ভোটের ফল ঘোষণার পরই বিজেপির মহিলা মোর্চার রাজ্য সম্পাদক অর্চিতা রায়চৌধুরী ফেসবুকে একটা পোস্ট করলেন... ‘বিজেপির নেতৃত্ব কি এবার বুঝতে পারছে, নিজের ঘরের সেদ্ধ ভাত অনেক ভালো পরের ঘরের চুরি করা বিরিয়ানির থেকে? এই গলা বুক জ্বালা এখন ৫ বছর ভোগাবে। নিজের ছেলেমেয়েকে পর করে জামাইকে আসন পেতে বসানোর খেসারত দিল।’ তৃণমূল কংগ্রেসের কিছু দলবদলু, ধান্দাবাজ নেতা বিজেপির পতাকা ধরার পর থেকেই এই ক্ষোভ ছাইচাপা আগুনের মতো আদি বিজেপির অন্দরে ছড়িয়ে পড়েছিল। নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ এই দলের ‘হত্তা-কত্তা-বিধাতা’। তাঁদের উপর কি আর কোনও কথা চলে? তেতো গেলার মতো করে গিলে নিতে হয়েছে। ভোটের মুখে খড়্গপুর সদর কেন্দ্রের মাটিতে দাঁড়িয়ে এক আদি বিজেপি কর্মী আক্ষেপ করেছিলেন, ‘এবার আর হল না। আমরা যারা বছরের পর বছর দলকে সার্ভিস দিয়েছি, তারা আজ পিছনের সারিতে! কয়েকটা দলবদলু তৃণমূল নেতা আজ বিজেপির সব!’ কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে মিলেছে। দলবদলু দিয়ে মোড়ানো বিজেপি শিবিরকে ভালোভাবে নেয়নি বাংলার মানুষ। যারা কি না মমতা বন্দ্যেপাধ্যায়ের উন্নয়নকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে আসল পরিবর্তনের ডাক দেয়, তারা ক্ষমতার লোভে ণত্ব-ষত্ব জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে? পরিবর্তন এত সহজ নয়। তিলে তিলে গড়ে তুলতে হয় তার ভিত... গড়ে তুলতে হয় বিশ্বাসযোগ্যতা। মোদিজি, এই ক’দিনে ২৪টা জনসভা করেও সেই বিশ্বাস বাংলার অন্তরে বপন করতে পারেননি। পারেননি অমিত শাহও। ৪৩টা সভা-রোড শো’র পরও না। তার প্রমাণ একুশের ভোটের ফল। জয়ীর তালিকায় শুভেন্দু অধিকারী ছাড়া অন্য কোনও দলবদলুর নাম খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় হেরেছেন ৪২ হাজার ৫১২ ভোটে। জিতেন্দ্র তেওয়ারি হেরেছেন ৩ হাজার ৮০৩ ভোটে, বিশ্বজিৎ কুণ্ডু ৭ হাজার ৩৯৯, মন্তেশ্বরে সৈকত পাঁজা ৩১ হাজার ৮১৫, প্রবীর ঘোষাল, রথীন চক্রবর্তী, বৈশালী ডালমিয়া, সব্যসাচী দত্ত, শীলভদ্র দত্ত... কালি ফুরিয়ে যাবে, নাম শেষ হবে না। শুভেন্দুবাবুর জয়টাও সংশয়াতীত নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নন্দীগ্রামের গণনায় কারচুপির অভিযোগ করেছেন। তৃণমূল প্রশ্ন তুলছে, গোটা রাজ্য যাঁকে দেখে ভোট দিল... সেই মমতা হেরে গেলেন? তাহলে কি ডাল মে কুছ কালা হ্যায়? উত্তর ভবিষ্যৎ দেবে। আগে দলবদলু নেতাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ। নতুন দলে আপনাদের এবার ডালভাত জুটবে তো? এটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন। আপনারা নাকি তৃণমূলে অক্সিজেনের অভাব বোধ করছিলেন? স্বপ্ন দেখেছিলেন, আপনাদের হাত ধরে আসবে ‘আসল পরিবর্তন’। বদল হাওয়ায় হয় না... আসে কাণ্ডারীর হাত ধরে। আসলে আপনারা নিজেদের প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বে ভাবছিলেন। ভুলে গিয়েছিলেন, জার্সিটাই শেষ কথা। মনে পড়ছে সেই ফুলওয়ালার কথা... ‘দিদির বিরুদ্ধে ক্ষোভ থাকতে পারে, কিন্তু সরকার উল্টে যাওয়ার মতো নয়। সেটা হবেও না। এখন যা কাজকম্ম করে খেতে পারছি, বিজেপি এলে সেটাও পারব না।’
এটাই সার কথা। বাংলায় এসে ভুল উচ্চারণে চারটি বাংলা কথা বললেই বাঙালির মন জয় করা যায় না। মোদ্দা বিষয়টা হল, আপনারা বহিরাগত। খান দশেক দলবদলুকে ঢাল বানিয়ে বাংলা জেতা যায় না। যাবেও না। আপনারা তাও মানবেন না! অর্চিতা তাঁর ফেসবুক পোস্ট মুছে দিয়েছেন। তালিকায় আরও অনেকেই কিন্তু আছে। একে একে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে, আর উপর মহল থেকে আসা প্রবল চাপ শুষে নিচ্ছে সবটা। কিন্তু কতজনকে চুপ করাবেন? মনে রাখবেন, এত হম্বিতম্বি করেও ৮০ আসন টপকাতে পারেনি বিজেপি। এর দায় নিতে হবে দিল্লির কর্তাদেরই। আর একটা বিষয় পরিষ্কার—মমতা জনপ্রিয়তা হারাননি। বরং বাম-কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্ক পুরোটা প্রায় গিয়েছে গেরুয়া শিবিরে। বাংলায় পরিবর্তন বলতে এতটুকুই।