আপনার মনে ধর্মভাব জাগ্রত হবে। কর্মপ্রার্থীরা কর্মের সুযোগ পাবেন। কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতির সূচনা হবে। অর্থ নিয়ে ... বিশদ
অথচ সেই রসে মজেই এই সেদিনও ‘বিজেপি হটাও দেশ বাঁচাও’ স্লোগান তোলা বাংলা মায়ের উজ্জ্বল সন্তান বেমালুম বলে বসছেন, রাজ্যটাকে এবার মোদিজির হাতে তুলে দিতে হবে! শিল্প গড়া নয়, বেকারদের চাকরি দেওয়া নয়, শিক্ষার সংস্কার নয়, গোটা রাজ্যটাকে অমুকের হাতে তুলে দাও। কী ভয়ঙ্কর সংকল্প! বাংলার মাটি যেন জয়নগরের মোয়া। তাঁকে বাহবা দিয়ে সবিনয়ে বলি, নতুন বছরে আপনি কি মিরজাফরের চরিত্রটারই ষোলোআনা আত্মীকরণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাবেন? নিজের ও পরিবারের স্বার্থ রক্ষা করতে বাংলার মাটি আজ আপনার কাছে বেচাকেনার পণ্য, অন্যের হাতে তুলে দেওয়ার বস্তু ছাড়া আর কিছুই নয়। আপনার জীবনের এখন একটাই মিশন এই রাজ্যটাকে একটা অবাঙালি প্রধান দলের হাতে তুলে দেওয়া। মনীষীদের অসম্মান দেখেও চুপ করে থাকা। কিন্তু বাংলার বুকে এভাবে ভিনদেশি সংস্কৃতির আমদানি রাজ্যের মানুষ কোন চোখে দেখছে, তাতে আপনার আজ কিছু যায় আসে না। ইতিহাসে পড়া বর্গির আক্রমণের তুলনায় এই আগ্রাসন তো কোনও অংশে কম নয়। তাই চারদিকে আজ একটা আশ্চর্য বিপন্নতার ছবি। বিভাজনের বিষ নিঃশ্বাস। দেখে মনে হচ্ছে, গত ৫০ বছরে বাংলা ও বাঙালি এত বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েনি কখনও।
নতুন বছর শুরুর কয়েক মাসের মধ্যে বিধানসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই বাঙালি ও অবাঙালির লড়াই আরও তীব্র হতে চলেছে। কাদের হাতে থাকবে রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ? সেনগুপ্ত, রায়, মুখোপাধ্যায়, ভট্টাচার্য, বন্দ্যোপাধ্যায়রা ক্রমে ব্রাত্য হয়ে নাড্ডা, মোদি, শাহ, মেননদের মতো ধুরন্ধর ‘কারিয়া কর্তা’দের আড়ালে হারিয়ে যাবে কি না, দলবদলুরা আমল না দিলেও নিঃসন্দেহে এটাই এই মুহূর্তে লাখ টাকার প্রশ্ন। বাংলার প্রতিটি নাগরিককে ভেবেচিন্তে সতর্কতার সঙ্গে সেই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে রায় দিতে হবে। একদিকে রবীন্দ্রনাথ-অমর্ত্য সেনকে মুছে দেওয়ায় প্রয়াসী হওয়া এক ভয়ঙ্কর দল। তাদের বিভেদ বিভাজনের বিষাক্ত রাজনীতি। আর অন্যদিকে শান্তিপ্রিয়, রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা, খুনসুটি করা, অ্যাকাডেমিতে নাটক দেখা মাছ-ভাত খাওয়া আটপৌরে সাদাসিধে বাঙালি। কোনটা শেষ পর্যন্ত থাকবে? এই বাংলার সামাজিক পরম্পরাটাই কি শেষে বিকিয়ে যাবে? এই প্রশ্নকে সামনে রেখেই নির্ণায়ক নির্বাচনের মুখোমুখি হতে চলেছেন বাংলার মানুষ। এই রাজ্যটা কতটা বাঙালির থাকবে, আমাদের মনীষীদের সম্মান, কৃষ্টি-সংস্কৃতি কতটা অক্ষুণ্ণ থাকবে, হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক বিষ গলা পর্যন্ত চড়ে গেলে আমরা আমাদের সত্তাকে বিসর্জন দিতে বাধ্য হব কি না, তার উপরই চূড়ান্ত গণভোট এবারের নির্বাচন। তাই এই বদলে যাওয়া পটভূমিতে সমগ্র বাঙালি জাতির দায়িত্ব এক অর্থে বিরাট। সামান্য ভুল করলে আমাদের গর্ব ও ঐতিহ্যের সংস্কৃতি চাপা পড়ে যাবে। বাংলার মাটি, বাংলার জল যুগ যুগ ধরে যা আমাদের গর্ব, সব কলুষিত হয়ে যাবে বহিরাগত হিন্দিভাষীদের দাপটে। আক্রমণের মুখে পড়বে বিশ্বকবির যত্নে লালিত বাংলা ভাষা। বিস্মৃত হয়ে যাবে বঙ্কিমচন্দ্র থেকে আমাদের তাবৎ মনীষীর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। চারদিকে শুধু পানের পিক আর হিন্দি কথার তোড়ে ভেসে যাবে বাঙালির যা আপন, বাঙালির যা নিজস্ব সেই সব সুকুমার সম্ভাবনা ও প্রবৃত্তি। তখন সহ্য হবে তো!
যাঁদের উচ্চারণে এখনও ‘ন’ এবং ‘ণ’ এর পার্থক্য ধরা যায় না তাঁরাই পক্ষকাল অন্তর বাংলায় প্রমোদ ভ্রমণে এসে মঞ্চ আলো করে সোনার বাংলা গড়ার ডাক দিচ্ছেন। যে দলকে আগাপাছতলা দুর্নীতিতে নিমজ্জিত বলে তোপ দাগছেন, নারদ, সারদার টাকা খাওয়ার সতেরো কাহন বর্ণনা করছেন, সেই দলেরই দু’দশকের বেশি ঘর করা কেষ্টবিষ্টুরাই মঞ্চ আলো করে বসে থাকছেন, এই দ্বিচারিতার অর্থ কী? তাহলে দুর্নীতিতে মদত দিচ্ছে কে? ব্ল্যাকমেল করে অসৎ নেতাদের প্রশ্রয় দেওয়া তো আসলে দুর্নীতিই—এটা প্রকারান্তরে চোখে ধুলো দিয়ে বাংলার মানুষের সঙ্গে চোর-পুলিস খেলা নয় কি? কে না জানে, দু’শো বছর আগেও দখলদাররা বিশ্বাসঘাতক ও বেইমানদের আশ্রয় করেই অঙ্গরাজ্য থেকে শুরু করে পাশের দেশ দখলে মন দিত। এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়াতে না পারলে রাজ্যটার সর্বনাশ হয়ে যাবে।
মোদি-অমিত শাহরা বলছেন, একবার ক্ষমতা পেলেই ‘সোনার বাংলা’ গড়ে দেবেন। খুব ভালো কথা। তাহলে টানা ছ’বছর এককভাবে দিল্লি শাসন করেও কেন সোনার ভারত গড়ার চেষ্টা হল না? কেন মোদিজির প্রতিশ্রুতি মতো বেকার যুবক-যুবতীদের চাকরির ব্যবস্থা হল না? হাজার হাজার কৃষক দিল্লির প্রবল ঠান্ডায় খোলা আকাশের নীচে এক মাসেরও উপর বিনিদ্র রাত কাটাচ্ছেন, সোনার দেশে এ জিনিস ভাবা যায়! নতুন চাকরির ব্যবস্থা হওয়া তো দূরে থাক, যাঁদের কাজ ছিল তাঁরাও তা হারিয়ে হতাশ চোখে আকাশের দিকে চেয়ে বসে আছেন। ক্ষমতায় আসার পর নোট বাতিল করে কালো টাকার মূলে আঘাত করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছিল। অথচ কালো টাকার রমরমা তো কমেনি, উল্টে তার দাপট আজ আরও বেড়ে গিয়েছে! এক্ষেত্রেও ভিলেন সেই কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ করে ছাপানো নতুন ২০০০ টাকার নোট। অদূরদর্শী জিএসটি নীতি দেশের ছোটবড় ব্যবসায়ীদের কোমর ভেঙে দিয়েছে। রেল সহ একাধিক কেন্দ্রীয় সরকারি দপ্তরের কর্মীদের চাকরি ঘিরে অনিশ্চয়তার ছায়া। তাহলে সোনার ভারতে মানুষের প্রাপ্তির ঝুলিতে আর কী কী আছে? কই কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী—কেউ তো বলছেন না মোদিজি ছ’বছরে সোনার ভারত গড়ে দিয়েছেন! তাহলে ভোটের আগে ‘সোনার বাংলা’ গড়ার নামে হঠাৎ এই মিথ্যাচার কেন? বাইরে থেকে এসে স্বপ্ন দেখাতে আর বিভ্রান্তি ছড়িয়ে মানুষকে নেশার ঘোরে ডুবিয়ে দিতে আপত্তি কোথায়—বিশেষ করে যখন ক্ষমতা থেকে অর্থবল কোনও কিছুরই অভাব তাঁদের নেই। বাংলায় ঠিক সেই কাজটাই অত্যন্ত সন্তর্পণে করছে গেরুয়া বাহিনী ও কিছু দলত্যাগী স্বার্থপর নেতা। কিন্তু একবার সর্বনাশ হয়ে গেলে আর তো সংশোধনের উপায় নেই।
গেরুয়া শক্তি তার প্রভাব বিস্তারে আজ কতটা মরিয়া তার প্রমাণ দু’দিন আগের একটা ছোট্ট ঘটনা। শাহিনবাগে বিক্ষোভকারীদের উপর গত বছর ফেব্রুয়ারিতে আচমকা গুলি চালিয়ে গ্রেপ্তার হওয়া কপিল গুজ্জরকে পর্যন্ত কিছু না জেনেই দলে টেনে নেয় বিজেপির গাজিয়াবাদ শাখা। ওই খবর ছড়িয়ে পড়তেই ব্যাপক আলোড়ন শুরু হয়ে যায়। চাপের মুখে দিল্লির নির্দেশে দল থেকে কপিলকে বহিষ্কার করা হয়। দলে নেওয়া আর তাড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে ব্যবধান মাত্র কয়েক ঘণ্টার। সেই সার্কাস থেকে বাদ নেই বাংলাও। আসানসোলের এক নেতাকে নিয়ে তো কম নাটক হল না। আরও নাটক বাকি আছে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে, বঙ্গ বিজেপির এখন একটাই কাজ—তৃণমূলের মধ্যে সযত্নে মিরজাফর খুঁজে বার করা। আমাদের দেশে ভোট এলেই ভেক ধরার লোকেরও অভাব হয় না। টানা দশ বছর শাসন ক্ষমতা ভোগ করার পর তৃণমূলেরও একটি অংশ আজ সেই দোষে দুষ্ট। তাই শাসকদলের নেতা, মন্ত্রী কেনার দুশো আয়োজন।
অনেকেই তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে গিয়ে বলছেন, অপমানিত হয়েই দল ছেড়েছি। তাঁদের সম্মান দিয়ে প্রশ্ন করি, বিজেপিতে বুঝি খুব গণতান্ত্রিক হাওয়া! শরিকদের অধিকার সুরক্ষিত। যদি তাই হয়, তাহলে গত ছ’বছরে ১৯টি শরিক দল নরেন্দ্র মোদির সঙ্গ ছেড়েছে কেন? এত সুসময়। দেশটাকে সোনায় মুড়ে ফেলার এমন বর্ণাঢ্য আয়োজন। তাহলে একের পর এক শরিক এনডিএ ছাড়ল কেন? শিবসেনা, অকালি দল, রাজস্থানের আরএলপি তালিকায় অনেকেই! শেষ খবর অনুযায়ী, জোর টানাপোড়েন শুরু হয়েছে নীতীশ কুমারের সংযুক্ত জনতা দলের সঙ্গেও। অথচ নীতীশ কুমারকে শিখণ্ডী করেই মোদি-অমিত শাহের বিজেপি বিহার দখল সম্পূর্ণ করেছিল। এখন প্রয়োজন ফুরিয়েছে। তাই এবার নীতীশ কুমারকে দুর্বল করার পালা। অরুণাচলে নীতীশের দল ভাঙিয়েই ছয় বিধায়ককে গেরুয়া শিবিরে টেনে নিয়েছে গেরুয়া বাহিনী। সামনে চলে এসেছে তার ভয়ঙ্কর চেহারা।
অতঃপর সেই অনিবার্য প্রশ্ন, বাংলার কী হবে? বাংলার মানুষকেই আপন শক্তি ও আত্মবিশ্বাসের জোরে নিজের ভাগ্য নিরূপণ করতে হবে। এরাজ্যের ভাগ্যাকাশে দুর্যোগ বড় কম আসেনি। যাবতীয় বিপর্যয় সামলে বাঙালির জয়যাত্রা অক্ষুণ্ণ থেকেছে। ঘুরে দাঁড়িয়েছে গোটা জাতি। এবারও ভোটযন্ত্রে সঠিক বোতামটা টিপে যাবতীয় চক্রান্ত, অপচেষ্টা বানচাল করতে হবে। বাংলার আপামর জনগণ সেই অগ্নিপরীক্ষার জন্যই মনে মনে প্রস্তুত হতে শুরু করেছে। মেঘ কেটে যাবেই।