আপনার মনে ধর্মভাব জাগ্রত হবে। কর্মপ্রার্থীরা কর্মের সুযোগ পাবেন। কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতির সূচনা হবে। অর্থ নিয়ে ... বিশদ
মানব সভ্যতার আত্মঘাতী হয়ে ওঠার বিপুল আত্মোপলব্ধির সুযোগ দিল কোভিড-১৯ নামের এক ভাইরাস। স্বাস্থ্য সুরক্ষার যে কাঠামো পৃথিবীর মানুষ এতদিনে গড়ে তুলেছিল, তাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল সেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাস। যার ঠেলায় বছরজুড়ে গোটা দুনিয়া ছিল যেন এক নিঝুমপুরী। তালি বাজিয়ে, থালি বাজিয়ে, ঘণ্টা বাজিয়ে আমরা যেন আরেকটা জীবনে ঢুকে পড়েছিলাম। যা আমাদের অচেনা। করোনা এমন কিছু বিধিনিষেধ, নিয়ন্ত্রণ, পরিবর্তন নিয়ে এল, যার কথা কখনও ভাবিনি আগে।
ব্যস্ত সব জনপদ শুনশান। বেশিরভাগ মানুষ ঘরবন্দি। জরুরি প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে বেরনো মানুষের চোখে-মুখে আতঙ্ক। স্তব্ধ গাড়িঘোড়া। ট্রেন-বিমান নিশ্চল। হাসপাতালে উপচে পড়া রোগীর ভিড়। মর্গে সারি সারি মৃতদেহ—করোনা ভাইরাস মহামারীতে বিশ্বের অসংখ্য দেশ, শহর-নগরকে নতুন এই বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। চিকিৎসক, বিজ্ঞানীদের নিদান, ‘তফাৎ যাও’! অন্তত দু’গজ। রাষ্ট্র জানিয়ে দিল, সব বন্ধ। সভ্যতার মুখে মুখোশ পরিয়ে, অর্থনীতির পায়ে বেড়ি এঁটে ঘরে ঢুকে পড়ল গোটা বিশ্ব। এ যেন অনন্ত নৈঃশব্দ্য। আর আমাদের জীবনে পরিচিত হয়ে উঠল লকডাউন, সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং, কন্টেইনমেন্ট জোন, ওয়ার্ক ফ্রম হোম, অনলাইন ক্লাস, মাস্ক, অক্সিমিটার, স্যানিটাইজারের মতো শব্দগুলো। শিক্ষাক্ষেত্রেও চরম অনিশ্চয়তা। স্কুল বন্ধ। অনলাইন ক্লাসই হয়ে উঠেছে অনির্দিষ্ট ভবিষ্যৎ।
লকডাউন পর্বের সেই দৃশ্যটা মনে করুন। কোনও বিশেষণ, কোনও মাপকাঠি বা বর্ণনাতেই সেই লকডাউনের প্রকৃত রূপ বোঝানো সম্ভব নয়। শুনশান পথঘাট, ঘরবন্দি মানুষ, হাসপাতালে হাসপাতালে লাশের স্তূপ, মৃত্যুর পরেও দেখা করা যাবে না প্রিয়জনের সঙ্গে— এ সব তো ছিলই। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যে চিত্রটা রাস্তায় নেমে এসেছিল, সেটা পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়ি ফেরার দৃশ্য। পরিযায়ী শ্রমিকরা দলে দলে মাইলের পর মাইল হাঁটছেন, মাথায় পুঁটলি। করোনা তাঁদের থেকে চড়া মাসুল আদায় করেছে। রাস্তায় খাওয়া, পথেই ঘুম, প্রাতঃকৃত্য। পরদিন আবার হাঁটা। কত জন যে বাড়ির পথে মারা গিয়েছিলেন, ভারত সরকারের কাছে নাকি তার হিসেবও নেই! তারপর বাড়ি ফিরে কর্মহীন অসহ্য যাপন। হিসেব বলছে, প্রায় ৮ কোটি পরিযায়ী শ্রমিক তথা অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক কাজ হারিয়েছিলেন লকডাউনে। আমরা চাইলেও ইতিহাস ভুলতে পারবে না, পরিযায়ী শ্রমিকদের সেই হাহাকারের কথা। ইতিহাস ভুলতে পারবে না রাজপথে পরিযায়ীর পদযাত্রা, রেললাইনে ঘুমিয়ে থাকা শ্রমিকদের পিষে দিয়ে মালগাড়ি চলে যাওয়া। সরকার হিসেব রাখুক না রাখুক, ইতিহাসবিদের কলম এড়াতে পারবে না কয়েকশো কিলোমিটার পথ হেঁটে পাড়ি দিয়ে বাড়ির কাছে এসে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া সেই ছেলেটার কথা।
লকডাউন জারি রেখেও ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু হয়েছিল জুনের শেষে। তার আগে টানা ৬৮ দিন চলেছিল লকডাউন। সেই লকডাউনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছিল পর্যটন এবং অসামরিক বিমান পরিবহণ ক্ষেত্র। উৎপাদন থেকে পরিষেবা, খুচরো বিপণী থেকে ছোট দোকানদার, ট্রেনের হকার থেকে ফুটপাতের ব্যবসায়ী—কোনও ক্ষেত্রই করোনার ছোবল থেকে মুক্ত হতে পারেনি। ব্যক্তিগতভাবে একজন ভারতবাসী বা বিশ্ববাসীকেও হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি কোভিডের কারণে আর্থিক সমস্যায় পড়েননি। অর্থনীতিবিদদের মতে, অর্থনীতিতে কোভিডের এই ক্ষত কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী এবং গভীর। সেখান থেকে সহজে পরিত্রাণের উপায় নেই।
আমরা চাইলেও ইতিহাস ভুলতে পারবে না, ‘অর্থহীন’ ২০২০। যখনই অর্থনীতিতে ধাক্কা আসবে, তুলনা আসবে এই বছরের। শেয়ার মার্কেটে কয়েকদিনে কার কত টাকা উবে গিয়েছিল, রাতারাতি উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কোন শিল্পে লোকসানের বহর কত বেড়েছিল—সব উঠে আসবে আলোচনায়। তবু কোভিডকালে রাজনীতি, কোভিড নিয়ে রাজনীতির শেষ ছিল না। নিজের ঢাক পেটাতে কসুর করেননি দেশের প্রধানমন্ত্রী। করোনা মোকাবিলায় ভারত অসামান্য কাজ করেছে, এমনই দাবি তাঁর। কোন মাপকাঠিতে? না, কোনও পরিসংখ্যান দেননি প্রধানমন্ত্রী। লকডাউন মানুষের জীবন ও জীবিকা—কোনওটাই রক্ষা করতে পারেনি। অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে, অথচ প্রধানমন্ত্রী দাবি করছেন ভারত নাকি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে! কীভাবে? করোনা হানা দেওয়ার আগেই আমাদের উন্নয়নের হার ছিল মাত্র ৩ শতাংশ। ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ১০টি ত্রৈমাসিকে ভারতের অর্থনীতি ক্রমেই পিছিয়েছে। অথচ, প্রধানমন্ত্রী সেই ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির বুকনি দিয়ে চলেছেন। এই করোনাকালেই নিয়ে এসেছেন ভয়ঙ্কর ‘কৃষি আইন’। পেট্রল-ডিজেলের দর সর্বকালীন রেকর্ডের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। রান্নার গ্যাসের দাম আকাশছোঁয়া। রাস্তায় রাস্তায় পোস্টার পড়েছে: সব বেচে দে নরেন...
করোনা পর্ব ভার্চুয়াল সভার দরজা খুলে দিয়েছে। উপায় নেই। রাস্তায় শক্তিপ্রদর্শনের লড়াই কমেছে। সর্বোচ্চ নেতারা অনলাইন বক্তৃতায় জোর দিয়েছেন। ফলে মোবাইল, মনিটর বা টিভি স্ক্রিনের ফ্রেমেই আমরা এখন অনেক বেশি দেখতে পাচ্ছি রাজনীতির খেলা। ২০২০-তে রাজনীতি ছিল ‘ফ্রেমবন্দি’। তবে নেতাদের জন্যই। আর সাধারণ মানুষ? মঞ্চে এবং মাঠে বসা মানুষদের মধ্যে একচুলও ফারাক কমেনি। এমন একটা দুঃসময়েও মন্দির রাজনীতি জাগ্রত থেকেছে। রাজনৈতিক খুনোখুনি চলেছে। ফেক ভিডিও, ফেক খবর ছড়িয়েছে নিজস্ব নিয়মেই। কুকথাও ছড়িয়েছে সমানতালে।
বছর শেষে দেশ জুড়ে ঘনিয়ে আসা অন্ধকার অনেকখানি কেড়ে নিয়ে গিয়েছে প্রাপ্তির আলো। সেই ম্লানতা থেকে একা বাংলাই বা বাঁচবে কেমন করে! নাগরিককে ভুল বোঝাব এবং পাত্র-মিত্র-অমাত্য দিয়ে সমাজমাধ্যমে মিথ্যাকে সত্য করে দেব—এই কর্মপদ্ধতি রাজনীতির সর্বনাশ করছে, সমাজের ভয়ঙ্কর বিপদ আনছে। সময়টা যেন তৈরিই ছিল। বাংলার বিধানসভা ভোটের দামামা বাজতেই রবীন্দ্রনাথের লেখা দেশের জাতীয় সঙ্গীতেই বদল চেয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছেন বিজেপির সাংসদ তথা অন্যতম নেতা সুব্রহ্মণ্যম স্বামী। গোটা রাজ্য রাজনীতিকে অগ্নিগর্ভ করার তারিকা। জানা গিয়েছে, মোদি ক্ষমতায় আসার পরে সঙ্ঘের শিক্ষা সেলের নেতা দীননাথ বাত্রা এনসিইআরটি-র পাঠ্যক্রম থেকে রবীন্দ্রনাথের লেখা বাদ দেওয়ার সুপারিশও করেছেন। বাংলাকে হেয় করার চক্রান্ত চলছেই। কে না জানে, এই নতুন বছরেই যে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা ভোট। আর ভোট মানেই ভোটপাখিদের আনাগোনা। প্রতিশ্রুতির বন্যা। রাজ্যটাকে সোনায় মুড়িয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখানো। কোথায় ছিলেন সেদিন? যেদিন উম-পুনে বিধ্বস্ত হয়েছিল প্রায় গোটা দক্ষিণবঙ্গ! কোথায় ছিলেন আপনারা? যখন দিনের পর দিন কমিউনিটি কিচেন কিংবা শ্রমজীবী রান্নাঘরের সামনে হাজার হাজার মানুষ থালা নিয়ে লাইন দিয়েছিল! ভয়ঙ্কর সময়ে কারা পাশে থাকে, তাও তো চিনিয়ে গিয়েছে এই ২০২০।
বর্ষশেষের বাতাসে ভোটের গন্ধ। যে বাতাস হয়ে উঠছে অবিশ্বাসে ভারী। চারিদিকে চক্রান্তের গন্ধ। রাজনীতির হাটে নিত্যনব অলীক কুনাট্য রঙ্গ। দলবদলুদের বৃহৎ উল্লম্ফন, নিজেদের বিশুদ্ধ সততার বিজ্ঞাপন, মিথ্যাচার! এ রাজ্যের মানুষ সব দেখছেন। তাঁরা জানেন, বছরটি শুরুই হবে রাজনীতির গরম হাওয়ায়। ভোটযুদ্ধের আগে যুদ্ধক্ষেত্র পরিদর্শনে এসেছিলেন অমিত শাহ। ভোটের বাজনা বাজলে কথার তোড় ও প্রতিশ্রুতি প্লাবন সজোরে বইতে থাকে—তাও টের পেয়ে গিয়েছেন রাজ্যবাসী। ভোটের পরই নাগরিকত্ব (সংশোধিত) আইন কার্যকর করবার বিষয়ে যে প্রতিশ্রুতি অমিত শাহ দিয়ে গিয়েছেন, তাও বিপজ্জনক। এই আইনটিতে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু-মুসলমান মিশ্রিত সমাজ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হওয়ার সম্ভাবনা। একইসঙ্গে দলিত গোষ্ঠীগুলিকে কাছে টানতে নাগরিকত্বের টোপের ব্যবহারও আশঙ্কাজনক। মতুয়া সম্প্রদায়ের একাংশ জানিয়েছেন, এই আইন কার্যকর হলে তাঁরাও বিপন্নতর হবেন। নিশ্চিত।
তবু ভরসা এটুকুই, বাঙালি এখনও স্বধর্ম-চ্যুত হয়নি। জাতি-ধর্ম-বর্ণভেদ নস্যাৎ করে সকল বিভাজনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রদীপ শিখা জ্বালিয়ে রেখে বাংলা এবং বাঙালি পথে নেমেছে সবার আগে। যুগ যুগ ধরে বঙ্গ চেতনায় যা সঞ্চারিত। এই শক্তি অনিঃশেষ। বাংলার এই সম্প্রীতিই স্বাভাবিক, মানুষের মন নিজস্ব গতিতে এই দিকেই ধাবিত হয়। সেই স্বাভাবিক গতি রোধ করে সমাজের অস্বাভাবিকতা—হিংসার, বিদ্বেষের আবহ। আর তা জীবন দিয়েই রুখবেন—কথা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
‘বিশের বিষ’ ভুলতে চাই আমরা। করোনার বিষ নির্মূলে প্রতিটি মানুষের হাতে পৌঁছাক অমূল্য ভ্যাকসিন। যত দ্রুত সম্ভব! নতুন বছরের প্রার্থনা একটাই, ‘বিশে’-এর আঁধার ঘুচিয়ে ‘একুশ’ যেন আলোকিত হয়ে ওঠে। বাংলা আর বাঙালির জাত্যভিমান বাঁচাতে এই ‘একুশ’-ও যেন অমর হয়ে ওঠে। আরও একবার...