আপনার মনে ধর্মভাব জাগ্রত হবে। কর্মপ্রার্থীরা কর্মের সুযোগ পাবেন। কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতির সূচনা হবে। অর্থ নিয়ে ... বিশদ
স্বামীজী জানতেন, নিবেদিতার অনেক গুণ। তাঁর শিক্ষা, ঐকান্তিকতা, পবিত্রতা, দৃঢ়তা—সবকিছুই অনন্য সাধারণ। তবু ভারতের কাজে তাঁকে উৎসর্গ করার আগে আরও কিছু প্রস্তুতি—আরও কিছু অভিজ্ঞতার প্রয়োজন। নিবেদিতা ভারতে এসেছিলেন ২৮ জানুয়ারি ১৮৯৮। ঠিক তারপরই ফেব্রুয়ারি মাসে মঠ বেলুড়ে নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়ের বাগানবাড়িতে স্থানান্তরিত হয়। মার্চের প্রথম সপ্তাহে অদূরে মঠের নিজস্ব জমি কেনার পর, জায়গাটাকে বাসোপযোগী করার কাজ চলতে থাকে। সে-জমিতেই ছিল একটা পুরোনো বাড়ি। স্বামীজীর বিদেশিনী ভক্ত মিসেস সারা বুল, মিস ম্যাকলাউড তখন ভারতভ্রমণে এসেছেন। স্বামীজী তাঁদের ওই বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করলেন, সেইসঙ্গে নিবেদিতারও। এবাড়িতে স্বামীজী প্রায় প্রতিদিনই প্রাতরাশ অথবা অপরাহ্ণে চায়ের আসরে উপস্থিত থাকতেন। সেখানে তিনি ভারতের কথা—ভারতের অতীত গৌরব, বর্তমান দুরবস্থা, ভবিষ্যতের উজ্জ্বল সম্ভাবনার কথা নানাভাবে, নানাপ্রসঙ্গে আলোচনা করতেন। স্বামীজী তাঁকে যে-বিপুল জ্ঞান দান করেছিলেন, তাতে পরা-অপরা বিদ্যার ভেদরেখা মুছে গিয়েছিল। কেবল আত্মজ্ঞান নয়, ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব, দর্শন, শিল্প—সবকিছু ছিল সেই আলোচনার বিষয়। আর নিবেদিতা গুরুমুখে সেসব কথা শুনেছেন কখনও বেলুড়ে গঙ্গাতীরে, কখনও হিমালয়ের পথে, কখনও অর্ধপৃথিবী পরিক্রমার সময় অর্ণবপোতে, কখনও রিজলি ম্যানব বা পাশ্চাত্যের কোনও অনুকূল পরিবেশে। স্বামীজীর চিন্তা নিবেদিতার চিন্তাধারার সঙ্গে এমন ওতপ্রোত হয়ে গিয়েছিল যে, নিবেদিতা জানতে-অজানতে গুরুদত্ত মহান ভাবগুলি প্রচার ও প্রকাশ করতেন।
নিবেদিতার বাবা ও ঠাকুরদা ছিলেন ধর্মযাজক। দাদামশাই আয়ারল্যান্ডের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ—আইরিশ হোমরুল আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন। পিতামাতার সূত্রে নিবেদিতার চরিত্রে ধর্মচেতনা ও স্বদেশপ্রেম দুটি বিশেষভাবে স্ফুরিত হয়েছিল। নিবেদিতা দেখেছিলেন স্বামীজীর গভীরতম আবেগের কেন্দ্র ভারতবর্ষ। ভারতবর্ষ নিত্য স্পন্দিত হত তাঁর বুকের মধ্যে, প্রধ্বনিত হত তাঁর ধমনীতে, ভারত তাঁর দিনের স্বপ্ন, রাত্রের দুঃস্বপ্ন। শুধু তাই নয়, তিনি নিজেই হয়ে উঠেছিলেন ভারতবর্ষ।
১৮৯৮-এর মে মাসে বিদেশিনীদের সুযোগ হয়েছিল স্বামীজীর সঙ্গে উত্তর ভারতের আলমোড়া এবং সেখান থেকে কাশ্মীর যাওয়ার। নিবেদিতা স্বামীজীর সঙ্গে অমরনাথ তীর্থদর্শনেও যান। ভ্রমণের এই শান্ত অবকাশেও নিবেদিতার প্রাচ্যভাব প্রশিক্ষণের ধারা অব্যাহত ছিল, সেইসঙ্গে তিনি অমরনাথের পথে নিজের চোখে দেখেছিলেন আর এক ভারতবর্ষকে, ত্যাগ-তপস্যা ও তিতিক্ষার ভারতবর্ষকে, সন্ন্যাসী তীর্থযাত্রীদের ঈশ্বর নির্ভর জীবনকে। পরবর্তী কালে ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের কাছে নিবেদিতা বলেছিলেন, ‘‘ভূপেন, তুমি কি মনে কর, যে-কোনো ইউরোপীয় বা আমেরিকান ভ্রমণকারী ভারতীয় জীবনধারাকে ব্যাখ্যা করার জন্য বিবেকানন্দকে পাবে—আমি যা পেয়েছি!’’ এই ভ্রমণপর্বে নিবেদিতার আন্তর প্রস্তুতি দুভাবে হয়েছিল। প্রথমত, স্বামীজী চাইতেন, নিবেদিতার ভারত-উপাসনার পিছনে জগজ্জননীই একমাত্র প্রেরণাদাত্রীরূপে থাকুন।