উকিল ও ডাক্তারদের কর্মব্যস্ততা বাড়বে। পত্নী/পতির স্বাস্থ্য আকস্মিক ভোগাতে পারে। মানসিক অস্থিরভাব। ... বিশদ
একে বলা যেতে পারে ইতিহাসের একটি বৃত্ত সম্পূর্ণ হওয়া, যাকে ইংরেজি পরিভাষায় পোয়েটিক জাস্টিসও বলা যায়। ঘটনার শুরু ১৯৭৬ সালে। আর আশ্চর্য পরিসমাপ্তি ২০২৪ সালে। ১৯৭৫ সালের ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন। তারই জেরে রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের গ্রেপ্তারি পর্ব চলছিল দেশজুড়ে। মিসা আইনে হাজার হাজার রাজনৈতিক বন্দি বিনাবিচারে জেলে থাকতে বাধ্য হয়েছেন। জামিন মিলবে না। দেখানো হয় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার কারণ। বিতর্ক, বিরোধিতা, প্রতিবাদ চলছিল এবং বিষয়টি গড়ায় আদালত পর্যন্ত। ঠিক সেখান থেকেই শুরু হল ভারতের বিচারবিভাগের একটি বিস্ময়কর অধ্যায়। তখন জানা যায়নি অবশ্য একটি আশ্চর্য ঘটনা পরম্পরা ২০২৪ সাল পর্যন্ত চলবে। কী ঘটেছিল?
সবথেকে বড় যে প্রশ্ন উঠেছিল যে, স্বাধীনতার অধিকার কি সরকার কেড়ে নিতে পারে? মৌলিক অধিকার কি কোনও পরিস্থিতিতেই রাষ্ট্র হরণ করতে পারে? সংবিধানের ২১ নং ধারায় বলা হয়েছে জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার। একই সঙ্গে আবার সংবিধানের জরুরি অবস্থা জারির পরদিনই সংবিধানের ৩৫৯ (১) ধারা জারি করে আরও কিছু অধিকার স্থগিত রাখা হয়েছিল। যেমন ৩২ নং ধারায় বলা হয়েছে নাগরিক ব্যক্তিগত অধিকার রক্ষায় সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করতে পারে। সাম্যের অধিকার বলা রয়েছে সংবিধানের ১৪ নং ধারায়। সেটিও হরণ করা হল। অর্থাৎ ৩৫৯ (১) ধারা জারি করে এই মৌলিক অধিকারগুলি অনির্দিষ্টকালের জন্য ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল।
স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন বিরোধী নেতাকর্মীরা নিজেদের রাজ্যের হাইকোর্টে আবেদন করেছিলেন। বলেছিলেন, সংবিধানের এই ধারাগুলি কখনওই ছিনিয়ে নেওয়া যায় না। এবং মিসা আইনের গ্রেপ্তারির পক্ষে রাষ্ট্র যথাযথ কারণ প্রমাণ করতে না পারলে, সেটি অবৈধ হয়ে যায়। ভারত সরকারকে যথেষ্ট অস্বস্তিতে ফেলে সেই সময় একের পর এক হাইকোর্টে এই জেলবন্দি নেতাকর্মীদের পক্ষেই রায় দেওয়া হচ্ছিল। কোনও হাইকোর্ট বলেছে মিসার প্রয়োগ সঠিক নয়। কেউ বলেছে, রাষ্ট্রকে স্পষ্ট করতে হবে এই ধারা জারি করা নিয়ে।
কিছুটা ব্যাকফুটে গিয়ে ভারত সরকার হাইকোর্টগুলির ওই রায় অথবা অভিমতের বিরুদ্ধে আবেদন করে সুপ্রিম কোর্টে। সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চে মামলার শুনানি শুরু হয়েছিল। এটাই হল বিখ্যাত এডিএম জব্বলপুর বনাম শিবকান্ত শুক্লা কেস, ১৯৭৬। সেই মামলায় সরকারের পক্ষ থেকে সুপ্রিম কোর্টকে বলা হয়, জরুরি অবস্থার অর্থই হল রাষ্ট্রের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা। সুতরাং সংবিধানেই রয়েছে রাষ্ট্রের সুরক্ষার জন্য রাষ্ট্র যেকোনও মৌলিক অধিকারকেই স্থগিত রাখতে পারে। সেটাও সার্বিকভাবে নাগরিকদের কল্যাণের লক্ষ্যেই। নচেৎ বৃহৎ এক নৈরাজ্য সৃষ্টি হলে রাষ্ট্রের অস্তিত্বই বিপন্ন হবে।
সুপ্রিম কোর্টের উপর ছিল প্রবল চাপ, যাতে সরকারের পক্ষেই যায় তাদের রায়। অর্থাৎ তাবৎ হাইকোর্টের আপত্তি অথবা সংশয় উড়িয়ে দিয়ে যথাযথভাবে জরুরি অবস্থা এবং তার প্রয়োগের পক্ষেই যায় সর্বোচ্চ আদালতের অভিমতও। অন্যম প্রধান বিচার্য ছিল—সংবিধানের ২২৬ ধারা অনুযায়ী রিট পিটিশন অথবা হেবিয়াস কর্পাসের আবেদন করতে নাগরিক পারে, না কি পারে না।
ঠিক তাই হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের পাঁচজন বিচারপতির বেঞ্চ রায় দিয়েছিল সরকারের পক্ষে। তবে চারজন। একজন ওই রায়ের পক্ষে ছিলেন না। তিনি আপত্তির কথা জানিয়ে ভিন্ন অভিমত প্রকাশ করেছিলেন। যাকে আইনি ভাষায় বলা হয়, ‘ডিসেন্ট নোট’। কারা ছিলেন সেই পাঁচ বিচারপতি। ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এ এন রায়, বিচারপতি এম হামিদুল্লাহ, বিচারপতি পি এন ভগবতী, বিচারপতি ওয়াই ভি চন্দ্রচূড় এবং বিচারপতি হংসরাজ খান্না।
এই পাঁচজন বিচারপতিকে নিয়ে প্রধান বিচারপতির বেঞ্চে হওয়া সেই মামলায় একমাত্র যিনি ভারত সরকারের বিপক্ষে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং সেই কারণে সর্বসম্মতিক্রমে ওই রায় হতে পারেনি, হয়েছিল পক্ষে ৪ এবং বিপক্ষে ১ রায়, তিনি হলেন বিচারপতি হংসরাজ খান্না।
আর তার পরিণতি কী হয়েছিল? তাঁরই হওয়ার কথা ছিল সবথেকে সিনিয়র হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের পরবর্তী প্রধান বিচারপতি। কিন্তু তিনি ভারত সরকারের রোষানলে পড়েন এবং তাঁর পরিবর্তে প্রধান বিচারপতি করা হয় এম এইচ বেগকে। হংসরাজ খান্না নিজের বোনকে আগেই চিঠি লিখেছিলেন যে, আমি এমন একটি রায় তৈরি করছি যে, হয়তো আর আমাকে প্রধান বিচারপতির পদ দেওয়া হবে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি নিজের সিদ্ধান্ত বদলাননি। অর্থাৎ পাঁচজনের মধ্যে তিনিই একমাত্র যিনি ভারত সরকারে পক্ষে সায় দেননি। মিসা এবং ৩৫৯ (১) নং ধারার প্রয়োগ দুটিকেই তিনি ‘অসাংবিধানিক’ আখ্যা দিয়েছিলেন। বাকি চারজন বিচারপতি রায় দিয়ে বলেছিলেন, ১৯৭১ সালের মিসা আইন যথাযথ এবং জরুরি অবস্থার সময় সরকার মনে করলে নাগরিকের অধিকার স্থগিত রাখতেই পারে। অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চের সংখ্যাগুরু অংশ ১৯৭৬ সালের ওই মামলায় জরুরি অবস্থার সময় নেওয়া সরকারি সিদ্ধান্তকেই সমর্থন করে রায় দিয়েছিল। এম এইচ বেগকে প্রধান বিচারপতি করায় হংসরাজ খান্না ইস্তফা দিয়েছিলেন জুডিশিয়ারি থেকে, যা অত্যন্ত স্বাভাবিক।
১৯৭৭ সালের নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস পরাস্ত হয়েছিল। সরকারে আসে তাঁর বিরোধী পক্ষ—অনেক দলের জোট জনতা পার্টি। তারা এসেই জরুরি অবস্থার তদন্ত কমিশন গঠন করেছিল এটা সর্বজনবিদিত। স্বাভাবিক প্রত্যাশায় জনতা পার্টি বেছে বেছে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি হংসরাজ খান্নাকে দায়িত্ব দিতে চাইল তদন্ত কমিশনের, যা আদতে যাবে ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধেই। কিন্তু স্রেফ প্রতিশোধ এবং প্রতিহিংসাবশত তিনি তদন্ত করে ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করতে পারেন, এই অভিযোগ উঠবে ভেবে হংসরাজ খান্না ওই দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমি তো পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করতে পারি। মানুষও সেটাই ভাববে। হংসরাজ খান্নাকে অনেক বলেকয়ে শুধুমাত্র আইন কমিশনের প্রধান করতে রাজি করানো গিয়েছিল, যেহেতু ওই পদের সঙ্গে পূর্ববর্তী সরকারের বিরুদ্ধাচারণের কোনও সম্পর্ক নেই। আইন সংস্কার সংক্রান্ত বিষয়েই সীমাবদ্ধ থাকবে কমিশন। তাই তিনি রাজি হন।
১৯৭৬ সালের পর কেটে গিয়েছে ৪১ বছর। ২০১৭ সাল। সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলা এল। ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার তথা গোপনীয়তার অধিকার সংক্রান্ত। এই মামলা পাঁচজন বিচারপতির বেঞ্চে এসেছে। তাঁদেরই একজন বিচারপতির নাম ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়। তিনি এই মামলার রায় লেখেন। আর এই মামলার রায় দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ১৯৭৬ সালে স্বাধীনতা, প্রাইভেসি এবং সাম্যের অধিকার সংক্রান্ত যে রায় দেওয়া হয়েছিল সেটা ছিল অনেকাংশেই বিরাট বড় ভুল। কারণ এই প্রতিটি অধিকার সংবিধান দিয়েছে এবং কোনও অবস্থায় এই অধিকারকে খর্ব করা যাবে না, রাষ্ট্র ইচ্ছা করলেও পারবে না। এসব হল জন্মগত অধিকার এবং মানবজীবনের অবিচ্ছিন্ন অংশ। সুতরাং ৪১ বছর পুরনো সেই ভুলের সংশোধন করার সময় এসেছে।
১৯৭৬ সালে যে রায় দেওয়া হয়েছিল তাদের মধ্যে কে ছিলেন অন্যতম বিচারপতি যিনি স্বাধীনতার অধিকারকে খর্ব করার পক্ষেই রায় দিয়েছিলেন? বিচারপতি ওয়াই ভি চন্দ্রচূড়। আর ৪১ বছর পর ২০১৭ সালে কে সেই রায়কে ‘ভুল’ আখ্যা দিলেন? ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়—ওয়াই ভি চন্দ্রচূড়ের পুত্র! অর্থাৎ চন্দ্রচূড় নিজের পিতার দেওয়া রায় ও অবস্থানকে ভুল আখ্যা দিয়ে সংবিধানকেই সর্বোচ্চ বলে অভিহিত করলেন ২০১৭ সালে। ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় পরবর্তী সময়ে হয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি। এখনও তিনিই ওই পদে। কিন্তু এখানেই সমাপ্ত হচ্ছে না অধ্যায়।
১৯৭৬ সালের সেই বেঞ্চে একমাত্র কে আপত্তি করেছিলেন জরুরি অবস্থার? বিচারপতি হংসরাজ খান্না। তিনি অধিকারী হলেও তাঁকেও প্রধান বিচারপতি করা হয়নি। বঞ্চনা করা হয়েছিল। ৪৮ বছর পর, আগামী ১১ নভেম্বর কে হতে চলেছেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি? বিচারপতি সঞ্জীব খান্না। কে তিনি? বিচারপতি হংসরাজ খান্নার ভাইপো! কার হাত থেকে তিনি পদাধিকার গ্রহণ করতে চলেছেন? ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়। ইতিহাস কখনও শেষ হয় না। ইতিহাস একটি অবিরত চলন প্রক্রিয়া। হংসরাজ খান্না যা হতে পারেননি, তাঁর প্রিয়তম ভাইপো সেই পদে বসতে চলেছেন। এটাই পোয়েটিক জাস্টিস! ১৯৭৬ সালে যে দু’জনের পিতা ও কাকা ছিলেন একটি যুগান্তকারী মামলার রায় প্রদানে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে, সেই তাঁরাই আগামী ১১ নভেম্বর করমর্দন করবেন ভারতীয় গতেন্ত্রের একটি চমকপ্রদ অধ্যায়ের শেষ পরিচ্ছদের সঙ্গে।
এই ঘটনাগুলি নতুন নয়—সর্বজনবিদিত হয়তো, হয়তো-বা নয়। কিন্তু সর্ববৃহৎ বার্তাটি হল—বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের অবিরত অস্থিরতা দিয়ে ঘেরা দেশ এই ভারতের সবথেকে বড় শক্তি হল তার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ইতিহাস। অর্থাৎ গণতন্ত্রের সবথেকে বড় তিনটি স্তম্ভ—আইনসভা, বিচারবিভাগ এবং সরকারের কাঠামো ভারতের আত্মায় এমন শক্তিশালীভাবে প্রোথিত যে, ৭৭ বছর ধরে বহু রোদ জল ঝড় তাকে ধ্বংস করতে পারেনি। যে বা যারা সেই চেষ্টা করেছে, তারা ব্যর্থ হয়েছে এবং গণতন্ত্র তাদের শিক্ষাও দিয়েছে নির্মমভাবে!