আপনার মনে ধর্মভাব জাগ্রত হবে। কর্মপ্রার্থীরা কর্মের সুযোগ পাবেন। কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতির সূচনা হবে। অর্থ নিয়ে ... বিশদ
ঈশ্বরই কল্পতরু এবং তাঁর সাক্ষাতে তাঁকেই চাওয়ার এই সৌভাগ্য বা সদ্বুদ্ধি সকলের হয় না। ‘কশ্চিদ্ যততি সিদ্ধয়ে।’ পুণ্যাত্মারাই কেবলমাত্র এই তত্ত্ব-জ্ঞানের অধিকারী হন এবং এই সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে থাকেন। এ প্রসঙ্গে প্রত্যক্ষদর্শী ভক্তপ্রবর রামচন্দ্র দত্ত তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন: ‘ভগবানকে চাহে যে, সে ভগবান পাইবে? তাঁহাকে পাওয়া যায় না, এ সংসারে সকলেই ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। যে তাঁহাকে চাহে, যে তাঁহাকে দেখিবার জন্য লালায়িত হয়, যে একবার দেখা দাও বলিয়া কাঁদিতে পারে, তাহার সমক্ষে ভগবান তৎক্ষণাৎ আবির্ভূত হইয়া থাকেন। যে ভগবান বলিয়া দুই দিন কাঁদিতে পারে, নিশ্চয়ই ভগবান তাহার গৃহে উপস্থিত হইয়া থাকেন। একথা যদি মিথ্যা হয়, করিয়া দেখুক সত্য কিনা? যদ্যপি ভগবানকে দেখা না যায়, তাহা হইলে শাস্ত্রাদির আর মর্যাদা থাকিতে পারে না।’
শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে কিন্তু সেদিন কাউকে চাইতে হয়নি; তিনি অযাচিতভাবেই কৃপাবারি সিঞ্চন করলেন। এই প্রসঙ্গে মনীষী ম্যাক্সমুলার কর্তৃক সংকলিত ‘শ্রীরামকৃষ্ণের বাণী’তে বলা হয়েছে,—‘কল্পতরুর নীচে বসে একজনের ইচ্ছে হ’ল রাজা হই, অমনি সে রাজা হ’ল। পরমুহূর্তে ইচ্ছে হ’ল, যেন সুন্দরী স্ত্রী পাই, সঙ্গে সঙ্গে তাই পেল। তারপর মনে হ’ল যদি বাঘ এসে তাকে খেয়ে ফেলে, অমনি বাঘ এসে খেয়ে ফেললে। ভগবান সেইরকম কল্পতরু। যে তাঁর সামনে নিজেকে অভাগা বা গরীব ভাবে সে সেইরকম থাকে। কিন্তু যে ভাবে ও বিশ্বাস করে ভগবান তার ইচ্ছা পূর্ণ করবেন, তার ইচ্ছাও সত্যি সত্যি পূর্ণ হয়।’ তাঁর কাছে চাইতে হয় না। তাঁর শরণাপন্ন হলে, তিনি না-চাইতেই প্রদান করে থাকেন। তাই করুণাময় শ্রীরামকৃষ্ণ অন্তরঙ্গ-বহিরঙ্গ, জ্ঞানী-অজ্ঞানী, শিষ্য ভক্ত নির্বিচারেই সকলকে তাঁর কৃপাশিস বিতরণ করলেন—‘তোমাদের চৈতন্য হোক’। আশ্চর্য! সেই সময় কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণের গুটিকয়েক (প্রায় ত্রিশ জন) গৃহী ভক্ত-শিষ্য ছাড়া, কোনও ত্যাগী সন্তানই কাছাকাছি ছিলেন না। ভক্ত-ভৈরব গিরিশচন্দ্রই রামচন্দ্র, অতুল প্রভৃতি ভক্ত সকলকে ডেকে বললেন,—‘তোরা কে কোথায় আছিস্, আজ শ্রীশ্রীঠাকুর কল্পতরু হয়েছেন এবং সকলকে বর দিচ্ছেন।’ (‘আমার জীবনকথা’—স্বামী অভেদানন্দ)
তাঁর সন্ন্যাসী সন্তানরা তখন তপস্যাভারে ক্লান্ত হয়ে বিশ্রামরত এবং শ্রীরামকৃষ্ণও যেন সেই মুহূর্তের জন্য নাটকীয়ভাবে আলাদা করে গৃহীভক্তদের চৈতন্য বিতরণ করলেন। বলা বাহুল্য, তিনি ইতিপূর্বেই তাঁর অন্তরঙ্গ ত্যাগী-পার্ষদদের চৈতন্য প্রদান করেছিলেন। তবে ‘কল্পতরু’ ঘটনাস্থলে শ্রীরামকৃষ্ণের কোনও ত্যাগী-সন্তানের উপস্থিতি না থাকলেও শ্রীরামকৃষ্ণকে বেষ্টন করে গৃহী-ভক্তরা যে কল্পতরু-কৃপাপরশ প্রাপ্ত হয়েছিল, সে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন দুই ত্যাগব্রতী লাটু মহারাজ (স্বামী অদ্ভুতানন্দ) ও শরৎ মহারাজ (স্বামী সারদানন্দ)। তাঁরা তখন শ্রীশ্রীঠাকুরের ঘর গোছগাছ করছিলেন এবং ভক্তদের চেঁচামেচি শুনে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে কল্পতরু-লীলা প্রত্যক্ষ করেন। পরবর্তীকালে এক ভক্ত লাটু মহারাজকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন: ‘আপনি সেদিন উপর থেকে নেমে এলেন না কেন? শুনেছি সেদিন তিনি কল্পতরু হয়েছিলেন—যে যা চাইছিল তাকে তাই আশীর্বাদ করেছিলেন।’ উত্তরে লাটু মহারাজ বলেন: ‘তিনি তো আশীর্বাদ দিয়ে আমাদের ভরপুর ক’রে দিয়েছেন। আবার কি চাইব তাঁর কাছে?’ শরৎ মহারাজও পরবর্তীকালে অনুরূপ প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন: ‘পাবার ইচ্ছা তো মনে আসেনি, তাছাড়া তিনি যে আমাদেরই ছিলেন।’ (‘ভক্তমালিকা’)
কল্পতরু দিবসে ভক্তদের চৈতন্যপ্রদান করার ঘটনাকে লীলাপ্রসঙ্গকার স্বামী সারদানন্দজি ‘আত্মপ্রকাশে অভয়দান’ বলে উল্লেখ করেছেন। আবার, এক ভক্তের প্রশ্নের উত্তরে স্বামী শিবানন্দজি স্মৃতিচারণ করে জানিয়েছেন: ‘কেবলমাত্র আজকের দিনে তিনি কল্পতরু হয়েছিলেন—তা কেন? তিনি তো সদাই কল্পতরু। জীবকে কৃপা করাই তাঁর একমাত্র কাজ ছিল। আমরা তো চোখের সামনে দেখেছি, তিনি নিত্যই কত জীবকে কত ভাবে কৃপা করতেন। হ্যাঁ, কাশীপুরের বাগানে এইদিন তিনি একসঙ্গে অনেক ভক্তকে কৃপা করেছিলেন। সে হিসাবে আজকের দিনের একটা বিশেষত্ব আছে। তিনি যে কৃপাসিন্ধু ছিলেন, তা সেদিনকার ঘটনায় ভক্তরা বিশেষ ক’রে বুঝতে পেরেছিলেন।’
কল্পতরু দিবস ছাড়াও কৃপাময় শ্রীরামকৃষ্ণের কৃপাবারি সতত বর্ষিত হতো; সেকথা লীলাপ্রসঙ্গকারও বিভিন্ন জায়গায় উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন: ‘কোন কোন ভক্তের প্রতি করুণায় ও প্রসন্নতায় আত্মহারা হইয়া দিব্যশক্তিপূত স্পর্শে তাহাকে কৃতার্থ করিতে আমরা ইতিপূর্বে দক্ষিণেশ্বরে প্রায় নিত্যই দেখিয়াছিলাম।’ সুতরাং সদা কল্পতরু শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্তদের চৈতন্য-প্রদান ঘটনাটার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল কল্পতরু দিবসেও; তবে সেদিন একসঙ্গে অনেক ভক্তকে চৈতন্য-প্রদান করেছিলেন, এবং একটা বিশেষ আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন—যা সদা ‘কল্পতরু’ শ্রীরামকৃষ্ণ-জীবনেতিহাসে একটা বিশেষ অধ্যায়রূপে সূচিত হয়েছিল—এই কল্পতরু-রূপে আবির্ভাব উৎসবের মাধ্যমে।
চৈতন্যদায়ক ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ কাশীপুর উদ্যানবাটীতে তাঁর ইহলৌকিক মহালীলার পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছিলেন; এবং এই উদ্যানবাটীতেই তাঁর লীলাসায়াহ্নে ভক্তদের মধ্যে পরিচিতি ঘটেছিল ‘কল্পতরু শ্রীরামকৃষ্ণ’ রূপে। চৈতন্যময় শ্রীরামকৃষ্ণের সুশীতল স্নেহচ্ছায়ার সংস্পর্শে যারা এসেছিল তাদের প্রত্যেকের উপর বর্ষিত হয়েছিল তাঁর সেই অভূতপূর্ব অমোঘ অমিয় বাণী ‘চৈতন্য হোক’। মানুষ তো চৈতন্যস্বরূপই! কেবলমাত্র মায়া-রূপ আবরণ উন্মোচনের অপেক্ষা! অর্থাৎ মানুষকে মান-হুঁশ করানো,—মানুষের এই সুপ্ত মনুষ্যত্ববোধ ও দেবত্বভাবকে জাগ্রত করানোর জন্যই যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণের আগমন। তাই স্বামীজি বলছেন: ‘অহৈতুকী কৃপাসিন্ধুর অপার কৃপা, পতিত পাবনের অপার দয়া—সেইজন্য আমায় আশ্রয় দিয়াছেন। আমি পতিত, কিন্তু ভগবানের অপার করুণা, আমার কোন চিন্তার কারণ নাই। জয় শ্রীরামকৃষ্ণ!’ শ্রীরামকৃষ্ণ উদ্ঘাটিত সেই মৃদু-মন্দ কল্পতরু সমীরণ-ধারা আজও সমান তালে তাল মিলিয়ে তাঁর সন্তান-সন্ততিদের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে চলেছে; শুধু মনুষ্যজীবন-খেয়ায় পাল তুলে দেওয়ার অপেক্ষায়।