ছিল রুমাল, হয়ে গেল বিড়াল। অনেকটা সেরকমই। ছিল ভোটার, ভোটদানের পর হয়ে গেল ‘ডি ভোটার’। অর্থাৎ ডাউটফুল ভোটার। অসমে ভোট পর্ব মিটতেই এমন বহু হিন্দু বাঙালি আশ্চর্যজনকভাবে ‘ডি’ ভোটার হয়ে গেলেন! আধার কার্ড, ভোটার কার্ড থাকা সত্ত্বেও তাঁরা ‘সন্দেহভাজন’ ভোটারের তালিকাভুক্ত! অথচ ভোটের আগে নাগরিকত্ব সুনিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতির গাজর ঝুলিয়ে বিজেপি’র সর্বভারতীয় নেতারা এঁদের কাছেই ভোটভিক্ষা চেয়েছিলেন। কাজ হাসিলের পর ফের স্বমূর্তি ধরেছেন! দেশে বিজেপি’র সরকার। রাজ্যে একই দলের অর্থাৎ ডবল ইঞ্জিনের সরকার থাকলে তড়িদ্গতিতে নাকি সব কাজ হবে। দাবি এমনটাই। তাতে বিশ্বাস রেখে সেই পাতা ফাঁদে পা দিয়ে অসমের অনেকেই এখন হা-হুতাশ করছেন। ইঞ্জিনের গতি এতই দুরন্ত যে ভোট মিটতেই এতটুকু দেরি না করে অসমের বহু বাঙালিকে ‘ডি’ নোটিস ধরিয়ে দিচ্ছে সেখানকার প্রশাসন। যার অর্থ, আধার কার্ড, ভোটার কার্ড থাকলেও নাগরিকত্ব প্রমাণের তথ্যে সন্তুষ্ট না হলেই শরণার্থী বাঙালিদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হতে পারে, বা পাঠানো হতে পারে ডিটেনশন ক্যাম্পে। বিজেপিকে ভরসা করে এমন পরিণতি হবে তা কি কেউ স্বপ্নেও ভেবেছিলেন? ভোট মিটতেই তাঁদের উপর নেমে এসেছে বন্দিত্বের খাঁড়া। এই অসমেই পাঁচ বছর আগে ক্ষমতা দখলের জন্য যে তাসটি বিজেপি বের করেছিল তা ছিল রাষ্ট্রীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি)। তা কাজেও লেগেছিল। ভোটে বিজেপির কখনও অস্ত্র হয় এনআরসি, কখনওবা সিএএ। শুধু অসম কেন, এই বাংলাতেও মতুয়া, রাজবংশী, নমঃশূদ্রদের বিপুল ভোট কব্জা করতে সিএএ’র খুঁড়োর কলটি ঝুলিয়ে দিয়েছে পদ্মশিবির। নাগরিকত্বকে ইস্যু করে বলা হচ্ছে, বিজেপি বাংলার ক্ষমতায় এলেই নাকি নাগরিকত্ব প্রদানের কাজ দ্রুত শুরু হবে। দ্বিচারিতাকে যে কোন উচ্চ পর্যায়ে আর্টে পৌঁছে দেওয়া যায় তারই উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে অসম। ভোট মিটতেই সেখানে মুখোশের আড়াল থেকে বিজেপি’র অমানবিক আসল মুখটি বেরিয়ে পড়েছে। ডি নোটিস হাতে পেয়ে অসমের বহু বাঙালি হাড়ে হাড়ে বুঝছেন মোদি-শাহরা তাঁদের সঙ্গে কী নিষ্ঠুর প্রহসনই না করেছেন! ৬ এপ্রিল অসমে তৃতীয় দফায় ভোট মিটেছে। আর ৮ এপ্রিল বহু বাঙালিকে ডাউটফুল ভোটারের তকমা সাঁটতে উদ্যোগী হয়েছে প্রশাসন। ডবল ইঞ্জিনের এমন ভয়ঙ্কর মহিমাই দেখল সেখানকার অনেক হিন্দু পরিবার। প্রশ্ন হল, বিজেপি’র উপর ভরসা রাখার এই পরিণাম? নাগরিকত্ব হারানোর আতঙ্কে এখন কাঁটা হয়ে আছেন সেখানকার শরণার্থীরা। তাই অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগছে, এরপরও কি অসমকে দেখে শিক্ষা নেবেন না পড়শিরাজ্য বাংলার মানুষ? তাঁরা কি চাইবেন নিজ ভূমে পরবাসী হতে?
এনআরসি’র তাসের জাদু বাংলায় অচল বুঝেই বিজেপি’র ভোটকুশলী নেতারা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনকে (সিএএ) সুযোগমতো হাতিয়ার করেছেন। সিএএ’র ভিত্তিতে সরকারিভাবে নাগরিকত্ব পাওয়ার আশায় এ রাজ্যেও বহু উদ্বাস্তু পরিবার গত লোকসভা ভোটে পদ্ম চিহ্নে ভোট দিয়েছিলেন। তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। রাধাও নাচেনি, তেলও পোড়েনি। এবার আবার সেই একই চালাকির আশ্রয়! একই অস্ত্র বারবার ব্যবহারে ভোঁতা হয়। তাই উদ্বাস্তুদের খুশি করতে এবার নাগরিকত্বের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বাড়তি কিছু সংযোজনও ঘটেছে। মতুয়া দলপতিদের জন্য মাসে তিন হাজার টাকা ভাতা, সরকারে এলে ঠাকুরনগর রেল স্টেশনের নাম বদলে শ্রীধাম ঠাকুরনগর করা—শাহদের মুখে এমন নানা প্রতিশ্রুতি। কিন্তু ভোট মিটতেই অসমের মানুষ বিজেপি’র যে খেলা দেখলেন, তারপরও কি বাংলায় তাদের উপর ভরসা রাখতে পারবেন বঙ্গবাসী?
দেশে হাজারও সমস্যা থাকলেও কে নাগরিক আর কে নয়—তা নিয়েই বিজেপি’র যত মাথাব্যথা। তবে তাদের অবাঙালি ভোটকুশলীরা বঙ্গপ্রেমের প্রমাণ রাখতে কোনও খামতি রাখছেন না। বাংলা নববর্ষে বাঙালিকে বাংলা ভাষাতেই শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর মুখে ইদানীং অনেক বাংলা শব্দের ব্যবহার লক্ষ করা যাচ্ছে। বাঙালি মন ছোঁয়ার এমন মরিয়া প্রয়াস অতীতে কোনওদিন দেখা গেছে? অথচ বাংলার ভোটে মেরুকরণের রাজনীতির আমদানি করেছে কট্টর হিন্দুত্ববাদী এই দলটি। ঘটাচ্ছে নানা বিভাজন। আগে ভাবা হচ্ছিল সিএএ আইনে বোধহয় শুধুমাত্র মুসলিমরা বঞ্চিত হবেন। অসম দেখিয়ে দিল বিজেপি’র দৌলতে এনআরসি’র খাঁড়ায় সেখানকার শরণার্থী হিন্দু পরিবারও সুখে নেই। বাংলার শিক্ষা সংস্কৃতি সাহিত্যে সবসময়ে হিন্দু-মুসলিম বা অন্য সম্প্রদায়ের ঐক্যই গুরুত্ব পেয়ে এসেছে। সেসব ভুলে বাঙালি কি এবার মতলববাজদের বিভেদ বিভাজনের নীতিকে গ্রহণ করবে? নাকি সর্বধর্ম সমন্বয়ের ঐতিহ্যকে আঁকড়ে থেকে যেকোনও ভাঁওতাবাজির উচিত জবাব দেবে? যে প্রতারণা বিশ্বাসঘাতকতা ইতিমধ্যেই লক্ষ লক্ষ অসমবাসী দেখে ফেললেন নিশ্চয়ই বাংলায় তা ঘটুক চাইবেন না কোনও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। গেরুয়াবাহিনীর ধাপ্পাবাজিতে দুর্গতির অন্ত নেই অসমে। হিন্দু বাঙালিরাও কি সেখানে নিরাপদ? এসব ভেবেই বঙ্গবাসীকে ঠিক করতে হবে তাঁরা কী চান।