা দেখবেন এটা ভেবেই আমাদের মনে এক ভিন্ন ধরনের রোমাঞ্চ হচ্ছে।’ কেমন ছবি এঁকেছেন তাঁরা শাড়ির উপর? ‘ওইটুকু না হয় রহস্য থাক,’ বললেন অলকা। তাঁর কথায়, মায়ের আরাধনায় প্রেম, পূজা আর প্রকৃতি মিলেমিশে একাকার। সেই তিন ধারাকেই তুলে ধরা হয়েছে তাঁদের শিল্পে।