সিটিজেন বনাম
সিনিয়র সিটিজেন
শংকর
আগামীকাল, ৭ ডিসেম্বর আমার জন্মদিন, কিন্তু আজ তো ৬ ডিসেম্বর, জোর করে বলা যায় না আমি এইট্টি সেভেন নট আউট হতে চলেছি আগামী কাল। নানা অনিশ্চয়তা নিয়ে এখনকার দিনকাল। তার সঙ্গে রয়েছে উচ্চ রক্তচাপ ও ব্লাড সুগার, যাদের ধরবার জন্য নবাগত একটি ভাইরাস নাকি বিশেষ আগ্রহী। দেখা যাচ্ছে, মানুষ থেকে জীবাণু পর্যন্ত কেউই নিজের জোরে রাজত্ব চালাতে আগ্রহী নয়, তাই বাংলা ভাষাতেও ‘কো-মরবিডিটি’ বলে একটা ইংরেজি শব্দের বেআইনি অনুপ্রবেশ ঘটল।
বর্ষীয়ান বাঙালিদের পক্ষে এটা নতুন খবর নয়, এর আগেও হুট করে ইংরেজি শব্দ বাঙালির বেডরুমে ঢুকে পড়েছে। যেমন ‘এয়ার রেড’, ‘ব্ল্যাক আউট’, ‘এ আর পি’, ‘ইভাক্যুয়েশন’, ‘ব্ল্যাক মার্কেট’ ইত্যাদি নিষিদ্ধ শব্দ—তারা গৃহস্থ বাঙালির অনুমতিই নেয়নি।
বাংলা ভাষায় এই ধরনের অনধিকার প্রবেশ সেই পলাশির পরাজয় থেকেই ঘটে আসছে। কিন্তু আমরা সাবধানী এবং রক্ষণশীল জাত, মোগল পাঠানকে কোনওরকমে সামাল দিয়ে আমরা অনেকদিন বাইরের শব্দকে অন্দরমহলে ঢুকতে দিইনি। যেসব শব্দের কথা উল্লেখ করলাম, এসবই বিশ শতকের তৃতীয় দশক থেকে আমাদের জ্বালাতন করছে, আমাদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও। আরও দুটো-তিনটে ইংরেজি শব্দ আচমকা হাজির হয়েছে —‘রায়ট’, ‘পার্টিশন’ এবং ‘রিফিউজি’। দাঙ্গা, দেশভাগ এবং আশ্রয়প্রার্থী বললে প্রকৃত অবস্থা বোধহয় ঠিক বোঝা যায় না, যেমন ‘ভোট’, যাঁরা বাক্যবাগীশ বাঙালিকে পবিত্র রাখতে চান তাঁরা দুশ্চিন্তায় থাকেন, ভয় দেখান—এতদিন তো মোগল পাঠান ইংরেজকে সামলানো গেল, সামনে কিন্তু আরও খারাপ সময় আসছে। যেমন হিন্দির আক্রমণ, শেষ পর্যন্ত হয়তো ‘বেংলিস’ এবং ‘হিংলিস’ ছাড়া বঙ্গীয় শব্দ কোষ বা ডিক্সনারিতে কিছুই থাকবে না।
বহিরাগতদের যাঁরা এইসব বেয়াড়ি ভাবনা সমর্থন করেন, তাঁরা আত্মনির্ভর ভারতের কথা বললেও স্বনির্ভর বাংলাকে অপছন্দ করেন। আর যাঁরা ভোট বাক্সে সজীব ও স্বনির্ভরকে নিধন করতে আগ্রহী তাঁরাও দেখছি বাংলার মানুষকে বলছেন, যা পরিধান করে দূরত্ব রক্ষা করতে হবে, তার নাম ‘মাস্ক’। মুখোশ বলে একটা বাংলা শব্দ এতদিন ছিল, এখন আর নেই। যাঁরা বিরক্ত হচ্ছেন তাঁরা বলছেন, কোভিড ১৯ বিদেশ থেকে আসা ফরেন ইনভেশন। আমরা এতদিন কেবল ‘কোবিদ’ শব্দেই সন্তুষ্ট ছিলাম, ‘কলেরা’, ‘স্মল পক্স’, ‘ইনফ্লুয়েঞ্জা’, ‘প্লেগ’, ‘ডেঙ্গু’ এরা কোনওটাই বাঙালি নয়।
যাঁরা শব্দের সতীত্ব পছন্দ করেন না, তাঁরা জিজ্ঞেস করেন, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, স্মল কজেস কোর্ট এসব কি বাঙালির নিজস্ব শব্দসম্পদ? এমন দিন আসতে পারে, যেদিন ডাল, ভাত চচ্চড়ি ও চাটনি ছাড়া আমাদের শব্দপাত্রে কোনও কিছুই বাঙালি থাকবে না। যদি বলেন কেন? ইলিশ, চিংড়ি, রসগোল্লা, সন্দেশ এসব গেল কোথায়? আপনি না শোনার ভান করতে পারেন, কিন্তু নিষ্ঠুর সত্যটি হল, এসব কেনবার ক্ষমতা থাকবে কেবল তাঁদের, যাঁদের আমরা আড়ালে বহিরাগত বলি। এঁরাই আজ মহানগরী কলকাতার বেশিরভাগ সম্পত্তির মালিক, এঁদের এক্ষুনি কোটি টাকার ফ্ল্যাট বিক্রি করবার জন্য বাংলার অতিপ্রিয় তারারা টিভিতে সাদর আহ্বান জানান।
মনে পড়ছে ভাষাবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কথা, তাঁর দক্ষিণ কলকাতার ‘সুধর্মা’ নামক গৃহে বসে তিনি আমাকে বলেছিলেন, কাউকে নিজের বই উপহার দেবার সময় কখনও লিখবে না ‘শ্রীচরণেষু’। কারণ তোমার বইটা হল দেবী সরস্বতী, বড়জোর লিখবে ‘করকমলেষু’ এবং সব সময় শব্দের প্রকৃত অর্থ খুঁজে পাবার জন্য অভিধানের শরণ নেবে। আমাদের বড় লেখকগণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত সুযোগ পেলেই অভিধান পড়তেন এবং তাঁরা বুঝতেন, শব্দের অরণ্যেই লুকিয়ে থাকে একটা গোটা জাতের উত্থানপতনের ইতিহাস।
তাহলে যেসব বহিরাগত শব্দ চুপি চুপি কাছে এসে আমাদের অন্দরমহলে ঢুকে পড়েছে, তাদের কী হবে?
প্রবীণ নাগরিক (থুড়ি, এর শুদ্ধ বাংলা হল সিনিয়র সিটিজেন) হিসেবে চোখের সামনে দেখছি বহিরাগতের সাম্প্রতিক অনুপ্রবেশ। আমি কেবল ভাষার কথাই ভাবছি। এর শুরু সেই ১৯৩৯ সালে, যখন ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ’ হয়ে গেল ‘সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার’, চাল, ডাল উধাও হয়ে গেল ‘রেশন কার্ডে’। এই ‘রেশন’ শব্দটা বোঝে না এমন একজন বাঙালি এই পুণ্যভূমির কোথাও নেই। কিন্তু বিলেত থেকে আসা কলকাতার সাহেবরাও এর অর্থ বুঝতে পারতেন না। একজন সাহেব আমাকে সেই ১৯৬৭ সালেই জিজ্ঞেস করেছিলেন, রোমান সৈন্যবাহিনীতে এই রেশন শব্দটা চালু ছিল শুনেছি।
আমার বক্তব্য, মহাযুদ্ধের সময়েই এইসব অনুপ্রবেশ হল, এ আর পি ছোকরা এসে ভয় দেখাল, বৈদ্যুতিক বাতিতে ঘোমটা লাগাও না হলে থানায় যেতে হবে। তখন যুদ্ধের সময়, কাজকর্মের বেজায় সুদিন, কিন্তু সেইসঙ্গে জুটল ‘ওভারটাইম’, যার শুদ্ধ বাংলা বোধ হয় সুনীতি চাটুজ্যেরও আয়ত্তের বাইরে। তারপর বাংলার কলকারখানা যখন বাইরে চলে যেতে আরম্ভ করল তখন আমাদের হল দুটো নতুন শব্দপ্রাপ্তি—‘লক আউট’ ও ‘ভিআরএস’। আমাদের ক্ষয়িষ্ণু হাওড়া শহরেও এর মানে বোঝে না, এমন একজন পুরুষ ও নারী সেদিন ছিল না।
কিন্তু তার আগেও একটা সময় এসেছিল—১৯৪৩। গোড়ায় কিছু লোক বলত ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’, পঞ্চাশ লাখ না কত মানুষ এই সোনার বাংলা থেকে সাফ হয়ে গেল ‘ফ্যান দাও, ফ্যান দাও’ কাঁদতে কাঁদতে। আদি ‘ফ্যান’ শব্দের অর্থ আজকের সেরা ছাত্রছাত্রীও বোঝে না, এখন ফ্যানের অন্য অর্থ— ‘অমিতাভ বচ্চন ফ্যান’, ‘কোহলি ফ্যান’, টেবিল ফ্যান, সিলিং ফ্যান। এইসব পবিত্র শব্দ বঙ্গীয় কর্ণকুহরে নিত্য প্রবেশ করছে।
পঞ্চাশের সর্বনাশা মন্বন্তরের পরে লর্ড ওয়াভেলের দয়ায় আমরা পেলাম আরও দুটি টাটকা বাংলা শব্দ—‘রেশন’ ও ‘ফেয়ার প্রাইস শপ’। এদেরই সহযাত্রী ‘ব্ল্যাক আউট’ এবং ‘ইভাক্যুয়েশন’। জাপানিদের হাত থেকে বাঁচবার জন্য লক্ষ লক্ষ নিরীহ লোক কলকাতা ছেড়ে পালাল, খুব ক্ষতি হল অনেকের। কিন্তু আমাদের লাভ হল এই মূল্যবান বাংলা শব্দটি—‘ইভাক্যুয়েশন’। আমার চৌধুরী বাগানের এক পড়শি বলেছিলেন, এটা নতুন ব্যাপার নয়, এর আগে ১৮৯৮ সালে প্লেগের সময় কলকাতার বারো আনা নাগরিক শহর ছেড়ে পালিয়েছিল, কিন্তু তখন কোনও অজ্ঞাত কারণে ‘ইভাক্যুয়েশন’ শব্দটি কেউ ব্যবহার করেনি, এক ‘প্লেগ’-ই তখন যথেষ্ট।
কিন্তু সেই সময় একটা মজার ব্যাপার ঘটেছিল। কেউ কেউ ধরে নিয়েছিল, মহাযুদ্ধে মিত্রপক্ষের হার অনিবার্য। দেশটা তিনভাগে ভাগ হয়ে যাবে—একভাগ পাবেন মুসোলিনি, একভাগ হিটলার এবং এই সোনার বাংলা চলে যাবে জাপানি তোজো সাহেবের হাতে। সাহেব কোম্পানির নিম্নবিত্ত কেরানিও হাওড়ায় লুকিয়ে লুকিয়ে জাপানি শব্দের অর্থপুস্তক পড়তে লেগে গেল। আমি তখন নিতান্তই স্কুলের ছাত্র, কিন্তু আমাকেও একজন শিক্ষার্থী জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘বাংলা এয়ার রেড’ শব্দটার জবানী কি হবে রে?
আমাদের পড়শি বাদল কাকু ছিলেন এক ইংরেজ অফিসের ক্ষিপ্র লিপিকার। তিনিও বললেন, ইংরেজি আয়ত্ত করতে জাপানিদের একশো বছর লেগে যাবে, ততদিন এই বেংলিশই চালাতে হবে, এইটাই সুভাষকে সবাই মিলে বোঝাতে হবে।
‘গ্রেট ফেমিন’টা আমরা কেমন সহজেই ভুলে গেলাম। আমাদের সমবয়সি অমর্ত্য সেন কেবল ঠান্ডা মাথায় ওই বিষয়টা নাড়াচাড়া করে নোবেল জয়ী হলেন। আমাদের আশঙ্কা, কোনও বুদ্ধিমান বাঙালি একদিন ‘লক আউট’ এবং ‘ভিআরএস’ শব্দ দু’টি ভাঙিয়ে স্টকহোমে ছুটবেন।
এসব তো পঞ্চাশের সত্য। তার আগেও এসেছিল ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, তখন কিন্তু সঙ্কর শব্দের ধাক্কায় আমরা চিৎপটাং হইনি। পরবর্তী সময়ে শুনেছি, স্বাধীন হলে আর ‘ফেমিন’ হবে না, ‘স্টারভেশন ডেথ’ও হবে না। একেবারে নির্জলা সত্য কথা, স্বাধীন ভারতে আর ফেমিন হয়নি, তার একমাত্র কারণ কয়েকটি ইংরেজি শব্দকে আমরা যথাসময়ে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ফেলে দিয়েছি—এখন আর এদেশে ‘ফেমিন’ হয় না, হয় ‘ড্রাউট’, ‘স্টারভেশন ডেথ’ আর হয় না। এখন যা হয় তা কেবল ‘ম্যালনিউট্রিশন’। তেমনই আমাদের হাওড়ায়, আর হয় না কলেরা, তার বদলে যা হয় তা হল ‘স্টম্যাক ট্রাবল’।
যাহা তেতাল্লিশ তাহা ছেচল্লিশ নয়। ১৬ আগস্ট ১৯৪৬ সালে আমরা বাঙালিরা পেলাম আর একটি নতুন শব্দ—‘রায়ট’। আদ্যিকালে যার অর্থ ছিল সাম্প্রদায়িক ‘দাঙ্গা’। আমরা দাঙ্গাবাজ এই বদনাম কে দেবে? কিন্তু এই কলকাতাতেই কত লোক ছুরিকাহত হল, কত নিরপরাধ মানুষ ভিটেমাটি ছাড়া হল, তার সঠিক হিসেব আজও কারও হাতের গোড়ায় নেই। এইখানেই শেষ নয়, আগুন ছড়াল সারা বাংলায় এবং নোয়াখালিতে ছুটলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী এবং তার পরের বছরে দেশভাগ অনিবার্য হয়ে উঠল। যারা একদিন বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবের জন্য কার্জন সাহেবকে প্রবল নিন্দা করেছিল, তারাই বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবে বিশেষ উৎসাহিত হল। ১৫ আগস্ট ১৯৪৭-এর মধ্যরাতে আমরা আরও একটা শব্দ পেলাম ‘পার্টিশন’। সেই সঙ্গে আরও একটি নতুন বাংলা শব্দ— ‘রিফিউজি’। কোনও কোনও বাঙালি লিখেছিলেন, ‘নতুন ইহুদি’। কিন্তু ধোপে টিকল না, সবাই ‘রিফিউজি’ হয়েই পথে বসতে চাইল।
তারপর আরও কত কী হল। নগর কলকাতা এবার বাঙালির হাতছাড়া, ক্যালকাটাকে ‘কলকাতা’ করেও ফলপ্রসূ কিছু হল না। দেশ ছাড়া মধ্যবিত্ত বাঙালি ততক্ষণে কাজ ছাড়া। রুজি রোজগারের সন্ধানে এবার শুরু হল মিডল ক্লাস বাঙালির সর্ববৃহৎ ‘ইমিগ্রেশন’। পণ্ডিতরা বললেন, এমন ঘটনা কখনও ঘটেনি, দূরদর্শীরা কাজের সন্ধানে এখন কোথায় না ছুটেছেন, বেঁচে থাক বেঙ্গালুরু, পুনে, মুম্বই, দিল্লি ইত্যাদি ইত্যাদি। অবশ্যই এই পরিবর্তনের একটা ভালো দিক আছে মা দুর্গা, মা কালী সেখানেও সম্মান পাচ্ছেন। কিন্তু কী হবে মধ্যবিত্ত বাঙালি ঘরের অনূঢ়া কন্যাদের? তাঁদের মা-বাবারা ধরেই নিয়েছেন, কলকাতায় তাদের পাত্র পাওয়া যাবে না। কিন্তু দুঃসংবাদ এই যে, প্রবাসী বাঙালি যেখানে কাজ সেখানেই বিবাহবন্ধন পছন্দ করছেন। বলার কিছু নেই, কলকাতার মধ্যবিত্ত এখন ‘জোরিয়াটিক সোসাইটি’ ও ‘রেমিট্র্যান্স ইকনমি’ শব্দ দু’টির প্রকৃত অর্থ বুঝতে শুরু করেছেন।
আমার জন্মকাল বিশ শতকের এক অবিস্মরণীয় সময়ে। দেশ তখনও স্বাধীন হয়নি, কিন্তু বহুজনের চোখে তখনও আত্মনির্ভরতার স্বপ্ন। তখনও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের মধ্যে রয়েছেন। তখনও আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, রাজেন মুখার্জি কলকাতায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু তখনও বসু বিজ্ঞান মন্দিরে কর্মব্যস্ত, বিধানচন্দ্র রায় তখনই খ্যাতির শিখরে। তারপরেও আমাদের কত কিছু হয়েছে।
সেই সময়েও মহামারী ছিল, তবে এপিডেমিক শব্দটি বাংলা অভিধানে প্রবেশের সাহস পায়নি। এখন তো আর একটি উদ্ধত বাংলা শব্দ বাঙালির দরজায় কড়া নাড়ছে— প্যানডেমিক। সেই সঙ্গে ‘ভ্যাকসিন’, আগেকার ‘টীকা’ শব্দটি আজ আর কেউ পছন্দ করছে না। অথচ টীকার সঙ্গে বাঙালির পরিচয় কয়েক শতাব্দী ধরে। তিরিশ, চল্লিশের দশকে মানুষ তেমন দীর্ঘজীবী হতো না। লোকে আশীর্বাদ করত শতায়ু হও, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই তখন ক্ষণজীবী। মৃত্যুকে সবাই অপছন্দ করত। কিন্তু ইদানীং কেউ কেউ মনে করে, মৃত্যু যতই দুঃখের হোক, এর একটা বিশেষ ‘বেনিফিট’ আছে, মৃত্যুর পরে মানুষের বয়স আর বাড়ে না—তাই বিবেকানন্দ আজও উনচল্লিশ, রামকৃষ্ণ আজও পঞ্চাশ, বঙ্কিম আজও পঞ্চান্ন।
একটা মজার প্রশ্ন কেউ কেউ জিজ্ঞেস করেন, মানুষ কবে থেকে বয়োজ্যেষ্ঠ বা সিনিয়র হয়? এর ঠিক ঠিক উত্তর আমার আজও জানা নেই। এককালে পঞ্চাশ পেরতে পারলেই বাংলার বোস, ঘোষ, দত্ত সন্তুষ্ট হতেন। মেয়েদের অবস্থা ছিল আরও খারাপ, তারা তো কুড়ি পেরলেই বুড়ি! তারপর এল ষাট। অনেকেই সিনিয়র সিটিজেনের সুবিধের জন্য ছটফট করতেন, বয়োবৃদ্ধ শব্দটা কারও পছন্দ হতো না। এর এই সুযোগেই বাংলায় আর একটা ইংরেজি শব্দ সহজেই ঢুকে গেল। তারপর এল সর্বনাশা সত্তর। মনে আছে, একজন বিখ্যাত কিন্তু সহৃদয় রাজনৈতিক নেতা আলিমুদ্দিন স্ট্রিট থেকে ফোনে আমার জন্মদিনে বললেন, ‘একটা বছর আপনাকে বিশেষ একটু সাবধানে থাকতে হবে, অনেকেই আপনাকে বাহাত্তুরে বলবে। তার মানেই হচ্ছে, আপনি গুড ফর নাথিং। কিন্তু চিন্তা করে অযথা রক্তচাপ বাড়াবেন না, এই বিভ্রান্তি মাত্র এক বছরের জন্যে। বাহাত্তর পেরিয়ে তিয়াত্তরে পা দিলে আর কেউ আপনাকে ওই অপবাদ দেবে না!’
যখন আশি বছর এল, তখন এক পাঠক রসিকতা করে লিখল—‘আশিতে আসিও না।’ রামকৃষ্ণ মিশন হাসপাতালের এক সন্ন্যাসী আমার দুঃখের কথা শুনে বললেন, এসব সেকেলে কথা! এখন বিরক্ত বৃদ্ধরা হসপিটালে শুয়ে শুয়ে জিজ্ঞাসা করেন, কেন ঘুম তেমন হচ্ছে না আগেকার মতন। এই সন্ন্যাসীই আমাকে বলেছিলেন, মশাই, একাশি বছরে পড়ার সুবিধে অনেক। আপনি রবি ঠাকুরের সিনিয়র হয়ে যাবার দুর্লভ সুযোগ পাচ্ছেন, আপনি কবিগুরুকে ‘তুমি’ বলতে পারবেন, কারণ ওঁর বয়স আর বাড়ছে না, বঙ্গীয় সংসারে এইটাই বহুকালের সুবিধা।
এইসব রসরসিকতা পেরিয়েও, ক্রিকেট মাঠে এইট্টি সেভেন স্কোর হলে প্রিয়জনদের উত্তেজনা বেজায় বাড়ে। যাঁরা পেনশন দেন তাঁরাও চিন্তিত হয়ে পড়েন, অথচ এইট্টি সেভেন নম্বর পরীক্ষায় পেলে আমাদের সময় যথেষ্ট হইচই পড়ে যেত! এখন নাকি নাইনটি নাইন না পেলে গার্জেনরা সন্তুষ্ট হন না, অর্থাৎ প্রত্যাশার কোনও শেষ নেই। তবু যদি ৭ ডিসেম্বর ২০২০ আসে এবং কারও বলতে ইচ্ছে হয়, ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে’ তাহলে ভাববেন না বুড়োদের লোভের অন্ত নেই। দেখা যাচ্ছে, প্রত্যেক লোকই দেহাবসানের পরও বেঁচে থাকতে চায় অনেক যুগ ধরে। এইটাই সব লোক, সব কবির চিরকালের স্বপ্ন। এইটুকু মেনে নিন না একটু দয়াপরবশ হয়ে। জুনিয়র সিনিয়র সিটিজেন, অর্ডিনারি সিনিয়র সিটিজেন এবং সিনিয়র সিনিয়র সিটিজেনরা একটু সুখের সন্ধান পাবেন, তাঁদের আর কেউ অযথা শতায়ু হবার স্বপ্ন দেখবেন না।
গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল
সহযোগিতায় : স্বাগত মুখোপাধ্যায়
06th December, 2020