অতিরিক্ত পরিশ্রমে শারীরিক ক্লান্তি, প্রিয়জনের বিপথগামিতায় অশান্তি ও মানহানির আশঙ্কা, সাংসারিক ক্ষেত্রে মতানৈক্য এড়িয়ে চলা ... বিশদ
কংগ্রেসের সভাপতিত্বকালেই সুভাষচন্দ্র বসু নিষিদ্ধ করেছিলেন কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভার দ্বৈত সদস্যপদ। অর্থাৎ, এক সংগঠনের সদস্য থাকলে অন্যটির সদস্য থাকা চলবে না। মুসলিম লিগের পক্ষেও সেই একই আইন প্রয়োগ করা হয়েছিল। ১৯৪০ সালের ৪ মে ফরওয়ার্ড ব্লকের কাগজে ‘কংগ্রেস এবং সাম্প্রদায়িক সংগঠন’ শিরোনামে সুভাষ সম্পাদকীয় লেখেন, “হিন্দু মহাসভা এবং মুসলিম লিগের মতো সাম্প্রদায়িক সংগঠনের কোনও সদস্য কংগ্রেসের কোনও নির্বাচনী কমিটির সদস্য হতে পারবেন না।” এই হিন্দু মহাসভার দুই শীর্ষ নেতার নাম— দামোদর বিনায়ক সাভারকর ও শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। যাঁদের উত্তরসূরি নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহরা।
অথচ, আজাদ হিন্দ সরকারের ৭৫ বর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নেতাজির মতো টুপি পরে নিজেকে তাঁর ভক্ত প্রমাণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সেই নেতাজির আজাদ হিন্দ বাহিনী নিয়ে তাঁর সংগঠন আরএসএসের বিশ্লেষণ কী? আরএসএস–এর কাছে ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল একটি ‘প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলন’৷ নেতাজি যখন আজাদ হিন্দ বাহিনীকে নিয়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে জীবন–মরণ সংগ্রামে লিপ্ত, সেই সময় আরএসএস তাদের মুখপত্র অর্গানাইজারে কার্টুন এঁকেছিল। যেখানে নেতাজিকে রাবণ বানানো হয়েছিল। আর আরএসএস তাঁকে তির মেরে হত্যা করছে। এদের উত্তরসূরি বলে গর্বিত বিজেপি আজ বাঙালির হৃদয় নেতাজির ছবি ব্যবহার করে ভোট চাইছে। এর জন্যই বলে, ভোট বড় বালাই!
অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকই মনে করেন, “রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদীরা সাধারণ অর্থে হিন্দুধর্মের পক্ষে নন— হিন্দুত্বের পক্ষে। হিন্দুধর্ম তো সহস্র বছরের। আর হিন্দুত্ব, একশো বছর আগে সাভারকরের নব আবিষ্কার।” আর নেতাজি বলতেন, ‘‘হিন্দু মুসলমানের স্বার্থ পরস্পরের পরিপন্থী, এ কথা যাঁরা বলেন, তাঁহারা খাঁটি কথা বলেন না।...খাদ্যাভাব, বেকারিত্ব, জাতীয় শিল্পের অবক্ষয়, মৃত্যুর হার বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যহীনতা, শিক্ষার অভাব এগুলিই মূল সমস্যা। ...এই সকল বিষয়ে হিন্দু মুসলমানের স্বার্থ অভিন্ন’’ (সুভাষ রচনাবলি, চতুর্থ খণ্ড)। বিজেপির নীতি ঠিক এর বিপরীত। পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব কায়েম বিজেপির প্রথম লক্ষ্য হলে, দ্বিতীয় লক্ষ্য গোটা দেশে তাদের মতাদর্শ দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করা। সেই মতাদর্শ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ-নির্ধারিত। যা কি না প্রকারান্তরে হিন্দুস্থানকে ‘হিন্দু রাষ্ট্রে’ পরিণত করার শামিল। এই কারণে মোদি-শাহসহ বিজেপির শীর্ষ নেতারা বাংলায় এসে বারবার বলছেন, নির্বাচনী যুদ্ধে জেতাটাই বড় কথা নয়, আসল কথা মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা, যা এখনও শেষ হয়নি। সেই লক্ষ্যে বিজেপি দ্রুত এগিয়ে চলেছে। বাংলার রাজনীতিতে বিজেপির সঙ্গে সংঘাতটা হয়ে উঠেছে যতটা রাজনৈতিক, ততটাই সাংস্কৃতিক। একদিকে ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুত্ব’, অন্যদিকে ‘নিখাদ বাঙালিয়ানা’। একদিকে সর্বগ্রাসী গোবলীয় সংস্কৃতি, অন্যদিকে শ্রীচৈতন্য, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দর ভক্তি ও ভাবধারার পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের বহুত্ববাদী বাঙালিত্ব।
বাঙালিকে ‘বাঙালিয়ানা’ বিসর্জন দিয়ে ‘ভারতীয়’ করে তোলার তাগিদ কংগ্রেস বা কেন্দ্রের কোনও শাসকই কখনও অনুভব করেননি। ফলে সহাবস্থান ও সহনশীলতার আদর্শচ্যুত হননি। বহুত্ববাদ, বৈচিত্র্য ও বিবিধের প্রয়োজনীয়তা বিসর্জন দিয়ে গোটা দেশে এক মতবাদ প্রতিষ্ঠায় বিজেপির বর্তমান নেতাদের যে তাগিদ, এর বিরুদ্ধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একক লড়াই গোটা দেশের কাছে প্রতীক হয়ে উঠেছে।
‘উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইন্ড’ বইয়ে জনসঙ্ঘের নেতা মাধব সদাশিব গোলওয়ালকর লিখেছিলেন, ‘‘হিন্দুস্থানের সমস্ত অহিন্দু মানুষ হিন্দুর ভাষা ও সংস্কৃতি গ্রহণ করবে ও পবিত্র বলে জ্ঞান করবে, হিন্দু জাতির গৌরবগাথা ভিন্ন অন্য কোনও ধারণাকে প্রশ্রয় দেবে না।...এক কথায় তারা হয় বিদেশি হয়ে থাকবে, না হলে হিন্দু জাতির দেশে তারা থাকবে সম্পূর্ণভাবে হিন্দুদের অধীনস্থ হয়ে, কোনও দাবি ছাড়া, কোনওরকম সুবিধা ছাড়া ও কোনওরকম পক্ষপাতমূলক ব্যবস্থা ছাড়া। এমনকি নাগরিক অধিকারও তাদের থাকবে না।’’ তাদের অন্যতম গুরু বিনায়ক দামোদর সাভারকরের কথায়, একমাত্র হিন্দুদেরই জন্মস্থান এবং আধ্যাত্মিক কেন্দ্র ভারতে অবস্থিত৷ তাই তারাই এ দেশের নাগরিক, ক্রিশ্চান, মুসলিম ইত্যাদি ধর্মাবলম্বীরা নন। এদেশে তাদের থাকতে হবে হিন্দুদের পদানত হয়েই।
এই যাঁদের ‘ভারতীয়ত্ব’ সম্বন্ধে ধারণা তাঁরা নেতাজি, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দকে কীভাবে আপন করতে পারবেন?
রবীন্দ্রনাথই তো বলেছিলেন, ‘‘বিধাতা কি তাহাকে এ কথা বলিয়া দিয়াছেন যে, ভারতবর্ষের ইতিহাস হিন্দুর ইতিহাস? হিন্দুর ভারতবর্ষে যখন রাজপুত রাজারা পরস্পর মারামারি কাটাকাটি বীরত্বের আত্মঘাতী অভিমান প্রচার করিতেছিলেন, সেই সময় ভারতবর্ষের সেই বিচ্ছিন্নতার ফাঁক দিয়া মুসলমান এদেশে প্রবেশ করিল, চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িল এবং পুরুষানুক্রমে জন্মিয়া ও মরিয়া এ দেশের মাটিকে আপন করিয়া লইল’’ (সমাজ)। আর বিবেকানন্দের কথায়, ‘‘মুসলমানদের ভারতাধিকার দরিদ্র পদদলিতদের উদ্ধারের কারণ হইয়াছিল। দারিদ্র্য ও অবহেলার জন্যই আমাদের এক পঞ্চমাংশ লোক মুসলমান হইয়া গিয়াছে’’ (বাণী ও রচনা– পঞ্চম খণ্ড, পৃঃ ১৪৭)। ‘‘...একথা বলা মূর্খতা যে তরবারির সাহায্যে তাহাদিগকে ধর্মান্তর গ্রহণে বাধ্য করা হইয়াছিল। ...বস্তুত জমিদার ও পুরোহিতবর্গের হস্ত হইতে নিষ্কৃতি লাভের জন্যই উহারা ধর্মান্তর গ্রহণ করিয়াছিল’’ (বাণী ও রচনা, সপ্তম খণ্ড, পৃঃ ২২)।
আসলে সাভারকর কিংবা গোলওয়ালকরের মতো হিন্দুত্ববাদী নেতা আমাদের দেশে হিটলারের দর্শন ও কাজকর্মের প্রশস্তি রচনা করেছেন, এবং ত্রিশের দশকের জার্মানিতে ইহুদিদের প্রতি অবর্ণনীয় নিষ্পেষণ, ঘৃণা ও হিংসাকে সমর্থনযোগ্য মডেল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। গোলওয়ালকরের নির্দেশেই শ্যামাপ্রসাদ ১৯৫১ সালে মহাসভা ছেড়ে ভারতীয় জনসঙ্ঘ স্থাপন করেন। কেন জানেন? মহাত্মা গান্ধীর হত্যার পরবর্তী সময়ে তীব্র জনরোষকে সংসদে সামাল দেওয়ার জন্য। এই জনসঙ্ঘেরই পরবর্তী রূপ আজকের বিজেপি।
যে বিজেপি আজ স্বামী বিবেকানন্দকে হিন্দু সন্ন্যাসী প্রমাণ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। মোদি-অমিত শাহরা না জানলেও, বাঙালিরা জানেন, বিজেপির একমাত্রিক হিন্দুত্বের সঙ্গে মাত্র উনচল্লিশ বছর বয়সে প্রয়াত এই সন্ন্যাসী যুবার আদর্শের বিরাট ফারাক। অত বড় ফারাক আছে বলেই মানবতাবাদীরা অনেক সময় বিবেকানন্দের শরণ নেন। শরণ নেন সেকুলাররাও। যাঁরা হিন্দু ধর্মের নামে ‘কারবার’ চালান সেই হিন্দুত্ববাদীদের ওপর বিবেকানন্দ খড়্গহস্ত। তিনি আসলে দুটি আলাদা মার্গের কথা বলেন। একটি মোক্ষ, অন্যটি ধর্ম। মোক্ষপরায়ণ যাঁরা, তাঁরা জাগতিক বিষয়ে উদাসীন, আত্মোপলব্ধির জন্য ত্যাগের পথে এগিয়ে যাবেন। সেই মোক্ষমুখী ত্যাগী তো সবাই হবেন না। যাঁরা মোক্ষপরায়ণ নন তাঁরা ধর্মপরায়ণ হবেন। এই ধর্ম বলতে বিবেকানন্দ জীবনযাপনের শৈলীর কথা বলছেন। এই শৈলী ঈশ্বর-বিমুক্ত নয়। তবে তার নানা রীতি, এ দেশে ও বিদেশে। বিবেকানন্দের মতে সেই রীতিটি এমন হওয়া চাই যাতে দেশ ও সমাজের উন্নতি হয়।
বিবেকানন্দ লিখেছিলেন, ‘অতীতে যত ধর্মসম্প্রদায় ছিল, আমি সবগুলিই সত্য বলিয়া মানি এবং তাহাদের সকলের সহিতই উপাসনায় যোগদান করি। প্রত্যেক সম্প্রদায় যেভাবে ঈশ্বরের আরাধনা করে, আমি তাহাদের প্রত্যেকের সহিত ঠিক সেই ভাবে তাঁহার আরাধনা করি। আমি মুসলমানদিগের মসজিদে যাইব, খ্রিস্টানদিগের গির্জায় প্রবেশ করিয়া ক্রুশবিদ্ধ ঈশার সম্মুখে নতজানু হইব, বৌদ্ধদিগের বিহারে প্রবেশ করিয়া বুদ্ধের ও তাঁহার ধর্মের শরণ লইব, এবং অরণ্যে গমন করিয়া সেই–সব হিন্দুর পার্শ্বে ধ্যানে মগ্ন হইব, যাঁহারা সকলের হৃদয়–কন্দর–উদ্ভাষণকারী জ্যোতির দর্শনে সচেষ্ট।’
সমস্যা হল, হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের বিকারগ্রস্ত একটা দিক আছে। যেখান থেকে হিন্দু মহাসভা, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং বিজেপির উৎপত্তি। এদের কাজ হল বিবেকানন্দের মতো এক সর্বাশ্লেষী ব্যক্তিত্বের উদার শব্দগুলি নিজের মতো করে ব্যবহার করা। যে হিন্দুত্বের মধ্যে বিবেকানন্দ ভারতের সংস্কৃতি এবং ধর্ম–দর্শনকে উদার মাহাত্ম্যে প্রোথিত করেছিলেন, সেটা ব্যবহৃত হতে থাকল বর্জনীয়তার রাজনীতির মধ্যে, যেখানে অহিন্দুরা আর ভারতীয় থাকেন না। ভুল ব্যাখ্যায় খণ্ডিত করে বিবেকানন্দকে আত্মসাৎ করা যেতে পারে, আত্মস্থ করা যায় না। এটা মোদি-অমিত শাহ না জানতে পারেন, বাংলার মানুষ জানেন। বিজেপি যে ঘৃণার রাজনীতিকে আমদানি করছে—সেই উগ্র–হিন্দুত্ববাদ, অন্ধ জাতীয়তাবাদের ভাবনার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, নেতাজি, এমনকী হিন্দু ধর্মের অন্যতম প্রবক্তা বিবেকানন্দের চিন্তার আদৌ কোনও মিল নেই। বরং বিজেপির ‘ভারতীয়ত্ব’ ভারতীয় নবজাগরণের মনীষীদের চিন্তার ঠিক বিপরীত!
‘আসলে বিজেপির বর্তমান নেতৃত্বের মধ্যে একটা মহাজনি সংস্কৃতি রয়েছে। সেই মহাজনি সত্তা কলকাতা দখলের মাধ্যমে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কর্তৃত্ব করতে আগ্রহী। দ্বিতীয় কারণটি আদর্শগত। বিজেপির কাছে নেশন বা রাষ্ট্র, নেশন স্টেট, জাতীয়তা ও জাতীয়তাবাদে কোনও পার্থক্য নেই। অথচ, জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেম কিন্তু এক নয়। দেশপ্রেম হলো ভৌগোলিক সেন্টিমেন্ট কিন্তু জাতীয়তাবাদ একটা আদর্শ। নেশন স্টেটের সঙ্গে তা সম্পর্কযুক্ত। বিজেপি এই দু’টি বিষয়কে একাকার করে দিয়েছে। এর ফলে নেশন স্টেট ঠিক করে দিচ্ছে কে দেশপ্রেমী, কে দেশদ্রোহী। বিজেপি সেটা চাপিয়ে দিচ্ছে। বাংলা দখলে এলে তা সর্বাত্মক হবে।’ প্রশ্নটা বাঙালির আত্মরক্ষার!
এহেন উত্তর ভারতীয় মতবাদের আগ্রাসনে এতকালের চেনা বাঙালিয়ানা ভেসে যাবে কি না, বাঙালিকেই তা ঠিক করতে হবে। স্বকীয়তা বজায় রেখে মাথা উঁচু করে বাঁচা, নাকি হিন্দুত্ববাদী প্রভুত্বের কাছে মাথা নোয়ানো? এই ভোট সেই চূড়ান্ত দিক নির্ণয়ের মাহেন্দ্রক্ষণ।