অতিরিক্ত পরিশ্রমে শারীরিক ক্লান্তি, প্রিয়জনের বিপথগামিতায় অশান্তি ও মানহানির আশঙ্কা, সাংসারিক ক্ষেত্রে মতানৈক্য এড়িয়ে চলা ... বিশদ
পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেওয়ার কথা মোদিজি ভাববেন ভোটে জিতলেই। কতখানি নির্লজ্জ হলে দেশের প্রধানমন্ত্রী ভোটের বিনিময়ে মানুষের বাঁচা-মরার হিসাব কষতে পারেন! প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর সারথি সব প্রশাসনিক কাজকর্ম ডকে তুলে পশ্চিমবঙ্গে থানা গাড়ার ফলে গত দু’মাসে একটিও ‘কোভিড টাস্ক ফোর্সের’ বৈঠক সম্ভব হয়নি। অথচ সেই ‘কোভিড টাস্ক ফোর্স’ই উপযাচক হয়ে নিদান দিল ভ্যাকসিন নেওয়ার পরে নাকি কোভিড আরও জাঁকিয়ে বসছে! আইসিএমআর-এর এক কর্তা এককাঠি ওপরে উঠে বললেন অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবায় যুক্তরা ভ্যাকসিন পেলেই যথেষ্ট। বাকিদের প্রয়োজন নেই ভ্যাকসিনের। ভ্যাকসিনের আকালকে ধামাচাপা দিতেই কি মোদিজি এবং তাঁর নিমক খাওয়া সরকারি পদাধিকারীদের এই ধরনের মিথ্যে গোয়েবেলসীয় প্রচার? ‘হু’ বারেবারে বলছে বিশ্বে একজনও টিকাকরণে বঞ্চিত হলে কোভিড বিতাড়নের স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে!
কোভিড, হঠাৎ কেন বেলাগাম
বলা হচ্ছে, ১৬টি রাজ্যে কোভিড তাণ্ডব চালালেও ভোটপর্ব চলেছে মাত্র ৫টি রাজ্যে। বাকি ১১টি সুশীল নিস্তরঙ্গ রাজ্যে তাহলে কোভিড কেন এতটা বিধ্বংসী? উত্তরটা সহজ। হেলদোলহীন অসচেতন জনতার কিলবিলে দলাপাকানো জমায়েত। নির্বাচনের তামাশায় ৫টি রাজ্যে ক্ষমতার অলিন্দে বিরাজমান মাতব্বররাই ইন্ধন জুগিয়েছে মাস্ক মুখ থেকে ঝেড়ে ফেলে, শারীরিক দূরত্ববিধিকে যমের দুয়ারে পাঠিয়ে কোভিড স্বাস্থ্যবিধি তথা স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধিকে জলাঞ্জলি দিয়ে ভোট উপলক্ষে দলে দলে তাঁদের মতো মহাজ্ঞানীদের শরণাগত হওয়ার। লকডাউন, মাস্ক ও সুচারু স্বাস্থ্যবিধি দুর্দমনীয় কোভিডকে খানিকটা হলেও বশে আনতে পেরেছিল। কিন্তু দেশহিতৈষী নেতা-নেত্রীর অবিমৃশ্যকর বেপরোয়া আচরণে নভেল করোনা সুযোগ পেল তেড়েফুঁড়ে ফিরে আসার। জনমানসে সঙ্গোপনে চারিয়ে গেল, কোভিড যতটা বলা হচ্ছে ততটা ভয়াবহ কখনওই নয়। সুতরাং মাস্ক বা শারীরিক দূরত্ববিধি অপ্রয়োজনীয়। কিছু ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো পণ্ডিতের অভিমানী আঁতলামি। সন্ধ্যাবেলায় টিভির গল্প-দাদুর আসর আলো করে বসা বিশেষজ্ঞদের কারও কারও মুখে দুদিন আগেও মাস্কের দেখা মেলেনি। আজ মুখে মাস্ক সেঁটে তাঁরাই মড়াকান্না কাঁদছেন। যে চিকিৎসকরা বিরামহীন জ্ঞান বিতরণ করছেন গণমাধ্যমে তাঁদেরও অধিকাংশের মুখ থেকে মাস্ক পলাতক। সচেতনতার কী পাঠ তাঁরা জনগণকে দেবেন বা দিলেন?
শীতকালে জানলা দরজা বন্ধ ছিল। নিরন্তর সাবানে ধোওয়া-কাচাও ছিল ঝামেলার। একটু উষ্ণতার জন্য দূরত্ববিধির বজ্র আঁটুনিও কিঞ্চিৎ শিথিল হয়েছিল। মিঠেকড়া রোদে চিড়িয়াখানা বা ইতিউতি বনভোজনেও ভিড় কিছু কম হচ্ছিল না। তথাপি কোভিড মাথাচাড়া দেয়নি। কারণ বড়দিনে লাঠিহাতে পুলিস পার্ক-স্ট্রিটের উদ্দাম জনতাকেও মাস্ক পরতে বাধ্য করেছিল। তার আগে হাইকোর্টের কড়া দাওয়াইতে ম্যাড়মেড়ে উৎসবে করোনা দাঁত ফোটাতে পারেনি। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বা বিরোধী বা সরকার সে যাত্রায়ও ঘোলা জলে মাছ ধরার চেষ্টা চালিয়েছে, কিন্তু স্থিতধী মানুষ ভয়ে বা ভক্তিতে বাড়াবাড়ি কিছু করে ফেলেনি, সংযমের পরিচয় দিয়েছে আদ্যন্ত। মাস্ক, দূরত্ববিধি আর ভিড় এড়ানোতেই সার্স কোভ-টুর ‘বেসিক রিপ্রোডাকশন নাম্বার’ বা ‘আরনট’ বাড়তে পারেনি।
ভোটের দিন ঘোষণা হওয়ার পরেই সব আগল গেল টুটে। মাস্ক, শারীরিক দূরত্ববিধি চুলোয় গেল। জনগণমন-অধিনায়ক নেতানেত্রীরাই স্পষ্টত এই আত্মঘাতী আচরণে ইন্ধন জোগালেন। ফলে নভেল করোনা অসহায়-অপ্রস্তুত-দুর্বল-অরক্ষিত মানুষকে বিনা বাধায় খপাখপ মুখে পুরতে লাগল। লাফিয়ে বাড়ল ‘আরনট’। দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল কোভিড। যে রাজ্যগুলোতে ভোট ছিল না সেখানেও মানুষ ভাবতে শুরু করল কোভিডের মৃত্যঘণ্টা বেজেছে। ফলে তারাও কোভিড স্বাস্থ্যবিধিকে ডকে তুলে নৃত্য শুরু করল। ফিরে এল উৎসব-অনুষ্ঠান-হই-হুল্লোড়ের বেলাগাম ভিড়। ‘আরনট’ ১.১১ থেকে এক সপ্তাহে লাফিয়ে বাড়ল ১.১৭, আগামীতে তা বেড়ে ২ বা তিনে পৌঁছনও অস্বাভাবিক নয়। ‘আরনট’ যত বাড়বে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঘটনা তত বাড়বে, গগনচুম্বী হবে অক্সিজেনের চাহিদা, লাফিয়ে বাড়বে মৃত্যুহার।
স্ট্রেইন, মিউটেশনের গালগল্প
নভেল করোনার মিউটেশন তার নিজের টিকে থাকার পক্ষেই বড় বেমানান। অশিক্ষিতের মতো ডবল বা ট্রিপল মিউট্যান্টের অসাড় গল্প আসলে হাড়জিরজিরে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা থেকে নজর ঘোরানোর ফিকির। ২৯৭২৭টি নিওক্লিওটাইডসের ঢাউস নভেল করোনার পক্ষে মিউটেশন সবসময়ই বিড়ম্বনার, দু-একটা মিউটেশন সার্স কোভ-টু নিজেই ‘প্রুফ রিডিং’এর মাধ্যমে শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করে। ভাবুন না মিউটেশনের দৌলতে আপনার একটি হাত বা পা যদি খসে যায় তা কি আপনার বেঁচে থাকাকে খুব একটা কুসুমাস্তীর্ণ করবে? তাই ব্রিটিশ স্ট্রেইন বি.১.১.৭ বা বঙ্গ স্ট্রেইন বি.১.৬১৭ বা আফ্রিকান পি-ওয়ান স্ট্রেইন নিয়ে অযথা আশঙ্কিত/আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। বরঞ্চ আরটি-পিসিআর টেস্টে কোভিড হয়েছে কি না জানার সময়ই জেনে নেওয়া উচিত কোন বিশেষ স্ট্রেইনে রোগী আক্রান্ত। কোভিড হয়েছে কি না এবং কোন স্ট্রেইনে রোগী আক্রান্ত ‘ইলিউমিনা নোভাসেক-৬০০০’ বা ‘নোভাসিক’ আরটিপিসিআরে খুব সহজে একবারেই তা চটজলদি জানা সম্ভব। ভারতে ‘সিএসআইআর’ বা ‘আইআইএসসি’-তে এরকম আরটিপিসিআর মেশিন বহুকাল থেকেই রয়েছে। আপৎকালীন ভিত্তিতে এরকম আরও বেশ কিছু মেশিন একলপ্তে কেনা যেতেই পারে। এই ধরনের মেশিন বাজারে সহজলভ্যও, এক একটি মেশিনে দৈনিক ৬০০০টি পরীক্ষা হেসে-খেলে সম্ভব। কোন ভ্যাকসিন কতটা কার্যকর বা ভ্যাকসিনের ‘নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডিকে’ কোন স্ট্রেইন কতটা ধোঁকা দিতে পারছে—সেটা জানার জন্যও এই ধরনের পরীক্ষা জরুরি। কোভিডের গতিপ্রকৃতির নিখুঁত দিশাও তাতে যেমন মিলবে তেমনি কোথায় কতটা ভ্যাকসিনের প্রয়োজন তারও সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি মিলবে।
ভ্যাকসিন, জরুরি তথ্য
যেখানে কোভিড প্রলয় নাচন নাচছে সেখানে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় শুরু করা উচিত টিকাকরণ। প্রয়োজন হলে যেখানে কোভিড ততটা ভয়ঙ্কর নয়, সেখান থেকে ভ্যাকসিন উড়িয়ে আনতে হবে। কোভিড অধ্যুষিত অঞ্চলে তাঁবু খাটিয়ে, প্রয়োজনে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভ্যাকসিন দিতে হবে। ভ্যাকসিনের আকালে দুটোর পরিবর্তে অন্তত একটা ডোজ সবাইকে দিলেও কিছুটা সুরক্ষা মিলবে। পদ্ধতিটি ‘রিং ভ্যাক্সিনেশন’ নামে পরিচিত। নতুন জুতোয় যেমন ফোস্কা পড়ে তেমনি সব ভ্যাকসিনেই কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক। যেমন জ্বর/মাথাব্যথা/হাতে ব্যথা প্রভৃতি। কোনও কোনও ক্ষেত্রে অ্যালার্জির বাড়াবাড়িও হতে পারে। মহিলা ও কমবয়সিরা ভ্যাকসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় একটু বেশিই কাতর হয়ে পড়ছেন। মহিলাদের রোগ প্রতিরোধী জিনগুলো ‘এক্স ক্রোমোজোমে’ গেড়ে বসে থাকার কারণেই তাঁরা ভ্যাকসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় একটু বেশিই পুরুষদের তুলনায় কাবু হয়ে পড়ছেন। ভ্যাকসিনে কোনও ছুতমার্গ থাকা উচিত নয়, যে ভ্যাকসিন হাতের কাছে জুটছে তাই নিতে হবে। তাতে ‘আরনট’কে দমানো যাবে, হাসপাতাল যেতে হবে না। অক্সিজেনের প্রয়োজন কম পড়বে। কোনও ওষুধ বা ভ্যাকসিনই কোভিডে অব্যর্থ নয়, তাই ট্র্যাক-টেস্ট-ভ্যাকসিন এবং মাস্ক ও দূরত্ববিধির ওপর জোর দিলেই কোভিডের পরাক্রম কমবে। সর্বোপরি সর্বশক্তিতে প্রতিরোধ করতে হবে ভোটের বিজয় মিছিল।