প্রায় সম্পূর্ণ কাজে আকস্মিক বিঘ্ন আসতে পারে। কর্মে অধিক পরিশ্রমে স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা। ... বিশদ
স্বর্ণদীপ মাইতি, ছাত্র
ঘুম জড়ানো হাতে রেডিওর নব ঘোরাতেই শোনা যায়, মহালয়া। নিমেষের মধ্যে ঘুম উধাও! দাঁত মেজে বসতে না বসতে শুরু হয়ে যায় মহালয়ার সেই বহু প্রতীক্ষিত আশ্বিনের শারদ প্রাতে জেগে উঠেছে আলোক মঞ্জীর...। বাঙালির সারা বছরের সবচেয়ে আনন্দমুখর কয়েকটা দিনের আভাস; গায়ে কাঁটা দেয়, মা আসতে আর দেরি নেই। পুরো একবছরের অপেক্ষার অবসান যে মহালয়ার এই সুর দিয়েই; মহালয়া! অন্য কোনও প্রযুক্তিগত গ্যাজেট বা অ্যাপে নয়। ভোরের আলো ফোটার আগে মহালায় শুনতে রেডিয়োর জুড়ি মেলা ভার। এ এক অন্য আবেগ, অনন্য অনুভূতি। এখনও শুধু প্রৌঢ়রা নয়, এই প্রজন্মের একাংশের কাছে মহালয়া শোনার ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের তুলনায় রেডিও প্রথম পছন্দ। আমার দাদুর কথায়, ‘ভোরবেলা রেডিওতে মহালয়া শোনার মধ্যে অদ্ভুত এক আনন্দ আছে যেটা ইউটিউবে পাওয়া যায় না। এতে জড়িয়ে রয়েছে আলাদা এক নস্টালজিয়া।’ তাই মহালয়ার আসল আবেগ, আনন্দ রেডিওতে।
পুবালি পালিত, ছাত্রী
আমাদের বাবা, কাকাদের সময় ওঁরা মহালয়া শুনতেন রেডিওতে। ঠিক ভোর চারটেয় রেডিওতে চলত বীরেন্দ্রকৃষ্ণর আগমনি বার্তা। সেই আগমনি বার্তা রেডিওতে না শুনলে ওঁদের মনেই হতো না পুজো এসেছে। আমাদের সময় ভোরের ঘুম ভেঙে মহালয়া শোনার চল কিছুটা কমলেও পুরোপুরি অবলুপ্ত নয়। এখনও অনেকে অপেক্ষা করে থাকে মহালয়া শুনবে বলে। কিন্তু মোবাইল-এ রেডিও অ্যাপটা আছে ঠিকই তবে পুরনো রেডিওতে শোনা আগমনি বার্তায় ছিল লুকিয়ে থাকা আলাদা একটা আবেগ।
সহেলি পালিত, ছাত্রী (স্নাতকোত্তর)
মহালয়া শব্দের অর্থ ‘মহান যে আলয় বা আশ্রয়’। এই দিনেই অমাবস্যার অন্ধকার দূর হয়ে আলোকময় দেবীপক্ষের সূচনা হয়। দেবী দুর্গাই হলেন সেই মহালয়। মহালয়া মানেই রাতের অন্ধকার কাটিয়ে ভোরের আলোতে রেডিওর আকাশবাণীতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’ শোনা। এই মূহূর্তটি কোনও সাধারণ রেডিও অনুষ্ঠান নয় বরং বাঙালির আত্মার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এক অমলিন আবেগের প্রতীক। রেডিওতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মায়াবীকণ্ঠে ‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে’ বা ‘ইয়া দেবী সর্বভূতেষু’ দেবীর আগমনবার্তা বেজে উঠে। তাই এখন আধুনিকতার ছোঁয়ায় যতই স্মার্টফোন কিংবা টেলিভিশনে মহালয়া দেখার প্রচলন হোক না কেন, কিন্তু রেডিওর সেই শ্রুতিমধুর দিনগুলো আজও হারিয়ে যায়নি। আজও অনেক বাঙালি রেডিওতে মহালয়া শোনে সেই অনন্ত আবেগের ছোঁয়া নিতে। যতই আধুনিকতার ছোঁয়া আসুক না কেন, রেডিওতে মহালয়া শোনা বাঙালির কাছে আদি এবং অকৃত্রিম আবেগ।
অভিষিক্তা পাল, ছাত্রী
সবাই মিলে রেডিওর সামনে জড়ো হয়ে মহালয়া শোনা। উৎসব তো সম্প্রীতি শেখায়। কিন্তু বর্তমান মুঠোফোনের যুগে এসে মহালয়ার জন্য সে অপেক্ষা কোথায়? নবপ্রজন্ম রাত থাকতে আর ওঠে না। তারা জানে গুগল যে কোনও সময় শুনিয়ে দেবে মহালয়া। এখন আবার টেলিভিশনেও মহালয়া দেখেন আট থেকে আশি। সেখানে চ্যানেলগুলির মধ্যে চলে প্রতিযোগিতা। কোন অভিনেত্রী দুর্গা হবেন, কার কনটেন্ট কত ভালো! শিবের তাণ্ডবনৃত্য আর মহিষাসুরের যুদ্ধের ডঙ্কারে কোথাও যেন হারিয়ে যায় মহালয়ার আসল সুর। গায়ে কাঁটা দেওয়া, চোখে জল এনে দেওয়া দরাজ কণ্ঠের স্বর খুঁজে পাই না। আবেগ সেই রেডিওটাতেই। মা দুর্গাও বুঝি থাকেন অপেক্ষায়! কখন সেই মানুষটা বলে উঠবেন, ‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জীর...’।
বিপক্ষে
সঞ্জীব দাস, ছাত্র
মহালয়া বাংলা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মহালয়ার আবেগ রেডিওতে সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করা কিংবা অনুভব করা কঠিন। কারণ রেডিও শুধুমাত্র শ্রবণযোগ্য। কিন্তু কোনও মুহূর্তকে পূর্ণাঙ্গভাবে উপলব্ধি করার জন্য শোনার সঙ্গে চোখের সামনে ভিস্যুয়াল উপাদানেরও দরকার হয়, যা রেডিওতে নেই। এছাড়াও বর্তমান সময়ে বেশিরভাগ মানুষ রেডিওর থেকে এখনকার ডিজিটাল মাধ্যমে বেশি সংযুক্ত রয়েছেন। যেখানে তারা নিজেদের পছন্দমতো মহালয়ার অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারেন এবং মহালয়ার আবেগের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারেন। এছাড়াও এখন টেলিভিশন, মোবাইল ও নানা ধরনের ভিস্যুয়াল উপাদান থাকার কারণে রেডিওতে মহালয়া শোনা ক্রমশ সময়ের সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে। তাই রেডিওর মাধ্যমে মহালয়ার আবেগ অনেকাংশেই সীমিত হয়ে যাচ্ছে। অতএব বলা যায়, মহালয়ার আবেগ আর সম্পূর্ণভাবে লুকিয়ে নেই রেডিওতে।
অরিজিৎ দাস অধিকারী, শিক্ষক
নতুনকে বরণ করতে দ্বিধাগ্রস্তরাই মনে করেন মহালয়ার আবেগ শুধু রেডিওতে। অতীতে রেডিওর বিকল্প বিনোদন মাধ্যম ছিল না। তাই এখন হাতের মুঠোয় বিশ্ব, সোশ্যাল মিডিয়ার ব্লগে ব্লগেই শ্রেষ্ঠ উৎসবের হালহকিকত। কাকভোরে যখন রেডিওতে ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’ সম্প্রচার শুরু হয় তখন এই প্রজন্মের মধ্যরাত। শহরে রেডিও কবেই মিউজিয়ামে। গ্রামে হাতেগোনা। বরিষ্ঠ নাগরিকরাও শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েন। ফলে মহালয়ার আবেগ কেবল রেডিওতে নয়, সামাজিক গণমাধ্যম সহ পরিবেশের পরতে পরতে। উঠোনের শিউলি, দিঘির কাশ, পেঁজা মেঘের পানসি চলন, ঘাসের আগায় শিশির বিন্দুও কম যায় না। শপিং মল থেকে সাইবার কাফেতেও দেবীপক্ষের অজস্র উন্মাদনা। শুধু আকাশবাণীতে নয় আকাশে বাতাসের সোশ্যাল সাইটেই আজ মহালয়া বরণের প্রবণতা।