সমৃদ্ধ দত্ত, রায়বেরেলি: সব্জি মান্ডিতে তরমুজ এসেছে। টেম্পোর ডালা খুলে ঝুড়ি নামাচ্ছেন দুই বৃদ্ধ। মসজিদ মোড়ে ঢোকার মুখে ঘোড়ার খুরের নাল লাগাচ্ছেন চালক, আর তাঁর সহকারী। কাহার মহল্লার সামনে বেজায় ভিড়। এককালে এই কাহারের দল এসেছিল পালকিবাহক হিসেবে। আজ তারা মান্ডির মাল ওঠানো-নামানোর কাজ করে। আর শহরে চুরি জোচ্চুরির অপরাধ ঘটলে পুলিস সবার আগে হানা দেয় এই মহল্লাতেই। বাসস্ট্যান্ডের সামনের রাস্তায় দিনভর যানজট। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের মলিন হওয়া মূর্তি ঢাকা পড়েছে কম্পিউটার প্রশিক্ষণের বিজ্ঞাপনে। যে উড়ালপুল দিয়ে এইমাত্র কাছাড়ি রোডে এসেছি, সেই পুল এর মধ্যে দু’বার ভেঙেছে। এতকাল অবশ্য কোনও পুল ছিল না। কয়েক বছর হল হয়েছে। কাছাড়ি রোডের আয়তন কত? মেরেকেটে ১২ থেকে ১৬ ফুট। ই-রিকশ, ঘোড়ার গাড়ি, খচ্চরে টানা ফলের ভ্যান, স্কুটার, সাইকেল এবং ফোটোকপি করার একের পর এক দোকানের সামনে যেমন-তেমন করে রাখা সাইকেলের রাস্তার নাম কাছাড়ি গলি হওয়ারই ছিল। এই সরু, ক্লান্তিকর যানজটের রাস্তায় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ভবন—দেওয়ানি আদালত, জেলাশাসকের অফিস এবং তিলক ভবন। এই শেষেরটি সবথেকে পুরনো। আর সবথেকে ঐতিহাসিক। কারণ এই যে কোনওমতে দু’টি গাড়ি পার্কিং করতে পারবে এবং প্রধান হলঘরে একসঙ্গে খুব বেশি হলে ৫০ জন বসে কথা বলতে পারবে—এই হল জেলা কংগ্রেস কার্যালয়। এই বিবরণ কোনও আধুনিক শহরের কীভাবে হতে পারে? এ তো গঞ্জের কোনও জনপদ... যেখানে নির্বাচিত প্রার্থীর মুখ দেখা যাবে পাঁচ বছরে একবার। অথচ আশ্চর্য! এই নাকি রায়বেরেলি!
রায়বেরেলিকে কি শহর বলা চলে? দুটো সরকারি কলেজ। দু’টি সরকারি স্কুল। তিন কিমির মধ্যে শহর শেষ। জেলাসদর এরকম হয় নাকি? অতএব রায়বেরেলিতে এলে প্রথমেই মনে হবে, ঠিকানা ঠিক আছে তো? এটাই শহরের কেন্দ্রস্থল? রহস্যজনক এই লোকসভা কেন্দ্রটি বিভ্রান্তিকর। সবথেকে বেশি বিভ্রান্ত কে? বিজেপি। কেন? কারণ, রায়বেরেলির গান্ধীবন্দনার কারণ যে কী, সেই রহস্য তারা ভেদ করতে পারে না। সেই ১৯৫২ সালে জওহরলাল নেহরুর জামাই ফিরোজ গান্ধীকে দিয়ে শুরু। যে গান্ধী একবার এই লোকসভা কেন্দ্র থেকে পার্লামেন্টে ঢুকেছেন, তাঁর আর বেরনোর রাস্তা নেই। গান্ধীদের কখনও চিরতরে হাত ছাড়েনি রায়বেরেলি। ফিরোজ গান্ধী। ইন্দিরা গান্ধী। সোনিয়া গান্ধী। এই যে, রায়বেরেলিতে হাজির চতুর্থ গান্ধী—রাহুল।
জেলা কংগ্রেস কার্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে কংগ্রেস নেতা বিজয় চৌধুরী বললেন, ‘কোর্টের সামনের রাস্তা ধরে সোজা এগলে এখন যেখানে মার্কেট হয়েছে, তার পিছনে হয়েছিল ইন্দিরা গান্ধীর সেই বিখ্যাত সভা। ওই সভায় নাকি সরকারি অফিসার প্রধানমন্ত্রীর হয়ে কাজ করেছিলেন। আর ওই নগণ্য অপরাধে বিরোধী প্রার্থী রাজনারায়ণের দায়ের করা মামলায় এলাহাবাদ হাইকোর্ট সেই ১৯৭১ সালের রায়বেরেলির লোকসভার নির্বাচন অবৈধ ঘোষণা করে দেয়। ওই এক রায়ের ধাক্কায় জরুরি অবস্থা। আর ১৯৭৭ সালে সেই জরুরি অবস্থায় জেরে ভোটে হেরে গেলেন স্বয়ং ইন্দিরা গান্ধী।’ তার মানে তো গান্ধী পদবীর বিদায়? ‘কোথায় কী? ১৯৮০ সালে আবার ইন্দিরা গান্ধী। হাঃ হাঃ হাঃ।’ বিজয় চৌধুরীকে দেখে মনে হল এদিনই রেজাল্ট বেরিয়েছে আশি সালের ভোটের।
কাছাড়ি রোডে ঠিক কংগ্রেস অফিসের সামনে বিজেপি সমর্থক আবেশ কুমার বিস্ময় গোপন করছেন না। তিনি একা নয়। তাঁর দলও বিস্মিত। তাঁরা বুঝতে পারছেন না যে, এই আশ্চর্য সাইকোলজির কারণ কী? বললেন, ‘রায়বেরেলির হালত দেখুন। নিজের চোখেই তো দেখছেন। এরকম ম্লান, অনুজ্জ্বল, টিমটিমে এক অস্তিত্ব নিয়ে সন্ধ্যা সাড়ে ৮টায় প্রায় অন্ধকার হয়ে যাওয়া জনপদ। এই কেন্দ্র লাগাতার ভারত সরকারের প্রধান নীতি নির্ধারককে পাঠিয়েছে, কেউ বলবে? সবাই মিলে কত বছর রাজত্ব করেছে? তাহলে এই হাল কেন?’
দেওয়ানি আদলেতের আইনজীবী সুরিন্দর কুমার ৪৫ বছর ধরে রায়বেরেলির রাজনীতি দেখছেন। বললেন, ‘ওসব ফালতু কথায় কান দেন কেন? এইমস কে দিয়েছে? এনআইএফটি কে দিয়েছে? ফুটওয়্যার ইনস্টিটিটিউট, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, উড়ান অ্যাকাডেমি কে দিয়েছে? একসঙ্গে এই তাবৎ কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান ভারতের ক’টা শহরে আছে? আমাদের শহর, জেলার নাম ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্র, আর ইতিহাসে কারা ঢুকিয়েছে? গান্ধীরা।’
বিজেপি তো আমেথিতে মিরাকল করেছে ২০১৯ সালে। গান্ধীদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে দুর্গ। রায়বেরেলিও হতে পারে? বিজেপির নেতা-কর্মীরাই বলছেন, প্রার্থী দীনেশ সিংয়ের উপর মানুষ প্রবল ক্ষুব্ধ। বিজেপি কর্মীরাই তাঁর হয়ে প্রচার করছেন না। কংগ্রেস কর্মী বিজয় চৌধুরী ফিসফিস করে বললেন, ‘রায়বেরেলির কথা ছাড়ুন! আমেথিতে স্মৃতি ইরানি এবার জিতবেন তো? খোঁজ নিতে যান, জিরো চান্স!’ বলেন কী?
বিজয় হেসে বলেন, ‘এবারের সেরা সারপ্রাইজ! যান যান, ঘুরে আসুন।’