আপনার মনে ধর্মভাব জাগ্রত হবে। কর্মপ্রার্থীরা কর্মের সুযোগ পাবেন। কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতির সূচনা হবে। অর্থ নিয়ে ... বিশদ
আরেক সাহিত্য-আকাদেমি পুরস্কারপ্রাপক এম এম কালবুর্গি খুন হয়েছিলেন, গৌরী লঙ্কেশ খুন হওয়ার দু’বছর আগে, ওই বেঙ্গালুরু শহরের কল্যাণনগরে সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ। প্রাক্তন অধ্যাপক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কালবুর্গির খুনিরা তাঁর বাড়িতে এসেছিল ছাত্র সেজে।
তারিখটা ছিল ৩০ আগস্ট, ২০১৫। আততায়ীরা সেই বাইক চড়েই এসেছিল। কালবুর্গির স্ত্রী ওদের ছাত্র ভেবে ড্রইংরুমে বসান। রান্নাঘরে চা-ও আনতে যান। সেখান থেকে গুলির শব্দ শুনতে পান কালবুর্গির স্ত্রী উমা। তারও দু’বছর আগে ওই আগস্ট মাসেই মহারাষ্ট্রের পুনে শহরে প্রাতঃভ্রমণ সেরে বাড়ি ফেরার পথে ওঙ্কারেশ্বর মন্দিরের ঠিক সামনে খুন হন চিকিৎসক নরেন্দ্র দাভোলকার। দাভোলকার অবশ্য বহুদিন ধরেই নানাভাবে নানা হুমকি পাচ্ছিলেন, মৃত্যুপরোয়ানাও ছিল। মহারাষ্ট্র সরকার তাঁকে পুলিসি-নিরাপত্তা দিতে চেয়েছিল, কিন্তু দাভোলকার তা প্রত্যাখ্যান করেন। দাভোলকার বলেছিলেন, “কেন নেব এই নিরাপত্তা? আমি যদি এটা নিই তাহলে সেটা নিচ্ছি আমার নিজের দেশের মাটিতে, নিজের দেশের লোকেদের হাত থেকে বাঁচার জন্য। আমি ভারতীয় সংবিধানের আধারের মধ্যে থেকে কাজ করছি। কারুর বিরুদ্ধে আমি নই, বরং সবার পক্ষে।” তাও সেই দু’জন অজ্ঞাতনামা বাইক-আরোহী এই ৬৮ বছরের প্রৌঢ়ের মাথায় ও বুকে সকালবেলায় চার রাউন্ড বুলেট বিঁধে দেয়। যৌবনে খুব ভালো কবাডি খেলতেন এই চিকিৎসক। দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও কবাডি খেলেছিলেন দাভোলকার। তিনিও সরকারি পুরস্কারপ্রাপ্ত বিদ্বজ্জন ছিলেন।
দু’বছর বাদে মারাঠি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক গোবিন্দ পানসারে অবশ্য মহারাষ্ট্রের কোলাপুরে গৌরী লঙ্কেশদের মতো গুলি খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মারা যাননি। সস্ত্রীক পানসারে দাভোলকারের মতোই প্রাতঃভ্রমণ সেরে ফেরার পথে আবার ওই অজ্ঞাত হেলমেটধারী দুই বাইক আরোহীর মুখোমুখি হন, যারা ৮২ বছর বয়সি পানসারে ও তাঁর স্ত্রীর বুকে বুলেট বিঁধিয়ে পালিয়ে যায়। স্বামী-স্ত্রী দু’জনকেই রক্তাক্ত অবস্থায় নিকটবর্তী একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরের দিন পানসারের জ্ঞান অল্প ফিরলেও, তাঁর অশীতিপর বৃদ্ধা স্ত্রী উমা দেবী কোমাতেই থাকেন। তিনদিন পরে পানসারেকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা হিসেবে মুম্বইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে প্লেনে উড়িয়ে আনা হয়। কিন্তু
পরদিন অর্থাৎ গুলি খাওয়ার পাঁচদিন পরে, ২১ ফেব্রুয়ারি পানসারের শারীরিক অবস্থার আচম্বিত অবনতি ঘটে ও ফুসফুসে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জন্য এই বৃদ্ধ ওই হাসপাতালে প্রয়াত হন। তাঁর স্ত্রী উমা পানসারে তখনও কোলাপুরের ওই হাসপাতালে গভীর কোমায়। দু’বছর বাদে অর্থাৎ যে বছর কালবুর্গি খুন হয়েছিলেন, সেবছরের
মার্চে মৃত্যুর সঙ্গে যুঝে কোলাপুরের ওই হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান অশীতিপর উমা পানসারে। তিনি পরে বলেছিলেন, যখন বাইক আরোহীরা
ওই সকালবেলা তাদের আগ্নেয়াস্ত্র বার করে, তার আগে তারা জোরে জোরে হাসছিল। তারপর উমা দেবীর আর কিছু মনে নেই।
যে-ক’জন সন্দেহভাজন পরে ধরা পড়ে তাদের মধ্যে অন্যতম সমীর গায়কোয়াড় আর পরশুরাম বাঘমোরে পরে বলেছিল, দাভোলকার, কালবুর্গি এবং গৌরী লঙ্কেশ তিনজনকেই তারা খুন করেছে। কিন্তু কেন খুন করেছে? তা তারা জানে না। যাঁদের তারা খুন করতে গিয়েছিল, তাঁদের তারা ভালো করে চেনেও না। কোনও একজন উচ্চপদস্থ লোক তাদের বলে নিজের ‘কওম’-কে বাঁচাতে এঁদের খুন করা জরুরি। তারা এই খুনগুলোর জন্য অর্থের বরাত পায়নি, ধর্মের বরাত পেয়েছিল।
লক্ষণীয় যে, যাঁরা গোটা ভারতের এই তথাতকথিত ‘কওম’ রক্ষাকারী হিন্দুত্ববাদীদের হাতে খুন হচ্ছেন তাঁরা পেশায় হয় অধ্যাপক, শিক্ষক, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী বা মানবাধিকার কর্মী তথা লেখক, যাঁদের সংখ্যা ভারতে সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে বেশি।
বিশ্ববন্দিত অর্থনীতিবিদ রাজ্য বিজেপির ভাষায় ‘জমি-মাফিয়া’ এবং ‘অযোগ্য নোবেল পুরস্কার প্রাপক’! সবাই জানে, অশীতিপর অমর্ত্য সেন ঘোর বিজেপি-বিরোধী। তাঁর শান্তিনিকতনের বাড়ি ‘প্রতীচী’র সামনে ‘কওম’-রক্ষার বরাতপ্রাপ্ত হেলমেট পরা দুই অজ্ঞাতপরিচয় বাইকধারী এখনও যে জোরে জোরে হাসতে হাসতে অর্ধবৃত্তাকারে
ঘুরে এসে দাঁড়ায়নি, তার কারণ গঙ্গার এপারে স্যাফ্রন ব্রিগেড পৌঁছতে পারেনি। ভাগীরথীর ধারে দশপ্রহরণধারিণী দুর্গা তাঁর দশ হাত দিয়ে পবননন্দন হনুমানের লেজটি মুচড়ে ধরে আছেন বলে। ওই হাতের মুঠো যেদিন আলগা হবে, সেদিন পিলপিল করে, ‘জয় বজরংবলী’র দলবল পাইপগান, ওয়ান শটার কোমরে গুঁজে, গুটখার খয়েরি পিক ফুটপাতে ফেলে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকবে
আর ‘মছলিখোর বঙ্গালি কা বাচ্চা’দের চিন্তাযুক্ত কপাল এবং শীর্ণ ছাতি টিপ করে করে গুলি ছুঁড়বে। মমতা বন্দোপাধ্যায় কৃত সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালগুলি তখন ভরে উঠবে আর্তনাদে, আর সিঁড়িগুলি ধুয়ে যাবে রক্তের দাগে।
কী অপরাধ ছিল অমর্ত্য সেনের? তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অর্থনৈতিক নীতির কট্টর সমালোচক। নোটবন্দি থেকে জিএসটি, দেশজুড়ে বেকারত্বের ক্রমবর্ধমানতা ও জিডিপি-হ্রাস ইত্যাদি নিয়ে বরাবরই সরব। বিজেপি ঘেঁষা অর্থনীতিবিদ জগদীশ ভারতীর সঙ্গে তাঁর তাত্ত্বিক বিতর্ক ভারতের অর্থনীতি মহলে সুবিদিত ঘটনা। নরেন্দ্র মোদি জমানার প্রথম দিকেই অমর্ত্য সেন এই সরকারের রক্ষণশীল অর্থনীতি ভাবনার বিরোধিতা করে বলেছিলেন, ‘সোশ্যাল ইকুইটি’, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার বিকাশে তৃণমূল স্তরে কাজ করে তাদের স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ করা উচিত। জগদীশ ভারতীর মনে হয়েছিল মনমোহন সিং পরিচালিত ইউপিএ-২-এর অর্থনৈতিক নীতি মুক্ত বাজারের পক্ষে, যা অধিকাংশ উদ্যোগপতির ‘জান্তব লোভ’-এর বৃদ্ধি ঘটায়।
কিন্তু এসবই তো তাত্ত্বিক তর্কাতর্কির বিষয়। আজ অধিকাংশ উদ্যোগপতির জায়গায়, বৃহৎ একচেটিয়া পুঁজি কেবলমাত্র দু’টি গুজরাতি বৃহৎ পুঁজিপতি ব্যবসায়ীর হাতে কুক্ষিগত হয়ে গিয়েছে রাষ্ট্রীয় অনুমোদনে। তা নিয়েও বহু তর্কাতর্কি চলেছে। সকলে কমবেশি এটা জানেন। তাই বলে অমর্ত্য সেন ‘জমি-মাফিয়া’? ‘অযোগ্য নোবেল পুরস্কার প্রাপক’? তাঁর একশো বছরের পৈতৃক বাড়ি আক্রমণ ও ভাঙচুরের উদ্যোগ? যে পরিবারের সঙ্গে বোলপুরে যোগাযোগ ছিল স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের। বজরংবলীরা তা হলে পারছে এত দূর করতে। এসব বাঙালিকে চোখ মেলে দেখতে হচ্ছে। যে তরুণ কবি আসছেন কবিতা লিখতে, যে সাংবাদিক নতুন আসছেন পেশায়, যে সংস্কৃতি কর্মী সবে এসেছেন সংস্কৃতির আঙিনায়, যে শিক্ষক-অধ্যাপক সদ্য পড়াতে ঢুকছেন স্কুলে বা কলেজে, তাঁরা অন্তত অনুধাবন করুন মমতা বন্দোপাধ্যায় কোনও অঙ্গরাজ্যের মাথায় না-থাকলে, তাঁদের ঠিক কী দশা হতে পারে! অন্তত তাঁরাই বিবেচনা করুন।
সাধু সাবধান!