প্রায় সম্পূর্ণ কাজে আকস্মিক বিঘ্ন আসতে পারে। কর্মে অধিক পরিশ্রমে স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা। ... বিশদ
ছোট্ট মেয়ে। সে পরিবারের একমাত্র সন্তান। সকলের খুব আদরের। মেয়েটির সঙ্গে বাবা, মা একটা খেলা খেলতেন। ‘চোখ বন্ধ করে হাত পাতো। তুমি যা চাইবে তোমাকে তাই দেব।’ সে কখনও একটা বিস্কুট চাইত। কখনও বা খেলনা। ছোটখাট জিনিস। চোখ খুলে চাহিদা মতো জিনিসটা হাতে পেয়ে খুব খুশি হতো। সময়ের সঙ্গে সে মেয়ের চাহিদা পরিবর্তন হতে শুরু করল। কাজু দাও, ক্যাডবেরি দাও। সবসময় সেসব বাড়িতে থাকে না। ফলে বাবা, মা দিতে পারতেন না। মেয়েটি আর একটু বড় হল। তখন চাহিদা আরও বাড়ল। চাহিদা পূরণ না হলে রেগে গিয়ে বাড়ির সব কাচের জিনিস ভেঙে ফেলত। উপায় না দেখে মনোসমীক্ষকের দ্বারস্থ হন বাবা, মা। তিনি মেয়েটিকে প্রশ্ন করেন, তুমি চাইলেই যে বাবা, মা সব সময় এনে দিতে পারবেন, এমন নাও হতে পারে। মেয়েটি বলেছিল, যখন বলা হয়েছে যা চাইব তাই দেবে, তাহলে সেটা দিতে হবে। আমার ইচ্ছে পূরণ করতে না পারলে আমি পৃথিবীকে ভেঙে টুকরো করে দেব। মনোবিদ মেয়েটিকে প্রশ্ন করেন, ধরা যাক তোমার সেই ক্ষমতা হল। সব মানুষকে মেরে, সব জিনিস ভেঙে ফেলতে পারলে। তখন তো একটা ধ্বংসস্তূপের ওপর তুমি একা দাঁড়িয়ে থাকবে। মেয়েটি বলেছিল, ‘আমার প্রচণ্ড আনন্দ হবে। মনে হবে সমস্ত পৃথিবী আমার পায়ের নীচে। আমি একা ক্ষমতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।’
গল্প নয়। এটা সত্যি ঘটনা। জানালেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্ব বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপিকা তথা মনোসমীক্ষক নীলাঞ্জনা সান্যাল। মেয়েটিকে তিনি ধীরে ধীরে সুস্থ করতে পেরেছিলেন। ‘মেয়েটির এই চাহিদা কিন্তু বাবা, মা তৈরি করেছেন। তার নিরন্তর বায়নাকে প্রশ্রয় তাঁরাই দিয়েছিলেন। বাচ্চার বায়না সামলানোর আগে জানতে হবে তার মূল কোথায়’, স্পষ্ট বললেন নীলাঞ্জনা।
শিশুর বায়নার কোনও নির্ধারিত সময় নেই। বায়নার রকমফেরও বিস্মিত করে। সামনে দুর্গাপুজো। হয়তো সে পুজোর ভিড়ে সারাক্ষণ কোলে থাকার বায়না করল। কিন্তু তার হাঁটাচলায় সমস্যা নেই। শুধু ভিড় এড়াতে চায় বলেই এই বায়না। বাবা, মায়ের কষ্ট বুঝতে অপারগ সে। অথবা বড়দের সঙ্গে প্যান্ডেলে সারা রাত জেগে থাকার বায়না করছে শিশু। কোনও একটা খাবার যা খেলে আদতে তার ক্ষতি, সেটা পুজোর দিনে তাকে কিনে দিতেই হবে, এমন বায়নাও ঘরে ঘরে। এসব সামলানোর আগে মূল সমস্যা খুঁজে দেখা প্রয়োজন। নীলাঞ্জনা ব্যাখ্যা করলেন, আজকের পৃথিবীতে উপাদান সামগ্রী অনেক বেশি। বাইরের জীবনের আকর্ষণ অতীতে এত তীব্র ছিল না। একান্নবর্তী পরিবার ছিল। বাড়িতে বাচ্চারা একা থাকত না। কেউ না কেউ বাড়িতে থাকতেন। বাচ্চাদের মূল চাহিদা অন্যর মনোযোগ পাওয়া। সেটা আগে সহজ ছিল। কারণ চারপাশে মানুষের উপস্থিতি। তা থেকে বাচ্চাদের চাহিদা পূরণ হতো। টিভি ছিল না। সকলের বাড়িতে টেলিফোনও থাকত না। সামাজিক মাধ্যমের ধারণা ছিল না। ঘরোয়া মানুষগুলোই সাহচর্যের মূলে থাকতেন। বাচ্চাদের বাইরের জগৎ সম্পর্কে আগ্রহ ছিল না।
সমাজ পাল্টেছে। প্রযুক্তির প্রগতি হয়েছে। যতটা সম্পদ আমরা আহরণ করেছি, বড়রাই তাতে অনেক বেশি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছি। আমাদের নিজেদের জীবনটা আমরা যেভাবে চালনা করছি, তার প্রভাবও বাচ্চার উপর পড়ে। নীলাঞ্জনা বললেন, ‘আমরা বেশিরভাগ মানুষই বাইরে থাকতে ভালোবাসি। বাইরের খাবার খেতে পছন্দ করি। সিনেমা দেখা, বেড়াতে যাওয়া এসব আমাদের ভালো লাগে। অনেক বেশি সম্ভারসম্পন্ন জীবন আমাদের তৈরি হয়েছে। আমরা বড়রা যেগুলো করছি, ছোটরা সেটা দেখে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। ফলে তাদের চাহিদার তালিকাতেও একের পর এক উপাদান বাড়ছে।’
অভিভাবকদের সংশোধন প্রয়োজন। বাচ্চার চাহিদা মতো দিতে শুরু করলে তার কোনও শেষ নেই, পরামর্শ নীলাঞ্জনার। তাঁর কথায়, ‘আমি দেখেছি, ছোটদের মোবাইলের নেশা হয়েছে। তা থেকে মনোযোগ, একাগ্রতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাহলে তো মোবাইল তার হাতে আসা উচিত নয়। বাবা-মা বাচ্চার হাতে মোবাইল দিতে না চাইলে বাচ্চারা একটু বড় হতেই শাসায়। ভয় দেখায়। আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে। কয়েক মাসের বাচ্চা যাতে না কাঁদে, মোবাইল চালিয়ে তার চোখের সামনে ধরা হয়েছে। এ থেকেই আসক্তি তৈরি হয়েছে। বড়রাই ক্ষতিটা করছি।’
নীলাঞ্জনার কথায়, ‘বাবা, মায়ের কাছ জানতে চাই আপনি বাচ্চার সামনে কতক্ষণ মোবাইল দেখেন? ওঁরা বলেন, এটা ছাড়া আমাদের বিনোদন তো সম্ভব নয়। কাজের শেষে আমি মোবাইল দেখবই। তাহলে আমি নিজে যেটা বন্ধ করতে পারব না, সেটা বাচ্চাকে কীভাবে বন্ধ করাব?’ শুধু মোবাইল নয়। যে কোনও ক্ষতিকর জিনিস যাতে ওরা না চায়, সে জেদ কন্ট্রোল করে রাখার জন্য তার বেয়াড়া অভ্যাসে মদত দিচ্ছি। কীভাবে? তিনি বললেন, ‘পড়াশোনা করলে মোবাইল দেব, এই আশ্বাস আসলে ঘুষ। সেই অভ্যেস বড়রা তৈরি করছেন।’
বাচ্চার কোনও চাহিদা নিজে থেকেও তৈরি হতে পারে। হয়তো বাবা, মা তাকে সেটা দিয়ে অভ্যেস করাননি। কিন্তু সে বিজ্ঞাপন দেখে। বন্ধুদের দেখে। বায়না করে চিপস, কোল্ড ড্রিঙ্ক খাব। রাস্তায় এমন ‘সিন ক্রিয়েট’ করে যাতে বাবা, মা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। তাদের মনে রাখতে হবে বাচ্চাকে কিছুটা হতাশ করে দেওয়া দরকার।’ নীলাঞ্জনার সতর্কবার্তা, ‘তবে না দিয়ে বাচ্চাকে হতাশ করারও সীমা আছে। অর্থাৎ যদি দেখা যায় বাচ্চা যে জিনিসটা চাইছে, সেটা হয়তো সামান্য কিছু, কিন্তু না দেওয়ার জন্য লম্বা সময় ধরে জেদ করছে। কাঁদতে কাঁদতে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, সেই পর্যায়ে যেন না যায় সেটাও দেখতে হবে। ফ্রয়েডের তত্ত্ব অনুযায়ী, আমাদের মনের সচেতন দ্যোতক অর্থাৎ ইগো যেন চিড় না খায়। যদি মনে হয় বাচ্চার বায়না সামলানো যাচ্ছে না, তখন ওটা দিতে হবে। প্রথম তাকে শান্ত করতে হবে। পরে যখন শান্ত হবে তখন তাকে বাবা, মায়ের অসহায়তার দিকটা বোঝাতে হবে।’