করোনা বদলে দিয়েছে জীবনের অনেক কিছুই। বদলে দিয়েছে বহু মানুষের পেশা। করমর্দন আলিঙ্গনের দিনও শেষ। বদলে হাতজোড় করে নমস্কার। জীবনমরণের সমস্যা যেখানে, সেখানে ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় সতর্কীকরণের বিধিনিষেধ মানতেই হবে সকলকে। দেবীপক্ষের শুরুও হয়ে গেছে। মণ্ডপে মণ্ডপে দেবী আরাধনার জন্য প্রস্তুতিপর্ব তুঙ্গে। এই উৎসবের মরশুমে করোনা বিধি না মানার প্রবণতা আমজনতার একাংশের মধ্যে মারাত্মকরকম বেড়ে যাওয়ায় করোনা সংক্রমণেও বাড়বাড়ন্ত। পুজোর সময়ে জনপ্লাবনের আশঙ্কা উদ্বেগ আরও বাড়াচ্ছে। তাই জনস্বাস্থ্য রক্ষার উদ্দেশ্যে পুজো প্রস্তুতির প্রায় শেষলগ্নে রাজ্যের প্রতিটি পুজো মণ্ডপকে ‘নো এন্ট্রি’ জোন করার লক্ষ্মণরেখা টেনে দিয়ে কলকাতা হাইকোর্ট নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। দর্শকদের মণ্ডপে ঢুকতে দিলে ভিড়ে ঠাসা জায়গায় মানুষের হুল্লোড়ে ব্যাধির প্রকোপ কয়েকগুণ বাড়ার আশঙ্কাটি অমূলক নয়। দূর থেকে তাই দুর্গা দর্শনের ব্যবস্থা। হাইকোর্ট বলেছে, ছোট পুজোর ক্ষেত্রে ৫ মিটার, বড় মণ্ডপের ক্ষেত্রে ১০ মিটার দূরে ব্যারিকেড লাগাতে হবে। বিধিসম্মত সতর্কীকরণ জুড়ে দিয়ে আরও বলা হয়েছে, রায় কতটা মানা হল সে ব্যাপারে হাইকোর্টে লক্ষ্মীপুজোর পর রিপোর্ট দেবে রাজ্য। পুজো প্রস্তুতির প্রায় শেষ মুহূর্তে তৃতীয়াতে দেওয়া এই রায়ের পর দুশ্চিন্তা বহুগুণ বেড়েছে পুজো উদ্যোক্তাদের। কারণ অলিতে-গলিতে যেসব পুজো হয়, বিশেষত উত্তর কলকাতার গলিতে কম জায়গার মধ্যে এমন অনেক পুজো হয় যেখানে এই রায় বাস্তবায়নের সমস্যা তাঁদের ভাবাচ্ছে। তাই আদালতের রায়কে মান্যতা দিয়েই ভিড় সামাল দেওয়ার বিকল্প উপায় খুঁজে বের করতে হবে পুজো উদ্যোক্তাদের। নিরুপায় হয়েই শেষমুহূর্তে তাই তাঁদের ভাবনায় বদল। হাতে আর সময়ও নেই। ভাবাচ্ছে অন্য আরও একটি বিষয়। মণ্ডপে দর্শনার্থীদের প্রবেশ আটকে না হয় সংক্রমণ রোখার চেষ্টা করা গেল। কিন্তু ব্যারিকেডের ওপারে? সেখানে কী হবে? মণ্ডপ ও আলোকসজ্জা দর্শনের জন্য রাস্তায় মানুষের ঢল নামলে তা আটকানো যাবে কীভাবে? এর জন্য পরিকাঠামো বা প্রয়োজনীয় সংখ্যক পুলিস কি আছে? ব্যারিকেডের বাইরে জমায়েত হলে তা কীভাবে সামাল দেবেন পুজো উদ্যোক্তারা? তাই আদালতের রায় বাস্তবায়নের জন্য পুলিসের কাজের পরিধি যেমন অনেকটাই বেড়ে গেল, তেমনি দুশ্চিন্তা বাড়ল আয়োজকদের। তাঁরা চাপে পড়লেন। একথা ঠিক, জনস্বার্থে নেওয়া আদালতের এই রায় কিন্তু মানতেই হবে। রায় কার্যকর করার জন্য রাজ্য প্রশাসন ও পুলিসের তরফে যতটা সক্রিয়তা দরকার
ঠিক ততটাই জরুরি নাগরিক সচেতনতা। সুরক্ষাবিধি মেনে ভিড়
এড়িয়ে চলার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে দর্শনার্থীদের। বিষয়টিকে
চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে উৎসবপ্রেমী মানুষ কি পারবে ‘আত্মঘাতী বাঙালি’র বদনাম ঘোচাতে? লক্ষ্য হোক সেটাই।
করোনা সংক্রমণ রুখতে সতর্কতা প্রচারে রাজ্য প্রশাসন এতটুকু ত্রুটি রাখেনি। আগেই পুজো মণ্ডপের তিনদিক খোলা রেখে পুজো করার পরামর্শ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যাতে একদিকে ভিড় জটলা না হয়। বলা হয়েছিল একসঙ্গে অনেক দর্শনার্থীকে মণ্ডপে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। ব্যাধির গ্রাস থেকে রক্ষা পেতে সতর্ক সংযত থেকে পুজো করার কথাও বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সুরক্ষাবিধি বেঁধে দেওয়া হয়েছিল সরকারি তরফে। এসব করেও অসংখ্য মানুষকে বাগে আনা সম্ভব হয়নি। পুজোর আগেই তাঁদের অনেকেই এইসব সৎপরামর্শ উড়িয়ে দিয়েছেন। শুভবুদ্ধি না জাগায় তাঁরা আগের মতোই বেপরোয়া। করোনা সংক্রমণ বাড়ছে জেনেও তাঁরা নিজের এবং নিজ পরিবারের সুরক্ষার কথা একবারও ভাবছেন না, ভাবছেন না অন্যের কথাও। মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক জেনেও তা ছাড়াই দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন যত্রতত্র। এখনও তাঁদের বোধোদয় হচ্ছে না, চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীনতার নজির রেখে তাঁরাই বিপদ বাড়িয়ে তুলছেন। তাই এখন দায়িত্বশীল নাগরিকের ভরসা আদালত। বলা যায়, আদালতের রায়ের জেরে সুফল তখনই পাওয়া যাবে যখন ওই শ্রেণীর মানুষের উৎসবের মজায় মাতোয়ারা হওয়ার বিপজ্জনক প্রবণতায় ছেদ পড়বে। না হলে আদালতের রায় কার্যকর করাটাই কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে। রাস্তায় অসচেতন মানুষের ঢল নামলে শুধু মণ্ডপে প্রবেশ আটকে সংক্রমণ ঠেকানো কতটা সম্ভব হবে তা লাখ টাকার প্রশ্ন।
সকলেই জানে, আদালতের এই রায় জনস্বার্থে। এটাও জানা, নিয়মের বেড়াজালে অসংখ্য মানুষকে বেঁধে রাখার কাজটি একেবারেই সহজ নয়। এর জন্য যে পরিকাঠামো দরকার তা আছে কি? তাই রাজ্য প্রশাসন, চিকিৎসকদের সতর্কবাণী এবং আদালতের রায়ের পরও নাগরিকদের সম্বিত না ফিরলে বিপদ আছে। সেইকারণেই সংক্রমণের বৃদ্ধি রোখার শেষ ভরসা কিন্তু নাগরিক সচেতনতাই।