২৮৯৮ সালের কাশী শহর। প্রযুক্তির রমরমা, কিন্তু শুকিয়ে গিয়েছে গঙ্গা। খাবার-জল দুষ্প্রাপ্য, মানুষের মধ্যে ভালোবাসা নেই, বায়ুতে বিষ। আর ঠিক তার পাশেই শস্যশ্যামলা, জল, খাবার, ভোগবিলাসে পরিপূর্ণ এক ‘কমপ্লেক্স’। সেখানকার সুপ্রিম ইয়াসকিনের (কমল হাসান) কথাতেই চলে বিশ্ব। তিনিই ভগবান। গোপনে মহিলাদের ল্যাবে বন্দি করে গোপন প্রোজেক্ট চালান ইয়াসকিন। আছে এক বিদ্রোহী এলাকা ‘শাম্ভালা’। হঠাৎ ল্যাব থেকে পালায় অন্তঃসত্ত্বা সুমতি (দীপিকা পাড়ুকোন)। পুরস্কারের লোভে সুমতিকে ধরতে বেরিয়ে পড়ে ভৈরব (প্রভাস)। সুমতির গর্ভের সন্তান ‘অবতার’ বুঝতে পেরে তাকে রক্ষা করতে নেমে পড়েন ছয় হাজার বছর ধরে শাপগ্রস্ত অশ্বত্থামা (অমিতাভ বচ্চন)। পুরাণ, মহাভারত আর প্রযুক্তি— ‘কল্কি ২৮৯৮ এডি’ সিনেমায় এই তিনকেই একসুতোয় গাঁথতে চেয়েছেন পরিচালক নাগ অশ্বিন। যেখানে কল্কি অবতারের উৎপত্তি হয় প্রযুক্তির সাহায্যে, ল্যাবরেটরিতে। অশ্বত্থামার অতিমানবিক শক্তির সঙ্গে ভৈরবের গ্যাজেটের লড়াই মনে করায় বিশ্বাসের সঙ্গে বিজ্ঞানের দ্বন্দ্ব। তাই হয়তো শেষ পর্যন্ত কাউকেই চূড়ান্ত বিজয়ী হিসেবে দেখানো হয়নি। একইভাবে ভবিষ্যতের পৃথিবী কোথাও মনে করায় বর্তমানকেও। একচিলতে ঘরের বাসিন্দা ভৈরবের লক্ষ্য, যেনতেন প্রকারেণ কমপ্লেক্সে বিলাসবহুল জীবন কাটানো। এভাবেই তো প্রথম বিশ্বের কোনও দেশে ভালোভাবে বাঁচার আশায় প্রতিদিন আফ্রিকা, এশিয়া থেকে শত শত মানুষ ভেলায় চেপে ভেসে পড়ে উত্তাল সমুদ্রে। শাম্ভালাকে ঘিরে থাকে নিরাপত্তার বলয়, যাতে আটকে যায় ইয়াসকিনের বাহিনীর আক্রমণ। সেই বলয় যেন মনে করায় আজকের ইজরায়েলের তৈরি আয়রন ডোমের কথা। উপাদান ছিল প্রচুর। কিন্তু রান্না করতে গিয়ে শুরুতে কিছুটা ঘেঁটে ফেলেছেন পরিচালক। বিশেষত সিনেমার প্রথম ভাগ একেবারে নড়বড়ে। শুরুতে প্রভাসকে কেন কমেডির মোড়কে পেশ করলেন, বোঝা দায়। ভৈরবের মজার সংলাপে হাসির উদ্রেক হয় না। বরং তার রোবটিক এআই কার ‘বুজ্জি’র সংলাপে বেশি মজা লাগে। পরিচালকের যেন প্রথম থেকেই ‘কল্কি ইউনিভার্স’ তৈরিতে বেশি মনোযোগ। তাই অজস্র চরিত্র, সাব-প্লট তৈরি করেছেন। কিন্তু তাতে গল্প এগয়নি। দিশা পাটানির সঙ্গে প্রভাসের নাচ-গান মূল সিনেমার সঙ্গে খাপ খায় না। চরিত্রদের সঙ্কট বা সংলাপ—কিছুই ছাপ ফেলে না। গোটা সিনেমার বিভিন্ন দৃশ্যে একাধিক বিদেশি ছবির প্রভাব স্পষ্ট। চিলড্রেন অব মেন, ম্যাড ম্যাক্স ফিউরি রোড, ডিউন, ওয়াকান্ডা ফরএভার... তালিকা লম্বা। গল্পের মোড় ঘুরতে শুরু করে ইন্টারভালের আগে থেকে। আর শেষ আধঘণ্টায় অ্যাকশন, প্লট টুইস্টে মাথা ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন অশ্বিন।
প্রভাস এই সিনেমার হিরো হতে পারেন, তবে তাঁকে ছাপিয়ে গিয়েছেন অমিতাভ। যোদ্ধা অশ্বত্থামার ভূমিকায় তাঁকে ছাড়া আর কাউকে ভাবাই যায় না। চোখ, মুখের অভিব্যক্তিতেই মাত করেছেন তিনি। দ্বিতীয়ার্ধে অ্যাকশন যত বেড়েছে খোলস ছেড়ে বেরিয়েছেন প্রভাসও। ‘বাহুবলী’র পর এটিই তাঁর সেরা অভিনয়। দীপিকাকে দেখতে ভালো লাগলেও অভিনয়ের সুযোগই পেলেন না। তাঁর চরিত্র নির্মাণে আরেকটু সময় দেওয়া যেত। ইয়াসকিনের কমান্ডার মানসের চরিত্রে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় যথাযথ। বরং অল্প সময়ে ভয় ধরাতে পেরেছেন ইয়াসকিনরূপী কমল হাসান। তাঁর লুকের জন্য বাহবা প্রাপ্য মেকআপ বিভাগের। সন্তোষ নারায়ণের আবহ সঙ্গীত ভালো কিন্তু মনে রাখার মতো নয়। সব খামতি ঢেকে দেয় ভিএফএক্স। সুপারগান, স্পেসশিপ সদৃশ যানবাহন, সব কিছু বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রে যত্নের ছাপ স্পষ্ট। ইয়াসকিন কে? কল্কি অবতার কি সত্যিই সুমতির গর্ভে?— এরকম বহু প্রশ্নের জবাব এখনও মেলেনি। তার জন্য অপেক্ষা ‘কল্কি ২৮৯৮ এডি’র দ্বিতীয় ভাগের জন্য।
শুভজিত্ অধিকারী