প্রায় সম্পূর্ণ কাজে আকস্মিক বিঘ্ন আসতে পারে। কর্মে অধিক পরিশ্রমে স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা। ... বিশদ
আরে আরে, ওই অতখানি মাটি সিংহের গায়ে চাপালে হবে নাকি! এই দেখ, এইভাবে কর!
মেঘলা সকালে বাড়ির দাওয়ায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে খানিক আনমনা হয়েই কথাটা বলে উঠলেন আমাদের আজকের গল্পের ‘নায়িকা’। মানুষ তার শৈশব ভোলে না। স্মৃতির ভেলায় চেপে সেই ছেলেবেলা থেকেই যেন একপাক ঘুরে এলেন হুগলির বাষট্টি বছরের প্রতিমা দে। বাবার শিক্ষকসুলভ শাসন এখনও তাঁর কানের কাছে ঘুরঘুর করে, নিজেকে নিখুঁত শিক্ষক হয়ে উঠতে সাহায্য করে।
বাবা যতীন্দ্রনাথ চিত্রকরের কাছেই ঠাকুর গড়ার কাজে হাতেখড়ি। বাবা হাতে ধরে শিখিয়েছিলেন খড় বাঁধা, তার উপর মাটির লেপন। একটানে দুগ্গাঠাকুরের চোখ আঁকতে গেলে তুলি কীভাবে ধরতে হবে, তাও নিজের মেজমেয়েকে হাতেকলমে শিখিয়েছিলেন যতীনবাবু। এই মেয়ে যে বংশের মান রাখবেন, টের পেয়েছিলেন হয়তো!
তিন বোনের মধ্যে মধ্যম প্রতিমা। ১৫ বছর বয়স থেকে ঠাকুর গড়ার কাজে মন দিয়েছিলেন। ধীরে ধীরে সেটিই পেশা হয়ে উঠল। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়তে বাবার পাশে থাকার আনন্দই যে আলাদা! আজ হুগলি জেলার অন্যতম মহিলা প্রতিমাশিল্পী তিনি। শ্রীরামপুরের পটুয়াপাড়া লেনের লম্বা গলিটার একপাশে তাঁর পৈর্তৃক কারখানা। তাতে জ্বলজ্বল করছে প্রতিমাদেবীর নাম। নীচে তাঁর বড়ছেলে শিল্পী সনৎ দে-র নাম। দুই ছেলেই এই পেশায় রয়েছেন। তাঁদের আবার কাজ শেখা মা প্রতিমাদেবী ও বাবা গৌরমোহন দে-র কাছে। বাবার পর স্বামী গৌরমোহনের সঙ্গে মিলে এই পেশা সামলেছেন প্রতিমা। স্বামীর মৃত্যুর পর পুরোটার হাল ধরেন নিজেই। ধীরে ধীরে আড়েবহরে বাড়ে কারখানা। লোক নিয়োগ করেন আরও।
জীবনসংগ্রামের কথা বলতে বলতে চলকে উঠল গলার স্বর, বললেন, ‘জানেন, কাজ নিজে না জানলে এই কারখানা চালানো যায় না। আপনি বুঝতেই পারবেন না কারিগর কাজটা ঠিক করছেন কি না, আপনাকে ঠকাচ্ছেন কি না। তাই এই কাজ নিজে জানলে তবেই তরতর করে কারখানা এগবে। আর যাঁর মূর্তি গড়ি, তিনি মেয়ে হিসেবে আপন করে না নিলে, এই কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতাম না।’
কাজ যে এগচ্ছে, সে প্রমাণ মিলল পরিসংখ্যান হাতে আসতেই। এবছর রিষড়া, শ্রীরামপুর ও হরিপাল অঞ্চল মিলিয়ে প্রায় ৪০-৪৫টি প্রতিমার অর্ডার রয়েছে। তাই দ্রুত গতিতে চলছে কাজ। সকাল সাড়ে সাতটা থেকে শুরু করে কাত ১১টা পর্যন্ত দম ফেলার ফুরসত নেই। মাঝে শুধু খাওয়া আর ঘণ্টাখানেক জিরিয়ে নেওয়ার বিরাম মাত্র। শরতের অকালবর্ষণে কারখানার ভিতর বড় ফ্লাডলাইট জ্বালিয়েই চলছে মাটি শুকানোর কাজ। বাংলা ঠাকুর (একচালা) ও আর্টের ঠাকুর— দু’রকম বিগ্রহই তৈরি করেন ‘প্রতিমাদেবী অ্যান্ড কোং’! থিমের ঠাকুরও রয়েছে তাতে। এবছরও যেমন মাহেশ অঞ্চলের একটি ঠাকুরে থাকবে পাথুরে ভাব। দেখলে যেন মনে হবে পুরো প্রতিমা পাথর দিয়ে তৈরি। সমগ্র কৈলাস নেমে আসবে সেই মণ্ডপে। দুর্গা সেখানে পাহাড়ের দেবী। আবার শ্রীরামপুর রাজবাড়ির (গোস্বামীবাড়ি) ঠাকুরের মুখ ও গড়ন একেবারে অন্য ধারার। একচালা সাবেক সেই প্রতিমা বরাবর তৈরি করে এসেছেন প্রতিমাদেবী। এ ঠাকুর যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জানেন, এই মাতৃমূর্তির সামনে গিয়ে দাঁড়ালে বিহ্বল হয় মন।
তবে এবার পুজো এগিয়ে। তাই শেষ সময়ের প্রস্তুতিও তুঙ্গে গোটা পটুয়াপাড়ায়। ঠাকুরে ‘ফিনিশিং টাচ’ দিতে সাইটে যাওয়ার সময় আসন্ন। বারোয়ারিতলায় গিয়েই শেষ মুহূর্তের কাজ সারতে হয়। তাতে রাতও হয় বিস্তর। জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভয় করে না এত রাতে চলাফেরা করতে?’ বাষট্টির প্রৌঢ়ার গলায় তখন সপাট বীরত্ব। বললেন, ‘এত বছর কাজ করছি, বরাবর রাত করে দলের একজন দু’জন ছেলেকে নিয়ে ফিরেছি, কখনও কখনও একাও। কিন্তু কোনও সমস্যা হয়নি এই মফস্সলে।’
সে নাহয় রাস্তাঘাটের বিপদ কাটল, কিন্তু সামাজিক বিপদ? মেয়ে হয়ে বাবার কাছ থেকে পুরুষপ্রধান পেশার প্রশিক্ষণ নেওয়া, তারপর সেই পেশাতে পুরুষকেই টেক্কা দেওয়া— সামাজিক বাধা আসেনি? প্রশ্নটা শুনেই লাজুক হাসলেন পোড় খাওয়া প্রতিমা। বললেন, ‘না, মা, এখনই দেখি পাড়াঘরেও এত আকচাআকচি, আমাদের সময় এসব বড় নামী লোকদের নিয়ে হতো। গরিবের মেয়ে, দুটো টাকার জন্য সৎপথে থেকে বাপের পাশে দাঁড়ালে কেউ কিছুই বলত না। আমার বাবার তো ছেলে ছিল না, আমাদের মধ্যে কেউ এগিয়ে না এলে এই পরম্পরা কে বয়ে নিয়ে যাবে? এ কথা সকলেই বুঝত। আমাকে কখনও কোনও খারাপ ঘটনার মধ্যে পড়তে হয়নি। বরং বরাবর এই কাজে সম্মান পেয়েছি পুরুষ সহযাত্রীদের কাছ থেকেও। কোনও বারোয়ারিও কখনও অসম্মান করেননি। এত বছর কাজ করছি, কারও কাছে কোনও টাকা আটকে নেই।’
তৃপ্ত প্রতিমাদেবী তাই এই পেশাকে আরও ভালোবেসেছেন, কাছে টেনে নিয়েছেন মাটি, রং, খড়কে। এবছরও এক একটি দুর্গাপ্রতিমার দাম পড়ছে গড়ে ৩০-৪০ হাজার। তবে লক্ষাধিক টাকার কয়েকটি ঠাকুরও এবছর তৈরি করছেন তিনি। শুধু দুর্গাই নয়, কালী, লক্ষ্মী, জগদ্ধাত্রী, কার্তিক, গণেশ, সরস্বতী সবধরনের মূর্তিই গড়েন তাঁরা। বাবার দক্ষতাকে জন্মসূত্রে অর্জন করে, তাতে তিনি মিশিয়ে দিয়েছেন নিজস্ব বোধ ও অনুশাসন। সেই পথ ধরেই সুপ্রতিষ্ঠা দিয়েছেন পরিবারকে।
ছোটবেলায় এই কাজে সবচেয়ে শক্ত লাগত কোনটা?
একগাল হেসে জানালেন, ছোটবেলায় সিংহের মূর্তি গড়তে গিয়ে বারবার বিপাকে পড়তেন কিশোরী প্রতিমা। বাবা তখন আলগা ধমকে শেখাতেন সেই অমোঘ ‘টেকনিক’, যা এই লেখার সূচনাবাক্য— ‘অতখানি মাটি সিংহের গায়ে চাপালে হবে নাকি!’
আসলে কোথায় কতটুকু মাটি, কোথায় গাঢ়, কোথায় আলগা— এই অঙ্কেই সফল হন একজন মৃৎশিল্পী। পরিমিতিবোধের এই অঙ্কে জীবনও খুঁজে পায় সাফল্যের দিশা। আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন মফস্সলের ষাট পেরনো মহিলা।
প্রতিমাদেবীর কারখানা ছেড়ে যখন বেরিয়ে আসছি, তখন ফের ঝেঁপে বৃষ্টি এল। কারখানার ভিতরে জ্বলে উঠল হ্যাজাকের আলো। ঘুরে দেখি, মা দুগ্গার মুখে পড়েছে সেই পার্থিব আলো। যাতে ভর দিয়ে আর অল্পদিনের মধ্যেই মৃণ্ময়ী হয়ে উঠবেন চিন্ময়ী! হাজার ওয়াটের আলোও এর কাছে ফিকে।