বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যার বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে আজাদ-হিন্দ-বাহিনীর শয়ে শয়ে অফিসার সেসময় ভারত এবং সেয়লনের (বর্তমানে শ্রীলঙ্কা) বিভিন্ন এলাকায় এসে পৌঁছচ্ছেন। একটা বড় অংশই ডুবোজাহাজে। বাকিদের নামানো হয়েছে প্যারাসুটে। গুপ্তচর বাহিনীর বিশাল নেটওয়ার্কের রণকৌশলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু নিজে। যদিও এত উন্নত প্রশিক্ষণ সত্ত্বেও শেষপর্যন্ত তাঁদের অনেকেই ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের হাতে ধরা পড়ে যান। চলে অমানুষিক অত্যাচার। গোপন সামরিক আদালতে দ্রুত শেষ হয় বিচার। শাস্তি ছিল একটাই— ফাঁসি।
এখানে আমি অবশ্য এরকম একটিমাত্র অভিযানের কথাই লিখব, যা শেষ হয়েছিল চার দেশপ্রেমিকের মৃত্যুদণ্ডে। তাঁদের মধ্যে ওই সাবমেরিনে স্বদেশে ফেরা অফিসাররাও ছিলেন। কিন্তু নেতাজির গুপ্তবাহিনীর আরও হাজার হাজার সদস্য ফিরেছিলেন স্বদেশে। আর কখনও তাঁদের কোনও খোঁজখবর পাওয়া যায়নি। দেশের মাটিতে তাঁদের আরও সঙ্গী ছিলেন। তাঁরা একসঙ্গেই শহিদ হন। সেই সাহসী বন্ধুদের ভাগ্যেই বা কী ঘটেছিল? তাঁদের নাম এখনও অজানা। বিস্মৃতির অসীমে হারিয়ে গিয়েছেন।
নেতাজির ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আমি গোটা দেশের কাছে আইএনএ-এর গুপ্তবাহিনীর সদস্যদের এই আত্মত্যাগকে স্বীকৃতি দেওয়ার আর্জি জানাচ্ছি। তাঁদের ‘বলিদান’ স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়। যা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা উচিত।
নেতাজির তত্ত্বাবধানে মালয়ের পেনাংয়ে তাঞ্জোঙ্গ বুনগাহ কেন্দ্রে এই বীর অফিসারদের প্রশিক্ষণ পর্ব চলেছিল। জেনারেল মোহন সিং এবং পরে রাসবিহারী বসুর সাহায্যে পেনাংয়ের স্বরাজ ইনস্টিটিউটে গোটাটাই পরিচালনা করেছিলেন স্বয়ং সুভাষচন্দ্র। অমৃক সিং গিলের কাহিনি অনুযায়ী, সূক্ষ্ম ও নির্ভুলভাবে সব কিছু পরিচালনার ট্রেনিং দেওয়া হতো। পাঁচজনের আলাদা আলাদা দল তৈরি করে চলত ট্রেনিং। যাতে একটি দল অন্যদের কথা জানতে না পারেন। যদি কোনও কারণে কেউ ধরাও পড়ে যান, প্রচণ্ড অত্যাচার করেও তাঁর কাছ থেকে বাকিদের তথ্য বের করা যাবে না। এছাড়া ওয়্যারলেস সেট খুলে আলাদা করা এবং ফের জুড়ে দিয়ে বার্তা পাঠানো, যুদ্ধজাহাজ, বোমারু বিমানের ছবি দেখে চিহ্নিতকরণও শেখানো হতো। যাতে তাঁরা নেতাজিকে একদম সঠিক তথ্য পৌঁছে দিতে পারেন। পাশাপাশি মানচিত্র পাঠ, গোপন কোডে বার্তা প্রেরণ, শত্রুপক্ষের সাংকেতিক বার্তার পাঠোদ্ধার, স্পাই ক্যামেরা ব্যবহার এবং অত্যাচার থেকে বাঁচার টেকনিক আয়ত্ত করতে হয়। এমনকী প্রশিক্ষণরতদের কৃত্রিম ফাঁসিতেও ঝোলানো হতো। অর্থাৎ যে কোনও পরিস্থিতির জন্যই তৈরি রাখা হয়েছিল তাঁদের। অমৃক লিখেছিলেন, ‘ট্রেনিংয়ের উত্তুঙ্গ মুহূর্তে ভেঙে পড়তেন কয়েকজন। প্রশিক্ষণ ছেড়ে চলেও যেতে হতো তাঁদের।’
আইএনএ-এর গুপ্তবাহিনীর ব্যাপক সাংগঠনিক নেটওয়ার্কের অনেক কিছুই এখনও সামনে আসা বাকি। একটি নির্দিষ্ট অভিযানই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল এবং সেটাও মহাত্মা গান্ধীর হস্তক্ষেপের কারণে। যেটি হল, ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের কথায় ‘কলকাতা ষড়যন্ত্র মামলা’। সময়টা গত শতাব্দীর চারের দশকের মধ্যভাগ। কলকাতার লর্ড সিনহা রোডে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে আইএনএ-এর গুপ্তবাহিনীর চার দেশপ্রেমিকের সামরিক বিচার পর্ব সমাধা হয়। তাঁদের অপরাধ ছিল, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। বিচার শেষ হয় চারজনের ফাঁসির আদেশে। মামলাটি যখন প্রকাশ্যে আসে, তখন ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেলকে চিঠি লেখেন মহাত্মা গান্ধী। দিনটা ছিল ১৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৫। গান্ধীজি লিখেছিলেন, ‘যদি এই ফাঁসির আদেশ কার্যকর করা হয়, তাহলে সেটা হবে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ভুল।’ গান্ধীজির আবেদনকে মান্যতা দিয়ে চার দেশপ্রেমিকের ফাঁসির আদেশ বদলে যায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে।
কিন্তু ঠিক কী কারণে ধরা পড়েছিলেন এই চারজন? ১৯৪৪ সালের মার্চ মাসে শুরু হয়েছিল সেই গোপন অভিযান। পেনাং ছেড়ে পুরীর উদ্দেশে রওনা দেয় জাপানি ডুবোজাহাজ। তাতে ছিলেন ডাঃ পবিত্রমোহন রায় (নেতা), সর্দার মহিন্দর সিং (বোমা বিশেষজ্ঞ), তুহিন মুখোপাধ্যায় (কোডিং বিশেষজ্ঞ) ও অমৃক সিং গিল (রেডিও এক্সপার্ট)। পেনাং ছাড়ার ঠিক আগে তাঁদের উত্সাহ বাড়াতে বার্তা দেন নেতাজি, ‘সংখ্যায় অত্যন্ত কম হলেও তোমাদের অভিযান গোটা ব্রিটিশ গুপ্তচর বাহিনীর উপর মারাত্মক আঘাত হানবে। কলকাতায় এই কেন্দ্র যে কোনও মূল্যে গড়তে হবে।’ এমনই উল্লেখ রয়েছে অমৃকের স্মৃতিকথনে।
একটি ছোট্ট আশঙ্কা ছাড়া সেবার ডুবোজাহাজটির কোথাও সমস্যা হয়নি। অভীষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে একটি যন্ত্রচালিত ডিঙিতে করে পুরীর নিকটবর্তী সমুদ্রতীরে এসে পৌঁছন চারজন। অমৃক এক জায়গায় লিখেছেন, ‘সূর্যের আলো ফোটার ঠিক আগেই আমরা দেখতে পাই কোনারকের বিশাল সূর্যমন্দির।’ তীরে নামার কয়েক মিনিটের মধ্যেই মন্দিরের দক্ষিণ দিকের প্রাচীরের কয়েক ফুট দূরে বোমা, হ্যান্ড গ্রেনেড এবং পাওয়ার প্যাক মাটিতে পুঁতে ফেলেছিলেন মহিন্দর (সেগুলি কি এখনও সেখানে?)। এরপর চারজনেই আলাদা হয়ে যান। রেডিও পার্টসগুলিকে আগেই আলাদা করে সেগুলির চেহারা বদলে দিয়েছিলেন ডাঃ রায়। ছিল একটি গ্রামাফোনও। সেসব নিজেদের ব্যাগপত্রের বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে দ্রুত সূর্যমন্দির চত্বর ছাড়েন তাঁরা। পরের রবিবার সকাল ১০টায় কলকাতায় তাঁদের দেখা করার কথা ছিল। জায়গাটা ছিল ব্রিটিশদের নাকের ডগায়, মেট্রো সিনেমা।
কিন্তু তখনই হয়ে যায় এক মারাত্মক ভুল। নির্দেশ না মেনে শ্বশুরবাড়িতে দেখা করতে চলে যান তুহিন। লজ্জার বিষয় হল, শ্বশুর দেখা মাত্রই তাঁকে কলকাতা পুলিসের হাতে তুলে দেন। তুহিনের মাথার দাম হিসেবে পাঁচ হাজার টাকাও হস্তগত করেন। ১৯৪৪ সালে সেই টাকার অঙ্কটা মোটেই কম ছিল না। ইংরেজদের চরম অত্যাচারের মুখে তুহিন ভেঙে পড়েন এবং রেঙ্গুনে নেতাজির হেডকোয়ার্টারের রেডিও মারফত বার্তা আদানপ্রদানের গুরুত্বপূর্ণ সংকেতের কথা বলে দেন।
এই বিপর্যয়ের কয়েকদিনের মধ্যে হরিদাস মিত্র ও তাঁর স্ত্রী বেলা বসুর সংস্পর্শে আসেন ডাঃ রায় ও অমৃক। বেলা বসু ছিলেন নেতাজির বড়দা সুরেশচন্দ্র বসুর মেয়ে। তাঁদের সঙ্গে হাত মেলান হরিদাসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু জ্যোতিষ বসু এবং আত্মগোপন করে থাকা একাধিক বিশ্বস্ত বিপ্লবী। মহিন্দর চলে গিয়েছিলেন বালিগঞ্জের শিখ গুরুদ্বারে। অমৃক কলকাতায় থাকার কারণ হিসেবে দেখানোর জন্য জর্জ ব্রাউন রেডিও কলেজে গিয়ে ভর্তি হন। হ্যারিসন রোডে একটি হস্টেলে থাকতেও শুরু করেন। পবিত্রবাবু চলে যান হরিদাস ও বেলা দেবীর ভবানীপুরের বাড়িতে। তাঁদের ব্যবসার ম্যানেজারের ছদ্মবেশ ধরেন তিনি।
অমৃকের স্মৃতি অনুযায়ী, নতুন কোড ব্যবহার করে প্রথম পরীক্ষামূলক রেডিও যোগাযোগের শুরুটা হয় ডেন্টাল সার্জেন ডাঃ দত্তের বাড়ি থেকে। তা সফল হওয়ার পর প্রয়োজন পড়ে একটি স্থায়ী আত্মগোপনের আস্তানার। যাতে শক্তিশালী জাপানি ট্রান্সমিটারগুলি বসানো যায়। এই প্রসঙ্গে ১৯৯২ সালে মালয়েশিয়ায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধে অমৃক বলেছেন, ‘হরিদাস মিত্র কোনও সময় নষ্ট করেননি। দ্রুত আমরা বেহালায় চলে যাই। আমাদের সঙ্গে সেরা রেডিও রিসিভার ছিল। সঙ্গে ছিলেন হরিদাস মিত্র, জ্যোতিষ বসু, বেলা বসু এবং অবশ্যই আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা বিশ্বস্ত কর্মীদের সহায়তা।’ বেহালার এই বাড়িটির চারদিক ছিল বাঁশবনে ঘেরা। ছিল একটি বিশাল জলাশয়ও। তার পিছনে লুকিয়ে দিব্যি ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের উপর নজর রাখা সম্ভব হচ্ছিল।
ব্রিটিশ সেনা কোহিমায় মোতায়েন শুরু হতেই আইএনএ-এর সদর দপ্তরে নতুন সাংকেতিক বার্তা আদানপ্রদানের বন্যা শুরু হয়। দমদম বিমানবন্দরে বোমারু বিমানগুলি রাখা হয়েছিল। অমৃকের কথায়, ‘আমরা শক্তিশালী ট্রান্সমটার ব্যবহার করে নৌবাহিনী এবং সেনার সিগন্যাল জ্যাম করে দিতাম। ওদের চেনা ফ্রিকোয়েন্সিতেই কান পাততাম।’ এই কোডেড বার্তাগুলিই যুদ্ধক্ষেত্রে আইএনএ কমান্ডারদের প্রভূত সুবিধা করে দেয়।
এরই ফাঁকে মহিন্দর রওনা দেন জলন্ধর, সেখানে শক্তিশালী আন্ডারগ্রাউন্ড সেল তৈরি করতে। কিন্তু তাঁর মাথার দামটাই বন্ধুদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণ হয়ে ওঠে। ফাগওয়ারায় ধরা পড়েন মহিন্দর। পরে লাহোরে ব্রিটিশ পুলিসের অত্যাচারেই তাঁর মৃত্যু হয়। এই চরম আত্মত্যাগের স্বীকৃতি আজ পর্যন্ত মেলেনি।
ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স বাকিদেরও দ্রুত ধরে ফেলে। প্রথমে ডাঃ পবিত্র রায়, তারপর একে একে অমৃক, হরিদাস মিত্র ও জ্যোতিষ বসুকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৪৫ সালের মে মাসে শুরু হয় সামরিক বিচার। ৩০ দিনের মধ্যেই গোটা প্রক্রিয়া শেষ করা হয়। রাজসাক্ষীদের মধ্যে ছিলেন পেনাংয়ের আইএনএ সেন্টারে প্রশিক্ষণ নেওয়া ১২ জন বিশ্বাসঘাতকও। তাঁদের অধিকাংশই বালুচিস্তানের কাছে ডুবোজাহাজ থেকে নেমেছিলেন। সব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উগরে দিয়ে রাজসাক্ষী হয়ে যান তুহিন মুখোপাধ্যায়ও। বিনিময়ে তাঁর শাস্তি মকুব হয়। ডাঃ পবিত্রমোহন রায়, অমৃক সিং গিল, হরিদাস মিত্র ও জ্যোতিষ বসু— চারজনের ফাঁসির আদেশ দেন ব্রিটিশ বিচারপতি ওরমেরোড।
ফাঁসির দিনও এগিয়ে আসছিল। কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর হস্তক্ষেপে তা হয়নি। ভাইসরয়কে লেখা তাঁর চিঠির জেরেই ফাঁসি খারিজ হয়। চার দেশপ্রেমিককে পাঠানো হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করতে কারাগারের অন্ধ কুঠুরিতে।
অমৃক স্বীকার করেছেন যে, তিনি আইএনএ-এর এরকম অন্তত ১০টি দলের সদস্যদের চিনতেন। যাঁরা স্বদেশে এসে পৌঁছেছিলেন তাঁদেরও আগে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় সেই দলগুলি অবতরণ করেছিল এবং গোপন সামরিক আদালতে তাঁদের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণাও করেন বিচারপতিরা। এমনকী, ফাঁসিও হয়ে যায় গোপনেই। এই শহিদরা কারা? কী তাঁদের পরিচয়? অদৃষ্টের কী নির্মম পরিহাস, আমাদের দেশ সেই ইতিহাস জানে না! আজও ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ রেকর্ডগুলি ভারত ও লন্ডনের আর্কাইভে চাপা পড়ে আছে। সময় এসেছে সেই ইতিহাস খুঁড়ে তুলে আনার, নেতাজির আইএনএ-এর গুপ্তচর বাহিনীর এই শহিদদের চরম আত্মবলিদানকে দেশের মানুষের উদ্দেশে উত্সর্গ করার।
(লেখক রাজ্যের অর্থমন্ত্রী, আইএনএ ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা পেট্রন, হরিদাস মিত্র ও বেলা বসুর পুত্র।)
তথ্যসূত্র:
বেলা বসুকে নিয়ে লেখা অধ্যাপিকা সুমিত্রা মিত্রের বই।
গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল
সহযোগিতায় : উজ্জ্বল দাস