অতিরিক্ত পরিশ্রমে শারীরিক ক্লান্তি, প্রিয়জনের বিপথগামিতায় অশান্তি ও মানহানির আশঙ্কা, সাংসারিক ক্ষেত্রে মতানৈক্য এড়িয়ে চলা ... বিশদ
১২ ফেব্রুয়ারি। বাংলায় প্রচারে এসে অমিত শাহ জোরদার খেলেন ‘রামকার্ড’। তিনি বলেন, জোরে বলুন ‘জয় শ্রীরাম’। জোরে ধ্বনি তুলুন সবাই। সবাই ‘রামনাম’ উচ্চারণ করে গর্ববোধ করেন। শুধু মমতাজির আপত্তি। কারণ, তিনি তোষণের রাজনীতি করেন। তবে ভোট শেষ হতে হতে, মমতা দিদি, আপনিও জয় শ্রীরাম স্লোগান তুলবেন। কটাক্ষ করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। পরিষ্কার হয় যে, নন্দীগ্রামে নোংরামি কোনও অর্বাচীনের ভুলচুক নয়, সংগঠিত অপরাধ, যার পিছনে পার্টির উচ্চ পর্যায়ের ইন্ধন ছিল।
অমিত শাহের প্রশ্ন, বাংলায় দুর্গাপুজো করতে হলে কোর্টে যেতে হবে? সরস্বতী পুজো করতে গেলে শিক্ষককে মারা যেতে হবে? সতর্ক করে দেওয়ার সুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, মমতা দিদি, এটা হিন্দুস্থান। এখানে দুর্গাপুজো, সরস্বতীপুজো, রামনবমী সবই হবে। ‘জয় শ্রীরাম’ বলার জন্য আমাদের কর্মীদের খুন করা হচ্ছে! ‘জয় শ্রীরাম’ এখানে বলব না তো কি পাকিস্তানে গিয়ে বলব?
মানুষ দেখুক, সুড়সুড়ি, উস্কানি কী লেভেলের
হতে পারে!
এবারই নেতাজি জয়ন্তীতে কলকাতায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মঞ্চে উপবিষ্ট প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তাঁরই সামনে ভাষণ দিতে ওঠেন মুখ্যমন্ত্রী। অমনি দর্শকদের ভিতর থেকে উঠল ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান! গেরুয়া শিবিরের এই অসৌজন্যে শুধু মমতার অপমান হয়নি, অপমানিত হয়েছিল বাংলার সংস্কৃতি। অপমান করা হয়েছিল নেতাজি সুভাষচন্দ্রকে। সবচেয়ে বড় অপমান যদি কারও হয়ে থাকে তা করা হয়েছে ভগবান শ্রীরামচন্দ্রকেই।
এটাও কাকতালীয় কি না, সেই প্রশ্ন রেখে গিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সেদিনের বিস্ময়কর নীরবতা। তাঁরই সামনে, আমন্ত্রিত স্থানীয় মুখ্যমন্ত্রীকে অপমানের তিনি প্রতিবাদ এবং নিন্দার কোনওটাই করেননি। নীরব ছিলেন নেতাজি এবং রামচন্দ্রের অপমান সম্পর্কেও। বিজেপির আরও নোংরামি দেখেছিল দেশ। হরিয়ানার স্বাস্থ্যমন্ত্রী অনিল ভিজ ট্যুইট করে মন্তব্য করেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামনে ‘জয় শ্রীরাম’ বলা মানে ষাঁড়কে লাল কাপড় দেখানো। এজন্যই তিনি ভিক্টোরিয়ায় ভাষণ বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
মুখ্যমন্ত্রীকে আরও ছোট করতে বিজেপি গত জানুয়ারিতে ‘জয় শ্রীরাম’ লেখা এক লক্ষ
পোস্টকার্ড মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির ঠিকানায় পাঠানোর কর্মসূচি (পড়ুন নষ্টামি) নিয়েছিল।
টার্গেট শুধু মুখ্যমন্ত্রী নয়। ১৪ এপ্রিল। বেলঘরিয়ায় প্রচারে বেরিয়েছিলেন তৃণমূল প্রার্থী তাপস রায়। বিজেপির লোকজন তাঁকে ঘিরেও ‘জয় শ্রীরাম’ আওয়াজ তুলেছিল। একই দিনে আরও একটি বিশ্রী ঘটনা ঘটল হুগলির চুঁচুড়ায়। ওই এলাকায় ভোট মিটে গিয়েছে। বুধবার ভোরে চকবাজার এলাকার মসজিদে যাচ্ছিলেন স্থানীয় মোয়াজ্জেম মহম্মদ সুফিউদ্দিন। তখন বাইক আরোহী তিন যুবক তাঁর পথ আটকায়। জবরদস্তি তাঁকে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিতে বলে। স্বভাবতই বিস্মিত মানুষটি প্রশ্ন তোলেন, ওই ‘রাজনৈতিক স্লোগান’ কেন দেবেন! অভিযোগ, তাতে খেপে গিয়ে যুবক তিনজন ওই ধর্মপ্রাণ মানুষটিকে রাস্তায় ফেলে প্রহার করে। অতঃপর ‘জয় শ্রীরাম’ বলে চিল্লাতে চিল্লাতে তারা বাইক ছুটিয়ে চম্পট দেয়। অনেকের স্মরণে থাকতে পারে, ২০১৯-এ অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনকে কুরুচিকর ভাষায় আক্রমণ করেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। অধ্যাপক সেনের অপরাধ ছিল, তিনি একটি অপ্রিয় সত্য তুলে ধরেছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিতে গিয়ে। ‘কলকাতা আফটার ইন্ডিপেন্ডেন্স: আ পার্সোনাল মেমোয়ার’ শীর্ষক বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি না-দেওয়ায় দেশের নানা প্রান্তে গণপিটুনির ঘটনা বাড়ছে। তার ফলেই অধ্যাপক সেন গেরুয়া শিবিরের রোষের মুখে পড়েন।
চুঁচুড়ার ঘটনার দায় যথারীতি অস্বীকার করেছে বিজেপি, উল্টে দুষেছে তৃণমূলকে। কিন্তু আপাতত এই ছ্যাবলামির পরিণামটা ভেবে দেখছে কি হালের রামভক্তরা? অসহিষ্ণুতার রাজনীতি করতে গিয়ে তারা নিজের ঘরেই আগুন লাগাবার ষড়যন্ত্র করছে না কি? মোদির পার্টি সিএএ-র পক্ষে প্রচার করছে। তারা বহির্ভারতের হিন্দুদেরও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ইজারা নিয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের। কিন্তু গেরুয়া জন্তুরা এটা কেন ভেবে দেখছে না: এটা তথ্যের যুগ, এটা সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ। চুঁচুড়ায় হোক আর চাঁদে হোক, ব্যাঙের সর্দি হলেও তার খবর বেডরুম অব্দি পৌঁছে যায় মুহূর্তের মধ্যে। চুঁচুড়ায় যে-কাণ্ড ঘটানো হল, পড়শি দেশেও তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে। তাতে সেখানকার সংখ্যালঘু হিন্দুরা নতুন করে বিপন্ন বোধ করতে পারেন। কারণ সেসব জায়গায় অন্য ধরনের মৌলবাদীরা মুখিয়ে আছে এই ধরনের দু’-একটা মন্দ দৃষ্টান্তকে হাতিয়ার করার জন্য।
এইভাবেই মোদির পার্টি অনেক দিন ধরে বুঝিয়ে দিচ্ছে, ভোটের রাজনীতিকে কোন নীচে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। শ্রীরামচন্দ্রকে তারা মোটেই ভগবান বা আরাধ্য মানে না, ভোটের রাজনীতির এক বিরাট অস্ত্র হিসেবেই দেখে। অযোধ্যায় করসেবা, রামশিলাপূজন, বাবরি মসজিদ ধ্বংস, দিকে দিকে রথযাত্রা, রামনবমী পালনের অজুহাতে অস্ত্র উঁচিয়ে সংখ্যা গরিষ্ঠতার আস্ফালন প্রভৃতির মধ্য দিয়ে তারা এই নীচতার লাগাতার সাক্ষ্য রেখে যাচ্ছে।
আমরা আসলে বুঝতে চাই না যে আমাদের হৃদয়ের প্রকোষ্ঠটা ভীষণ ছোট হয়ে এসেছে। তাই হৃদয়ে ভগবান বা আরাধ্যের জায়গা হচ্ছে না। তিনি হৃদয়ে ব্রাত্য হয়ে উঠেছেন। তাঁকে টেনে আনছি ফুটপাতে কিংবা রাস্তায় অথবা কুবাক্যের স্রোতে। বাঙালির রামভক্তি যদি কিছুমাত্র খাঁটি হয়ে থাকে তাহলে আমি নিশ্চিত, এই লাগাতার নোংরামির ধৃষ্টতার জন্য মোদির পার্টিকে রামধাক্কা একদিন দেবেই মানুষ।
দেবর্ষি নারদের মুখে রামচরিত কথা প্রথম শোনেন মহর্ষি বাল্মীকি। তারপর স্বয়ং ব্রহ্মা মহাকবি বাল্মীকিকে আশীর্বাদ করলেন এই বলে যে, ধরাতলে যতদিন গিরি-নদী প্রভৃতি বিরাজ করবে সংসারে ততদিন রামায়ণ প্রচারিত থাকবে। শ্রীরামচন্দ্রকে ‘নরচন্দ্রমাঃ’ আখ্যা দিয়েছিলেন নারদ। সত্যনিষ্ঠা, ত্যাগ, বৈরাগ্য, প্রেম, ধৈর্য, বীরত্ব ও ক্ষমাধর্মে এই সংসারে তিনি অদ্বিতীয় চরিত্র। তিনি সেই ভগবান যাঁকে আমাদের পরিবারের মধ্যেই খুঁজে পাই। রাজা হয়েও তিনি প্রজার দুঃখে কাতর হন, কাঁদেন। প্রিয় পত্নী এবং সন্তানদের প্রতি দায়িত্বপালনে ব্যর্থতার অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত হন, সমালোচিত হন। কিন্তু সত্যপালনের জন্য যে-কোনও ত্যাগস্বীকারে কুণ্ঠিত হন না তিনি। ভারতীয় সমাজে রামচন্দ্রকে এই কারণেই এতটা উঁচুতে স্থান দেওয়া হয়েছে।
সর্বার্থে ধার্মিক ও ধর্মনিরপেক্ষ মহাত্মা গান্ধীর সারাজীবনের সঙ্গী ছিল রামনাম। শ্রীরামকৃষ্ণের কুলদেবতা ছিলেন রঘুবীর। তাঁর পিতা ক্ষুদিরাম জমিদারের অত্যাচারে সর্বস্ব হারিয়ে কামারপুকুরে গিয়ে থিতু হয়েছিলেন শুধু এক রঘুবীর বিগ্রহকে আশ্রয় করে। পুত্র রামকৃষ্ণ ছিলেন ক্ষুদিরামের স্বপ্নেপাওয়া ধন, রঘুবীর স্বয়ং! ঠাকুর নিজেও ছিলেন রামলালার পরমভক্ত। নরেনকে তিনি রামমন্ত্রেই দীক্ষা দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ভারতবর্ষ যা চায় তা রামায়ণেই পেয়েছে। রামায়ণ যেভাবে বাহুবল, জিগীষা ও রাষ্ট্রগৌরবের ঊর্ধ্বে গৃহধর্মকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে, তা অভিভূত করেছে রবীন্দ্রনাথকে। তিনি বলেছেন, ‘ভারতবাসীর ঘরের লোক এত সত্য নহে, রাম লক্ষ্মণ সীতা তাহার পক্ষে যত সত্য।’
গীতায় বলা হয়েছে, ইন্দ্রিয়কে বশে এনে জ্ঞান, ভক্তি ও শান্তি লাভের জন্য ঈশ্বরচিন্তা আবশ্যক। ভাগবতে বলা হয়েছে, ভগবানের লীলামাহাত্ম্যকীর্তনে তিনজনের কল্যাণ হয়—প্রশ্নকর্তা, উত্তরদাতা এবং শ্রোতা। ভগবান যখন মানুষের রূপে এসে ধরা দেন তখন তাঁকে উপলব্ধি করা, তাঁকে ভালোবাসা অনেক সহজ হয়। তাই ভারতের কোটি কোটি ভক্তপ্রাণ রামচন্দ্রকেই আরাধ্য বেছে নিয়েছে। দীর্ঘকাল ধরে আসমুদ্রহিমাচলবাসী রামনাম কীর্তন ও শ্রবণ করে আনন্দলাভ করেছে। মহাভারত যদি ভারতবর্ষের মস্তিষ্ক হয় তো রামায়ণ তার হৃদয়। (এই প্রসঙ্গে বিশিষ্ট চিন্তাবিদ এস ওয়াজেদ আলির ‘ভারতবর্ষ’ গল্পটি প্রণিধানযোগ্য। যার অন্তিম অনুচ্ছেটি এইরকম: ‘মনে হল, আমি দিব্যচক্ষু পেয়েছি। প্রকৃত ভারতবর্ষের নিখুঁত একটি ছবি আমার চোখের সামনে ফুটে উঠল। সেই tradition সমানে চলেছে, কোথাও তার পরিবর্তন ঘটেনি।’) এই আনন্দের ঢেউ ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে বহু বহু দূর বিস্তৃত হয়েছে। সব মিলিয়ে রামচন্দ্র ভারত ও বহির্ভারতের অসংখ্য মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে উঠেছেন।
ভক্তকবি তুলসীদাস বলেছেন, ‘রামনাম-মণি দীপ ধরু জীহ দেহরীদ্বার।/ তুলসী ভীতর বাহরহুঁ জেউচাহসি উঁজিয়ার।।’ অর্থাৎ দেহ তুলসীর দেউল। জিহ্বা তাঁর দ্বার। যদি দেহের ভিতর-বাহির আলো করতে চাও তবে রামনামের মণিদীপ জিহ্বায় স্থাপন করো।
কিন্তু মোদির সাঙ্গোপাঙ্গরা কী করছে? দেহের ভিতর-বাহির আলো করতে নয়, দেশে আগুন জ্বালাতে রামনাম ব্যবহার করছে। মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টির, অপছন্দের মানুষকে টিজ করার কিংবা মস্তানি গুন্ডামির ভাষা হয়ে উঠেছে ‘জয় শ্রীরাম’! রামনামের এত বদনাম আগে হয়নি। আজ রামনবমী। ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের জন্মতিথি। এই পবিত্র দিনে মোদি বাহিনীর অপকীর্তির জন্য ভগবানের কাছে ক্ষমা চাইছি। প্রার্থনা করছি, রামচন্দ্র এদের শুভবুদ্ধি দিন। ভারতের অগ্রগতির পথের সমস্ত বাধা দ্রুত দূর হয়ে যাক।